শেখ হাসিনার পতন পরবর্তী ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক

ড. মোহা: আমিনুর রহমান

মত-ভিন্নমত

শেখ হাসিনার পতন পরবর্তী ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক

ড. মোহা: আমিনুর রহমান

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আশ্রয় নেন ভারতে। এখন প্রশ্ন উঠেছে, শেখ হাসিনার পদত্যাগ ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে কীরকম প্রভাব ফেলবে? 

বাংলাদেশে শেখ হাসিনার পদত্যাগকে ভারত তার বিরাট কৌশলগত পরাজয় মনে করছে  এবং গত একমাসে এই প্রেক্ষাপটে ভারতীয় রাজনীতিবিদরা ও নীতিনির্ধারকরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে যে হতাশা প্রকাশ করেছে তা কোন কূটনীতি শাস্ত্র সমর্থন করে না। বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার যে বিপ্লব এবং হাজারেরও বেশী যুবকের শহীদ হওয়াটাকে তারা কোন স্বীকৃতি তো দেয়নি বরং উল্টো ধর্মীয় রাজনীতির গন্ধ খুঁজছে।

 
অথচ ভারতেই একটা হিন্দুত্ববাদী দল ক্ষমতায় রয়েছে। তাছাড়া শেখ হাসিনার বিগত পনেরো বছরের অপশাসনকে তারা সমালোচনা করতে নারাজ। বরং ভারতীয় সমর্থনে হাসিনা যে ক্ষমতায় ছিলেন তা এখন ভারতের পক্ষে আর অস্বীকার করার সুযোগ নেই, বিশেষ করে হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে ভারত তা প্রমান করেছে।  
বাংলাদেশের নেতৃত্ব থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগ দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন তাতে কোন সন্দেহ নেই; এবং ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের উপর তার প্রভাব যে নেতিবাচক হবে, তা কিছুটা হলেও আন্দাজ করা গেছে।
ভারত এতে যে নাখোশ, তা ভারতীয় রাজনীতিবিদ এবং মিডিয়ার আচরণে বেশ স্পষ্ট। এবং কোন রাখঢাক না রেখেই তারা হাসিনার পক্ষ নিয়েছে এবং বাংলাদেশের অ্যভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে তা বলা যেতে পারে।  
এক্ষেত্রে চরম বোকামির পরিচয় দিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শংকর। এমনকি তাদের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশের অ্যভ্যন্তরীণ বিষয়ে খেয়াল রাখতে বলে পরিস্থিতিটাকে আরও জটিল করেছেন। ভারতীয় রাজনীতিবিদরা যেটা মানতে পারছেন না, ‘ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের’ ব্যক্তি ইমেজের কাছে আর্ন্তজাতিক মহলে তাদের ম্লান করেছে। তারা ইচ্ছা করলেই ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসেকে প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না: সমস্যাটা এখানেই।  

এখন প্রশ্ন হল, তবে হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশে ভারতের ভূমিকা কেমন হবে: বা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত। বিষয়টি নিয়ে কথা বলা সহজ নয় এবং একটু গোলমেলে। তবে ভারতের উচিত হবে ঢাকার নতুন নেতৃত্বকে স্বাগত জানানো এবং দুদেশের এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে আন্তরিকতা দেখানো। ভারতের জন্য একটা সুযোগ তৈরী হয়েছে নদীর পানি নিয়ে এবং সীমান্ত হত্যার বিষয়ে ন্যায্যতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের  সাথে আলোচনা করার। তাছাড়া, ভারত যদি বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতা করে যেমন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তরণে, অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে এমনকি আর্ন্তজাতিক মহলে সমর্থন দেয়, সেটা ভারতের জন্য মঙ্গলজনক। কারন, প্রতিবেশী কোন রাষ্ট্রের সাথেই ভারতের সম্পর্ক বন্ধুসূলভ নয়। ভারতের ’বিগ-ব্রাদার মনোভাব’ সার্কের মধ্যে ভারত-বিরোধী বাতাবরণের জন্ম দিয়েছে।
 তাছাড়া, ’ইন্ডিয়ান হেজেমনি’ এখন একটা কনসেপ্টে পরিনত হয়েছে ; যা ভালো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্যও অন্তরায়।     
ভারতের  উচিত বাংলাদেশের গণমানুষের মনন্ বোঝার চেষ্টা করা এবং এই ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসা যে, আওয়ামী লীগ-ই একমাত্র দল যে ভারতীয়দের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে। একটা স্বাধীন দেশ কিভাবে চলবে, কাকে ভোট দিয়ে দায়িত্বে আনবে সেটা তাদের অ্যভ্যন্তরীন বিষয়; সেবিষয়ে ভারতের নাক গলানো  চলেনা। অন্য বিষয়টি হলো, কেবলমাত্র ’সেভেন-সিস্টার’ এর জন্য বাংলাদেশকে ’নো-ম্যান্স’ ল্যান্ড হিসাবে ব্যবহারের যে প্রত্যাশা; সেটা কূটনীতিতে যথেষ্ট অগণতান্ত্রিক। তাই, দায়টা ভারতের; বাংলাদেশের সাথে সে সম্পর্ক উন্নয়ন ঘটাবে কীনা? 

