পারিবারিক ও সামাজিক এক মেলবন্ধন ঈদ

ড. নিয়াজ আহম্মেদ

পারিবারিক ও সামাজিক এক মেলবন্ধন ঈদ

 ড. নিয়াজ আহম্মেদ

প্রতিবছর দুইবার আমাদের দরজায় কড়া নাড়ে ঈদ। ঈদকে কেন্দ্র করে মানুষ নাড়ির টানে ঘরমুখো হয়। বেশির ভাগ মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদ করতে যায়। ফলে শহরগুলো, বিশেষ করে ঢাকা শহর প্রায় ফাঁকা হয়ে যায়।

বাস, ট্রেন ও লঞ্চ যাতায়াতের বড় বাহন। মানুষ এগুলোতে চড়ে তাদের নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছে। এর বাইরেও যে যেভাবে পারে, সেভাবে প্রিয়জনদের কাছে ঈদ করতে যায়। কেউ বা ট্রাকে করে, আবার অনেকে নিজস্ব বাইকে, এমনকি কিছু পথ হেঁটে, আবার কিছু পথ অন্য কোনো বাহনে করেও যাচ্ছে নিজের বাড়িতে।

ট্রেন কিংবা লঞ্চের ছাদ কোনোটাই বাদ যায় না। যেভাবেই হোক, প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদ করতে যেতেই হবে। যেভাবেই হোক, আনন্দ উপভোগও ভাগাভাগি করতে হবে। কারো কাছে কোনো কষ্টই যেন কষ্ট মনে হয় না।

কেননা ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে উৎসব, ঈদ মানে বন্ধন, ঈদ মানে মিলনমেলা। এই মিলনমেলায় শরিক হয় পরিবারের কাছের সদস্যরা। সঙ্গে থাকে আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশী। এর বাইরেও বন্ধুবান্ধবসহ বিভিন্ন মানুষ, যাদের সঙ্গে রক্তের সর্ম্পক হয়তো নেই, কিন্তু রয়েছে অনেক দিনের সম্পর্ক, যা রক্তের চেয়েও অনেক বেশি। ঈদের সময় আমাদের গ্রাম, পাড়া ও মহল্লা যেন শহর হয়ে ওঠে।

বাড়িতে, পথে-ঘাটে, বাজারে ও অন্যান্য স্থানে মানুষের আনাগোনা এবং বিচরণ আমাদের জানিয়ে দেয় আমরা পারিবারিক ও সামাজিকভাবে কতটা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত। ঈদের সময় গ্রামে তৈরি হয় এক মেলবন্ধন, যেখানে একজন অন্যজনকে কাছে পেয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে; যার রেশ থাকে পরের বছরের ঈদ পর্যন্ত।  

আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ এখনো গ্রামে বাস করে। কর্মসংস্থান এবং অন্যান্য কারণে অনেককে গ্রাম থেকে এসে শহরে থাকতে হয়। এতে যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার তৈরি হচ্ছে। কিন্তু অনেকের বেলায় গ্রামে থেকে যাচ্ছে বৃদ্ধ মা-বাবা, ভাই-বোন ও আত্মীয়-স্বজন। তাদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত দেখা করাও সম্ভব হয় না। বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির যুগে হয়তো কথা হয়, ভিডিওতে ছবি দেখা যায়, কিন্তু মুখোমুখি দেখা সম্ভব হয় না। ঈদে বেশ বড় ছুটি পাওয়া যায়। ফলে গ্রামে বসবাসরত প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটানোর এক সুযোগ তৈরি হয়। দীর্ঘদিন পর একসঙ্গে হওয়া, ভাবের আদান-প্রদান, অনেক দিনের জমিয়ে থাকা কথা মুখোমুখি বসে প্রকাশ করার এক সুযোগ ঘটে। শারীরিক ও মানসিকভাবে একত্র হওয়ার সুযোগ, পারিবারিক সম্পর্ক সুদৃঢ় এবং একে অপরের প্রতি মমত্ববোধ তৈরি হয়। ঈদকে কেন্দ্র করে যেহেতু পরিবারের সদস্যদের একত্র হওয়ার সুযোগ ঘটে, ফলে এ সময় বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিয়ে, আকিকাসহ অন্য অনেক অনুষ্ঠান এ সময়ে আয়োজন করা হয়। ফলে পরিবারের কাছের এবং দূরের সব সদস্যের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ও ভাবের আদান-প্রদান সবার মধ্যকার বন্ধনকে আরো সুসংহত করে। মনের কষ্ট ও বেদনা, আশা ও আকাঙ্ক্ষা, সুখ ও দুঃখ বিনিময় মনকে পরিশুদ্ধ করতে সহায়তা করে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করা এবং যাবতীয় খোঁজখবর নেওয়া সম্পর্কের উন্নয়ন এবং শক্ত বন্ধনের ভিত্তি। আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন এবং বিকাশেও তাই ঈদ হতে পারে এক বড় চালিকাশক্তি। কেননা সরাসরি আলাপ-আলোচনা মানসিক প্রশান্তি অর্জনে সহায়তা করে। আর শরীর ও মন উভয়ই ভালো থাকলে পারস্পরিক সম্পর্ক ভালো ও সুসংহত হয়। পরবর্তী সময়ে দৈনন্দিন কাজে এর একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

