মাজার মন্দিরে হামলা আওয়ামী পুনর্বাসন লীগের বয়ান

জিয়া হাসান

মাজার মন্দিরে হামলা আওয়ামী পুনর্বাসন লীগের বয়ান

জিয়া হাসান

ভারতের চেন্নাইয়ে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডে ব্যাংকের ডেপুটেশানে কর্মরত থাকার সময়ে, একটা অদ্ভুত মেয়ের সাথে পরিচয় হয়েছিল। মেয়েটার নাম জেসমিন।  
জেসমিন ডিপারট্মেন্টের ফ্রন্ট ডেস্ক এবং কল সেন্টার ম্যানেজ করতো । তার বয়স ছিল, ৩০ এর মত।

খুব রাফ একটা ভাব নিয়ে চলতো।  
ডিপার্টমেন্ট হেড থেকে শুরু করে একজন পিয়ন পর্যন্ত , সবাইকেই ধমক দিয়ে কথা বলতো। ডিপারমেন্টের অনেক পুরান কর্মী , তাই সবাই তাকে সমঝে চলতো।
জেসমিন একজন মুসলমান।
অফিসে প্রতি ওয়াক্ত নামাজ পড়তো।  
সে যখন নামায পড়বে তখন মিটিং বা অন্য কিছুর পরোয়া করতো না, সে সঠিক সময়ে সালাত আদায় করতো। একটা বৈরী পরিবেশ হলেও, বাকি অফিস তার সাথে মানায় নিতো- তার ব্যক্তিত্বের কারণে ।
আমাদের ডিপার্টমেন্টে প্রায় ২০ জন অফিসারের মধ্যে, জেসমিন এবং আরেক জন ছিল মুসলমান। আরেকজন যিনি ছিলেন, অনেক সিনিয়ার ছিলেন। কিন্ত খুব অনুজ্জল ছিলেন।
সেকেন্ড ক্লাস সিটিজনের হীনমন্যতাটা বোঝা যেত।   কিন্ত, জেসমিন ছিল খুব উজ্জ্বল।   সবাই তাকে সমঝে চলতো।   আমার দিকে খুব খেয়াল রাখতো। আমি বাংলাদেশ থেকে আসছি, ওর মুসলমান ভাই। আমার খাওয়া, দাওয়া কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা, হালাল খাবার পাচ্ছি কিনা, বাসা ঠিক আছে কিনা। আমার ওয়াইফ ঠিক মত আছে কিনা। বাচ্চার কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা।  

প্রথম দিন, আমি জোহরের নামাজ পড়ি নাই দেখে ,আমাকে খুব ঝাড়ি দিলো। ডেকে এনে বোঝালো। এক সময় সে নামাজ পড়তো না কিন্তু তার জীবনে কিছু বিপর্যয়ের পর সে সালাতের মধ্যে শান্তি খুঁজে পেয়েছে। এবং সে জানাইলো আমাদের বাংলাদেশীদের সম্পর্কে তার আরো উঁচু ধারণা ছিল। কিন্তু আমাকে নামায পড়তে না দেখে সে হতাশ হয়েছে।
আমি আমতা আমতা করে পালাইলাম।  
এরপর , প্রায় দুই মাস পর হয়েছে । আসে পাশের উল্লেখযোগ্য জায়গা দেখে ফেলছি। তো আমি আমার কলিগ পোন্নানা যার সাথে আমি এটাচড ছিলাম তাকে জিজ্ঞেস করলাম , চেন্নাইয়ে দেখার মত তেমন উল্লখযোগ্য আর কিছু পাচ্ছি না।
দুই মাসেই বোরিং হয়ে গ্যাছি। আমার ফ্যামিলিও বোর হয়ে গ্যাছে। কিছু জায়গা সাজেস্ট করো। লোকালরা যেই সব জায়গায় যায়।   পোন্নানা বললো, তুমি আসে পাশের কিছু মন্দিরে যেতে পারো। এই খানে কয়েকশো বছরের পুরনো বিখ্যাত কিছু মন্দির আছে।  আমার মন্দির দেখার তেমন কোন শখ ছিলনা। তবুও, লোকালদেরকে বোঝার জন্যে একটা স্যামপ্ল করার ইচ্ছা ছিল।
 