ভারত যদি বর্তমানে বাংলাদেশের সাথে অমিমাংসিত নদীর পানি বন্টন এবং সীমান্ত হত্যা বন্ধ না করে তাহলে আর্ন্তজাতিক মহলে বাংলাদেশ এসব বিষয় উপস্থাপন করলে ভারত কিছুটা হলেও কোনঠাসা হবে। এক্ষেত্রে বর্তমানে ভারতের বাংলাদেশের ’ছাত্র-জনতার’ মনন্ বুজতে হবে। এখন, বাংলাদেশ কার্যত ছাত্রদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে এবং এসব বিষয়ে তারা আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার দাবী জানিয়েছে। ভারতের উচিত হবে, বাংলাদেশের ‘জেড জেনারেশনের’ কাছে পৌঁছানো।  
তাছাড়া সেপ্টেমবরের প্রথম সপ্তাহে মণিপুরে স্বাধীণতা আন্দোলনকারীরা আবারও সোচ্চার হয়েছে; পশ্চিম বাংলার মেয়েদের আন্দোলনে কলকাতা প্রায় অচল; যেীন নিগ্রহের অভিযোগ সামাল না দিতে পারাকে কেন্দ্রিয় সরকারের ব্যর্থতা বলা হচ্ছে; এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ভারতের জন্য ’বোঝার উপর শাকের আটির’ মত অবস্থা তৈরী করেছে। এ অবস্থায় ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস যদি আগামী সপ্তাহে জাতিসংঘের ভাষনে ভারতের বিরুদ্ধে পানির ন্যায্য হিস্যা আর সীমান্ত হত্যার আর্ন্তজাতিক তদন্ত দাবী করেন তাহলে ভারত যে বিব্রতকর অবস্থায় পড়বে; এতে সন্দেহ নেই।   
এখানে উল্লেখ্য যে, ভারতের বাংলাদেশে ১৩ বিলিয়ন ডলারের বার্ষিক বাণিজ্য রয়েছে। আর বাংলাদেশে প্রায় ২০ লাখ ভারতীয় চাকুরী করছে এবং গত ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ভারত বাংলাদেশে থেকে যে পরিমান রেমিটেন্স আয় করেছে তা ভারতের চতুর্থ সর্ব্বোচ্চ আয়। এছাড়া প্রতি বছর গড়ে ১.৬ মিলিয়ন বাংলাদেশের 

নাগরিক ভারত ভ্রমন করে। যেখানে গড়ে একজন তিন হাজার থেকে ১০ হাজার ডলার ব্যয় করে। এরই মধ্যে দেখা গেছে, গত এক সপ্তাহে কলকাতায় ব্যাবসা প্রায় শূন্যের কোঠায় এবং আবাসিক হোটেলে কোন কাস্টমার নেই। সার্বিক দিক বিবেচনায় অর্থনীতিতে বাংলাদেশের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।    
তাই সব দিক বিবেচনায়, ভারতের উচিত হবে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন  এবং বড় রাজনৈতিক দলের সাথে বিশেষ করে বিএনপির সাথে শক্তিশালী লবি বজায় রাখার চেষ্টা করা।  
তবে পরিস্থিতি যখন এমন, প্রশ্ন উঠেছে, ভারত সরকারের ঢাকার জন্য পরবর্তী করণীয় কি ? নাকি ভারত আবার ভুল পথে পা বাড়াবে আগের মতই? সম্ভবত:  বাংলাদেশ বিষয়ে ভারত এই প্রথম এমন পরিস্থিতিতে পড়েছে যা তাদের অভিজ্ঞতায় নেই।  
তাই এবার ভারতের উচিত হবে ’হ্যান্ডসেকের জন্য আগেই হাতটা  এগিয়ে দেয়া’। নাহলে, নিশ্চয় অন্য কোন দেশ বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সাথে সখ্যতা তৈরীর জন্য ’হাতটা এগিয়ে দেবে’। সেটা নিশ্চয় আধিপত্য বিস্তারে ভারতের জন্য শুভকর হবে না।  

লেখক: দক্ষিণ এশীয় বিষয়ক গবেষক।  
 
news24bd.tv/ডিডি

এই রকম আরও টপিক