শেখ হাসিনা এখন ভারতের ‘গলার কাঁটা’ 

নরেন্দ্র মোদি ও শেখ হাসিনা (টুইটার থেকে নেওয়া)

শেখ হাসিনা এখন ভারতের ‘গলার কাঁটা’ 

আহমেদ হোসেন

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈধ উপায়ে আর মাত্র ২৩ দিন ভারতে থাকতে পারবেন তিনি। সেই হিসাবে আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ভারতের মাটিতে অবৈধ হতে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা। এখন তাকে ভারত রাখবে নাকি অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেবে তা নিয়ে এক দোদুল্যমান অবস্থায় আছে ভারত।

এসব বিষয় নিয়ে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম ‘দ্য ওয়্যার’ (the wire)- এ লিখেছেন আহমেদ হোসেন। তার পুরো লেখাটি নিচে তুলে ধরা হলো।  

গত দেড় দশক ধরে নির্বিচারে শেখ হাসিনার নৃশংসতা ও স্বৈরাচারী শাসনকে সমর্থন করে আসছে ভারত। বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারি দল আওয়ামী লীগের ২০ দিনের রক্তক্ষয়ী সহিংসতায় ৫৪৩ জন নিহতের পর একটি সামরিক কার্গ বিমানে সেই ভারতেই পালিয়ে আশ্রয় নেন হাসিনা।

বছরের পর বছর অটোক্র্যাটিক হাসিনা সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে সাউথ ব্লক। যেটা হাসিনা সরকারের সুবিধাভোগীদের ১৫০ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচারে সুবিধা করে দিয়েছে, যা দেশটির মোট বাজেটের দ্বিগুন।      

বিশেষ করে গত কয়েক বছর বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের স্পন্দন বোঝার চেষ্টা করেনি ভারত। হাসিনার শাসনামলে কখনোই বাংলাদেশ বা এর জনগণের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করেনি নরেন্দ্র মোদি সরকার। উল্টো ভারতের জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে হলেও হাসিনা ও আওয়ামী লীগের স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত ছিলেন মোদি। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র যখন বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে কথা বলছিল এবং তাদের শাস্তির আওতায় আনার চেষ্টা করছিল, তখনও ওয়াশিংটনের সঙ্গে লবিং করে হাসিনাকে রক্ষার চেষ্টা করেছিল ভারত। দিল্লি এসব ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রকে বলেছিল, ‘বাংলাদেশের ব্যাপারে যদি যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল ভারতের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হয়, তবে তা নিতে পারবে না ভারত। ’ 

১৯ জুলাই পুলিশের গুলিতে যখন ৭৫ জন মারা গেল, তখন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. এস জয়শঙ্কর এটিকে ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে অভিহিত করলেন। হাসিনার পতনের পর ছাত্র জনতার অর্জনকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে ঘোষণা দেন নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ওই দিনই জয়শঙ্কর সংসদে বক্তৃতা দেন। কিন্তু কেন ভারতের ঘনিষ্ট প্রতিবেশী হাসিনা সরকারের প্রতি দেশটির জনগণ এতটা ঐক্যবদ্ধ এবং বিরূপ তা চোখে পড়েনি জয়শঙ্করের।  

আত্মসমালোচানায় না গিয়ে বা দেশটির জনগণের অবস্থান চিন্তা না করে, উল্টো ভারতীয় কিছু মিডিয়ায় হাসিনার পতনের পিছনে পাকিস্তান, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের হাত রয়েছে বলে খবর প্রচার করে। এটা সত্যিই পরিহাসের বিষয় যে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষুদ্র বাংলাদেশের মিত্র হিসেবে দেখা হচ্ছে। পাকিস্তানের সম্পৃক্ততাও হাস্যকর। গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি পাকিস্তান ও ভারত উভয়কে ছাড়িয়ে গেছে। জেড-জেন যারা হাসিনা সরকারের পতনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের গড় বয়স ২৬ বছরের মধ্যে। যাদের স্মৃতিতে প্রত্যক্ষ স্বাধীনতা যুদ্ধ নেই, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কের জটিল জাল নেই। তাদের প্রত্যক্ষ স্মৃতিতে আছে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক, কেননা গত ১৬ বছর ধরে সরকারে রয়েছে আওয়ামী লীগ। এই আওয়ামী লীগের সঙ্গেই ঘনিষ্ট সম্পর্ক বজায় রেখেছে ভারত।         