আমি বললাম সব চেয়ে বিখ্যাত সব চেয়ে পুরান মন্দির কোনটা বল আমি ঘুরে আসবো।   সে বললো, তুমি এক কাজ করো জেসমিনকে জিজ্ঞেস কর।   আমি বললাম, জেসমিন কিভাবে জানবে, মন্দিরের খবর। সে তো মুসলমান।   আমার আসে পাশে আরো দুই তিন জন কাছেই ছিল, যারা আমার কথা শুনতে পাচ্ছিল। তারা হই হই করে উঠলো, আয় হায় কি বলো ? 
জেসমিনের কাজ হইলো, চেন্নাই এর আসে পাশের সব মন্দিরে ঘুরে ঘুরে প্রার্থনা করা।
প্রতি উইক এন্ডে সে মন্দিরে ঘুরতে যায়। প্রার্থনা করে। আমি শুনে স্তম্ভিত, কি বলো? এইটা কেমনে সম্ভব।   তো জেসমিনকে জিজ্ঞেস করাতে, সে হেসে উড়ায় দিলো কথাটা কিন্ত, স্বীকার করলো। সে মন্দিরে ঘুরে ঘুরে প্রার্থনা করে।   আমাকে কি কি বুঝাইলো, এখন কথা গুলো খেয়াল নাই।   কিন্ত, আমি সেই দিন একটা চরম ধাক্কা খাইছিলাম।  
আমি নিজেকে বুঝালাম, সেইটা হয়তো, আজমির শরীফের মত কোন ব্যাপার।  
যেই খানে সব ধর্মের মানুষ প্রার্থনা করে।   লোকালরা তার এলাকার ধর্মের সাথে অভিযোজিত হয়ে পড়ে। হয়তো জেসমিনের ক্ষেত্রে সেইটা হয়েছে।  
জেসমিনকে আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে "বুঝি নাই/স্ট্রেঞ্জ" মানুষ হিসেবে হিসেবে মারক করে রেখেছি।
আমি অনেক বার ভাবছি, আমার মত জুম্মাবার বা মাগরিবের নামায পড়া মুসলমানকে আল্লাহ কবুল করবেন নাকি আল্লাহ জেসমিনকে কবুল করবেন যে খুবই বৈরী পরিবেশে আমার চেয়ে অধিকতর ইসলাম পালন করে আবার সে মন্দিরে ঘুরে যা করে সেটি শি - এর - ক ।  
সে একটা বৈরী পরিবেশে এক ওয়াক্ত নামায মিস দেয় না আবার সে মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে প্রার্থনা করে।   জেসমিনের গল্পটা ২০১৬ তে লিখেছিলাম কিন্তু আজ মনে পড়লো মাজার নিয়ে আলোচনার প্রেক্ষাপটে। এইটা আপনি বলতেই পারেন, অনেক মাজারে যা হয় তাকে শিরক বাদে অন্য কিছু বলা কঠিন , কিন্তু  আপনি কে , আরেক জন কিভাবে ইসলাম পালন করবে সেইটা নির্ধারণ করার।   আপনি কিভাবে জানেন একদিন জেসমিনের বা আরেক জন মাজারে শিরক করা মুসলমানের হেদায়েত হবে না। জামাতে ইসলামীর আমির এক সময় জাসদ করতেন।
আর শিরক হয় সেই অজুহাত মাজার ভাঙার যে আয়োজন করছেন, তার পরিনতি কি।  

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তো একটা ধর্মই ছিল। ফলে একটা রাষ্ট্র বা মব এর হাতে ধর্ম রক্ষার দায় দিলে সেইটা কিভাবে চূড়ান্ত ভাবে একটি ফ্যাসিজম হয় উঠে তাও কি গত ১৫ বছরে দেখেন নাই।
রাজনৈতিক ভাবে যদি আপনার এত টুকু বোধ না থাকে যে, শেখ হাসিনার ১৫ বছরের জুলুম শাহী প্রান্তিক গোষ্ঠীকে রক্ষা করার অজুহাত দিয়ে আমাদের উপর আধুনিক পৃথিবীর নিকৃষ্টতম স্বৈরাচার চালিয়ে গিয়েছে।

ফলে মাজার মন্দির ইত্যাদির উপর হামলা আওয়ামী পুনর্বাসন লীগের বয়ান তৈরি করে। আপনি কেন সেইটার রাস্তা তৈরি করতেছেন। স্বাধীনতা অর্জন থেকে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন, এই কথাটি তো ছোটকাল থেকে শুনেছেন।  
এখন সেইটা এপ্লাই করে দেখান।
প্লীজ ।

লেখক : অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকার।  

news24bd.tv/ডিডি
 

এই রকম আরও টপিক