কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন এতো তীব্র হলো?

প্রধান বিচারপতি কিছু একটা করুন?

কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন এতো তীব্র হলো?

আরিফুল সাজ্জাত

এটাতো ঠিক ছাত্ররা সরকার পতনের নয়, বরং তাদের স্বার্থের একটা বিষয় নিয়ে আন্দোলন করছে। যেটার বাস্তবায়ন রাষ্ট্র পরিচালনার একটা প্রক্রিয়াগত বিষয়। ২০১৮ সালে কোটা বাতিলের পরিপত্র হাইকোর্ট বাতিল করলেও, আগের সিদ্ধান্তই মানে কোটা থাকবে না এমন অন্তর্বতীকালীন সিদ্ধান্ত দেয় সর্বোচ্চ আদালত। যদিও বিষয়টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করতে তারা এক মাস সময় নেয়।

২০১৮ সালের পরিপত্র বাতিল করতে, এক রিটের প্রেক্ষিতে নির্বাহী বিভাগের সিদ্ধান্তের বিষয়টি এখন বিচারিক এখতিয়ারে চলে গেছে আপাতত। যারা শিক্ষার্থী, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন তাদের এটা না বোঝার কোন কারণ নেই?

তবুও কেন শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি?
অনেক দিন ধরেই ‘মেকানিক্যাল’ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় চলছে বাংলাদেশ। জাতীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক শক্তির একটা বড় অংশ ধারাবাহিকভাবে বর্জন করে আসছে। রাজনৈতিক ব্যবস্থা চূড়ান্তভাবে এককেন্দ্রিক হয়ে গেছে।

এর প্রভাব দেশের সব প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা সমাজে প্রভাব তৈরি করেছে। মানুষের মনে সরকারের প্রতি আস্থাহীনতা ও  অবিশ্বাস জন্ম নিয়েছে। অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হওয়ায়, বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ায় জনজীবনে কোন স্বস্তি নেই। তরুণ সমাজ যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, তাদের সামনে বড় কিছু পাওয়ার আশা কমে যাচ্ছে। বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস, তাদের মনে এই ধারণা জন্ম দিয়েছে, যত কিছুই হোক এদেশে চাচা-মামা, কোটা কিংবা ঘুষ ছাড়া কোন কিছু পাওয়া সম্ভব নয়। অনেকেই বিদেশে পাড়ি দেয়ার স্বপ্ন দেখলেও ইউরোপ-আমেরিকার অবস্থাও তেমন সুখকর নয়। সবমিলিয়ে তরুণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা হতাশা তৈরি হয়েছে।

সেখানেই আশার সলতে জ্বালিয়ে রাখতে একটা বিক্ষোভ কিংবা আন্দোলন অনিবার্য হয়ে ওঠে। এবার কোটা নিয়ে একটা রেশনাল সিদ্ধান্ত দেখতে চেয়ে তারা মাঠে নামে। মুহূর্তের মধ্যে সারাদেশের শিক্ষার্থীরা একে সমর্থন দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। শুরুর দিকে সরকার ও সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠন একে বলতে গেলে একরকম স্বাগতই জানায়। কিন্তু পরে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস কনফারেন্সে একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকারের অতি নার্ভাসনেস, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শক্তি প্রয়োগের দিকে ধাবিত করে। অথচ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা বা একসাথে বসে শিক্ষার্থীদের সামনে নিজেদের বক্তব্য দেয়া যেতে পারতো। শুধু মন্ত্রীদের গণমাধ্যমে কথা বলে উভয়পক্ষের মধ্যে যোগাযোগের ঘাটতি তৈরি হয়। পক্ষ বিপক্ষের মতো একটা পরিস্থিতির দায় এখনতো দেশবাসী দেখতেই পাচ্ছে।

শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকার’ ধ্বনি?
অভূতপূর্ব এবং হতাশাজনক ঘটনা ঘটায় শিক্ষার্থীরা। কিন্তু পরে এনিয়ে তারা ব্যাখ্যাও দেয়। শ্লোগান ছিলো, চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার/ আমি কে তুমি কে, রাজাকার-রাজাকার/ কে বলেছে, কে বলেছে-সরকার, সরকার। তবে শুরুতেই গণমাধ্যমে বিষয়টি যেভাবে আসে, এই ব্যাখ্যায় অনেকের মনে আর কোন রেখাপাত করেনি। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের এরকম শ্লোগানে, ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ খুব সহজেই লুফে নেয়। এবং এটা দমনের একটা রাজনৈতিক বয়ান তৈরি করতে সক্ষম হয়। তারা ক্ষমতা প্রয়োগ করে শিক্ষার্থীদের দমনের কৌশল নেয়। তার পরিণতিও দেশবাসী এখন দেখতে পাচ্ছে।