ঈদ শুধু পারিবারিক বন্ধনই নয়, সামাজিক বন্ধনেরও এক বড় চালিকাশক্তি। দীর্ঘদিন পর ঈদে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার পর পরিবারের বাইরেও অনেকের সঙ্গে দেখা হয়। স্কুলের বন্ধুবান্ধব, ছোটবেলার খেলার সঙ্গী, এলাকার বড় ভাই, পাড়া-প্রতিবেশী, শুভাকাঙ্ক্ষী সবার সঙ্গে সাক্ষাতের এক সুযোগ ঈদ। এ সময় বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গেও দেখা-সাক্ষাৎ হয়। এখনকার সময় নিজ নিজ এলাকায় একাডেমিক ব্যাচভিত্তিক অনেক সংগঠন গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া রয়েছে অনেক ধরনের সংগঠন। এ সময় অনেকে ঈদ পুনর্মিলনীর আয়োজন করে। এই দিনে দীর্ঘদিনের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়। হয়তো বিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হওয়ার পর আর কখনো তার সঙ্গে দেখা হয়নি। ঈদ সেই সুযোগ করে দেয়। দীর্ঘদিনের একান্ত না-বলা ও পরিবারের কথা বলার এক সুযোগ তৈরি হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে আমরা হয়তো অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারছি, কিন্তু এর বাইরেও অনেকে রয়ে যায়। তাদের পাওয়ার জন্য আমাদের অবশ্যই গ্রামে যেতে হয়। সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতারা এ সময়ে কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে পারেন। তাঁদের সংগঠনের পরিধি ও নেতাকর্মীদের মধ্যে সম্পর্কও সুদৃঢ় হয়।

ইট-পাথরের এই শহরে আমরা নিজেদের মতো করে এতটা ব্যস্ত থাকি যে কাউকে সময় দেওয়ার মতো সময় আমাদের থাকে না। ফলে কোনো অনুষ্ঠান এবং লম্বা ছুটি আমাদের সুযোগ করে দেয় পরিবারের সঙ্গে একান্ত সময় কাটানোর। আর সেই সুযোগ যদি হয় গ্রামে বসবাসরত বৃদ্ধ মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশীসহ অন্যদের সঙ্গে, তাহলে তো কথাই নেই। ঈদ আমাদের সেই সুযোগ করে দেয়। মোটকথা, সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় করতে বর্তমান সময়ে ঈদ একটি মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত। একটি অনুষ্ঠান কিন্তু অনেকগুলো উদ্দেশ্য হাসিলের এক মাধ্যম। তাই ঈদ শুধু পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সেমাই-ফিরনি খাওয়া কিংবা পশু কোরবানি দেওয়াই নয়, পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনের এক বড় মেলবন্ধন। যারা ঘরমুখো মানুষ, তারা যেন নির্বিঘ্নে নিজ নিজ গন্তব্যে নিরাপদে পৌঁছতে পারে এবং সবার সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারে, আমরা সেই আশা করি। আবার যেন যার যার কর্মস্থলে নিরাপদে আসতে পারে, সেই কামনাও করছি। সবার ঈদ যাত্রা সুন্দর হোক। সবাইকে ঈদ মোবারক।  

লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।