কিছু ভারতীয় গণমাধ্যম এজান্ডা বাস্তাবায়নে আওয়ামী লীগ-পরবর্তী বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর আক্রমণের অতিরঞ্জিত সংবাদ প্রচার করে। যা পুরো উপমহাদেশে সমালোচিত হয় এবং সংখ্যালঘু নিপীড়নের ওই খবরকে তুচ্ছ করে তোলে।

সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের গুজব ভারতীয় মিডিয়া এস্টাবলিশ করতে ব্যর্থ হয়েছে। অনুরূপভাবে হাসিনাকে ভারতে রাখার চেষ্টাও ব্যর্থ হবে। কেনান ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসক হাসিনা একাধিক মামলার মুখোমুখি হয়েছেন। ইউনিসেফের মতে, বিক্ষোভে ৩২ শিশু নিহত হয়েছে। নিহত সবচেয়ে ছোট শিশুটির বয়স এখনো পাঁচ বছরও হয়নি। তাদের মধ্যে রিয়া গোপ, যার বাবা-মা হিন্দু ছিলেন, ছাদে খেলতে গিয়ে বিপথগামী বুলেটের আঘাতে মাথায় গুলিবিদ্ধ হন। এই অমানবিক কর্মকাণ্ড যার নির্দেশে হয়েছে তাকে রক্ষা করা বা আশ্রয় দেওয়া অসম্ভব।

এই অবস্থায় বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক যথাযথ থাকাটা কঠিন। হাসিনাকে বছরের পর বছর সমর্থন দিয়েছে ভারত। সাধারণ বাংলাদেশিরা ভারতকে আওয়ামী লীগ থেকে আলাদা করতে পারে না। এর প্রমাণ হলো হাসিনার পতনের কয়েক ঘণ্টা পর ঢাকার কেন্দ্রস্থলে ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ঢাকায় ভারতের ভিসা সেন্টার বন্ধ করে দেওয়া হয়। যদিও গত সপ্তাহে ঢাকায় ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্র সীমিত আকারে ফের চালু হয়েছে।

হাসিনাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ভারতে থাকতে দিলে বাংলাদেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক আরও খারাপ হতে পারে। হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ চূড়ান্ত হলে নতুন বাংলাদেশ সরকার তাকে প্রত্যর্পণ চাইতে পারে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে, যার বিধানের অধীনে বাংলাদেশ হাসিনাকে চাইতে পারে। তার বিরুদ্ধে ২৭টি হত্যা মামলা রয়েছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ সরকার হাসিনার পাসপোর্ট প্রত্যাহার করেছে, যেটি তিনি ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় ব্যবহার করেছিলেন। এটা দিল্লিতে তার অবস্থানকে আরও জটিল করে তুলেছে।

যদি ভারত হাসিনাকে এর পরও আশ্রয় দেয়, তবে বাংলাদেশের তরুণদের থেকে ভারত অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এবং এই তরুণরা চীনের দিকে ঝুঁকে যেতে পারে। ভারত এমন সিদ্ধান্ত নিলে স্পষ্টতই তা ভারতের জন্য ভালো হবে না।  

ভারতের জন্য এখন একটি বড় পদক্ষেপ হলো, সমস্যার কথা স্বীকার করা এবং বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। পুরনো চামচাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নতুন বন্ধু খুঁজে বের করা। ভারতকে অবশ্যই বুঝতে হবে যে, পুরানো নীতি ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশে তার পুরানো বন্ধুরা জনসাধারণের কাছে তুচ্ছ হয়ে গেছে।

ভারতকে বাংলাদেশকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারতের সাহায্য আমাদের ইতিহাসের অংশ। কিন্তু ৫৪ বছর আগে যে সাহায্য দেওয়া হয়েছিল, তা বাংলাদেশকে ঋণী মনে করার জন্য যথেষ্ট নয়। যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের অর্ধেক মুক্ত করেছে, কিন্তু ইইউ মার্কিন উপনিবেশ নয়, ওয়াশিংটনও ফ্রান্স বা ইতালি বা জার্মানিতে গণতন্ত্রকে গলা টিপে দেওয়ার চেষ্টা করে না। ভারত যদি একটি আঞ্চলিক পরাশক্তি হতে চায়, তার পররাষ্ট্র নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে।  সাধারণ বাংলাদেশিরা ভারতের শত্রু নয়।  

news24bd.tv/আইএএম