লড়াইয়ের ভেতরের লড়াই?
অনেকদিন ধরেই স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ও বিপক্ষ শক্তির একটা মুখোমুখি অবস্থান তৈরি করার চেষ্টা করে আসছে আওয়ামী লীগ। বেশিরভাগ সময়ই এতে তারা সফলও হয়েছে। যারা বিপক্ষ শক্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে, তারাও এর বিরুদ্ধে আরেকটা কৌশল নেয়ার জন্য সুযোগ খুঁজতে থাকে। এর প্রথম বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখি ২০১৮ সালে, কোটাবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে। অর্থাৎ জনপ্রিয় ইস্যুকে সামনে এনে, শিক্ষার্থীদের মুখে তালে তালে বাংলাদেশ বিরোধী শ্লোগান তুলে দেয়। সেসময়ে বিষয়টি বেশ আলোচনায় উঠে আসে। সেই সাংস্কৃতিক কৌশল এবারও খুব ভালোভাবে প্রয়োগ করে তারা। সরকারের তথাকথিত অনাচারের বয়ান তৈরি করে, নিজের রাজনৈতিক ভাবাদর্শ ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে এই শক্তি। যারা অর্থনীতিবাদী অর্থাৎ শুধুমাত্র দাবি-দাওয়া আদায় কেন্দ্রিক আন্দোলন করছে বা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের এই অনুপ্রবেশ নিয়ে ভাবতে হবে। একইসঙ্গে সরকার সমর্থকদেরও ভাবতে হবে, কিভাবে তাদেরকে সাংস্কৃতিক ও ভাবাদর্শিকভাবে আঘাত করছে স্বাধীনতাবিরোধীরা। উগ্র বলপ্রয়োগ নাকি অন্য কোনভাবে এটির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে, সেটির একটা কৌশল ঠিক করা জরুরি হবে সামনের দিনগুলোতে।

ছাত্রলীগকে বের করে দেওয়া এবং সাধারণ ছাত্রদের ‘ছাত্র রাজনীতি’ নিষিদ্ধ করা 
২০০০ সালের পর থেকেই, ক্যাম্পাসগুলোতে শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়াকেন্দ্রিক আন্দোলনে একটা বিশেষ রূপ দেখা যেতে থাকে। ৭০, ৮০ বা ৯০ দশকের মতো, এই সময়ে বামপন্থী কিংবা প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে কোন আন্দোলন দানা বাঁধেনি। এমনকি কোনো আন্দোলনে সামনে আসতে পারেনি ছাত্রলীগ কিংবা ছাত্রদলও। কেননা ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনগুলো সবসময়ই সরকারের নীতি প্রয়োগে ভূমিকা রাখা কিংবা মুখপাত্রে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে বামপন্থীদের জনপ্রিয়তায় একটা ধসও দেখা যায় এইসময়ে। তারাও অনেকটা অপ্রয়োজনীয় সংগঠনে পরিণত হয়েছে।  নিজেদের মধ্যে বিভিন্নভাবে বিভক্ত হতেও দেখা গেছে তাদের। তাদের সংগ্রামের মূল কথায় দৈনন্দিন সমস্যার চাইতে চূড়ান্তভাবে বিপ্লবের তথা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের চাহিদাই বেশি থাকে। এই কৌশলে কথাবার্তা তৈরি করতে যেয়ে শিক্ষার্থীরা তাদের মতাদর্শকেই চ্যালেঞ্জ করে ফেলে। সবমিলিয়ে এইসব কারণে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে নির্যাতনবিরোধী ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ, ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ছাত্র অধিকার পরিষদ কিংবা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মতো প্লাটফর্মের সৃষ্টি হয়েছে। এর মানে ছাত্ররা আর কোন রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনে ঐক্যবদ্ধ হতে চাচ্ছে না।  
অন্যদিকে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে গেস্ট রুম কালচার, ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন, এইসব দল থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। তারা দিনের পর দিন দেখছেন, জোর করে মিছিলে যেতে হবে, সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়াশোনা করেও, যারা অছাত্র-মাস্তান তাদের কাছে নতজানু হয়ে থাকতে হবে। বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীরা এসব থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেছে। প্রথমবারের মতো গত ফখরুদ্দিন-মঈনউদ্দিন কেয়ারটেকার সরকারের সময় ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ অনেকটা ক্যাম্পাস ছাড়া হলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা হাফ ছেড়ে বাঁচে। যদিও পরবর্তীতে আবার এদের সাথে কাঁধে কাঁধ রেখে গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও সারথি হয় তারা। তবে সেই গণতন্ত্র এলেও, ২০০০ সালের ছাত্রদল কিংবা ২০১০ সালের পর থেকে ছাত্রলীগের আচরণে খুব বেশি পরিবর্তন হয় নাই। এর সাথে হলগুলো সঠিকভাবে পরিচালনা করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের উন্নাসিকতা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে। যার ফল আমরা দেখলাম ছাত্ররা নিজেরাই পরাক্রমশালী ছাত্রলীগকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে বের করে দিয়েছে। এরকম অবস্থায় ছাত্রদল থাকলেও, একই পরিণতি ঘটতো। একইসাথে সাধারণ শিক্ষার্থীরা হল প্রভোস্টদের নিকট থেকে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের অঙ্গীকারনামাও নিয়ে নিচ্ছে। তারা একধরনের ‘মুক্তাঞ্চল’ তৈরি করেছে। এই কনসেপ্ট দিনে দিনে তাদের মধ্যে তৈরি করে দিয়েছে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো। যদিও এই ঘটনায় তাদের কোন নেতৃত্ব নেই। আর সুযোগটা নিয়েছে ঢাবিতে নিষিদ্ধ ছাত্র শিবির । যদিও বিষয়টি ভাঙ্গতে প্রশাসন চিরাচরিত কৌশল, বিশ্ববিদ্যালয়-আবাসিক হল বন্ধের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। এতে আপাততভাবে সমস্যার সমাধান হলেও হতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এর একটা প্রভাব থেকে যাবে।
সাধারণ শিক্ষার্থীরা কোনভাবেই আর ক্যাম্পাসে-হলে নির্যাতনের শিকার হতে চান না। সেই সেন্টিমেন্ট থেকেই তারা ছাত্র রাজনীতি বন্ধ চায়। এর মানে কিন্তু দলীয় সাইনবোর্ডধারী ছাত্র সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ড তারা আর দেখতে চাননা। আপাতভাবে ছাত্রলীগ মার খেয়েছে বলে অন্যরা উল্লসিত কিন্তু তাদের কাছেই কঠিন একটা মেসেজ দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। একইসাথে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণে যারা আছেন তাদেরকেই বার্তা দিয়েছেন তারা। স্বাধীনতার এতো বছর পর এসে, দলভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি কতোটা প্রয়োজন সেটি ভাবার প্রয়োজন অবশ্যই রয়েছে।

এরপর কী? ভূমিকা রাখতে পারেন কি প্রধান বিচারপতি?
যে ঘটনায় এরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, সেটি থেকে বের হওয়ার উপায় কি? এইভাবে পক্ষ বিপক্ষ হয়ে একে অপরকে বিনাশ করার চেষ্টা নাকি সমস্যার সমাধান করা? বুঝে হোক আর না বুঝেই হোক ছাত্রলীগ-সাধারণ শিক্ষার্থীর সাথে ছাত্রদল কিংবা শিবিরের অংশগ্রহণে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো, এতোগুলে প্রাণ ঝড়লো সেখানে কি নিশ্চুপ থাকতে পারেন সর্বোচ্চ আদালত? কেননা বিষয়টি তাদের কোর্টে যাওয়ার পর থেকেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়েছে। সেখানে প্রধান বিচারপতি নিজেই একটা আদেশ দিতে পারেন বা দ্রুত শুনানি করেও একটা নির্দেশনা দিতে পারেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে কিছু কিছু ঘটনায় রাতেও আদালত বসার নজির রয়েছে। সারাদেশে যে বিশৃংখলা ও দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়েছে সেটিকে আমলে নিয়ে একটা ভূমিকা অবশ্যই রাখতে পারেন প্রধান বিচারপতি।  
কিন্তু ক্ষত থেকে যাবে বহুদিন…?

আগেই বলেছিলাম জনপ্রিয় ইস্যুকে সামনে রেখে মানুষের মনোজগতে যে বিষয়গুলো ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে তাতে কি শুধুই আওয়ামী লীগ সরকারের রেজিমই হুমকির মুখে পড়বে? কারণ শ্লোগানগুলো দেখে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী একটা মতাদর্শ তৈরি করার চেষ্টা চলছে। একইসাথে সরকারকে স্বৈরাচার তকমা দেয়ারও চেষ্টা আছে। সবমিলিয়ে বেশিরভাগ জনগণের মধ্যে যদি এরকম একটা চেতনা তৈরি করা যায় সেটি ভবিষ্যত রাজনীতির গতি প্রকৃতি ঠিক করে দিতে পারে। ক্ষুদে শিক্ষার্থী যারা সড়ক নিরাপদ আন্দোলন করেছিল তারা এখন বড় হয়েছে। কোটাবিরোধী আন্দোলনে তাদের অংশগ্রহণ দেখা গেছে। একটা প্রজন্ম প্রচণ্ডভাবে অ্যান্টি আওয়ামী লীগ হয়ে গড়ে উঠছে।  

আরিফুল সাজ্জাত, সাবেক ছাত্রনেতা
ই-মেইল: swzibt.du@gmail.com

news24bd.tv/তৌহিদ