জনগণের নির্ভরতার আশ্রয়স্থল আওয়ামী লীগ

শ্যামল দত্ত

জনগণের নির্ভরতার আশ্রয়স্থল আওয়ামী লীগ

শ্যামল দত্ত

উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ইতিহাস, অর্জন, উন্নয়ন, গৌরব ও সৃষ্টির দল আওয়ামী লীগ দেশের মানুষের আস্থার ঠিকানা। নানা উত্থান-পতন, সংঘাত ও সম্মিলনের মধ্য দিয়ে দলটির আজকের অবস্থান।

মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার মতো গৌরব পৃথিবীতে আর কোনো রাজনৈতিক দলের নেই।

আওয়ামী লীগই একমাত্র দল, যাদের নির্বাচনের মাধ্যমে টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় যাওয়ার রেকর্ড রয়েছে। এই ভূখণ্ডে বাঙালির যত অর্জন তার মূলে রয়েছে আওয়ামী লীগের অবদান। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে বাংলাদেশের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীও পালন করেছে দলটি।

পালন করেছে বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী।

এবার দলটি পালন করছে প্লাটিনাম জয়ন্তী উৎসব। ২৩ জুন দলের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ‘প্লাটিনাম জয়ন্তী’ উদযাপনের উদ্যোগ নিয়েছে আওয়ামী লীগ। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শামসুল হক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রহমানসহ আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাতাদের।

1
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

পাকিস্তানের অধীনে থাকা পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন মুসলিম লীগের নেতাকর্মীর অসাম্প্রদায়িক একটি অংশ বেরিয়ে গিয়ে রাজনৈতিক কর্মী সম্মেলনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে নতুন দল গঠন করে।

প্রতিষ্ঠার সময়ই দলের অসাম্প্রদায়িক নামকরণের দাবি উঠলেও সমাজ বাস্তবতা ও তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দলটি প্রতিষ্ঠার প্রায় ৪ বছর পর ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগ নামে বাঙালির অধিকার আদায়ের লড়াই-সংগ্রামের ব্রত নিয়ে এ রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগ। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ের পথ ধরে ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়ে দলটি অগ্রসর হয়। ’৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচনে বিপুল বিজয় ও স্বাধীনতার সংগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই গড়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে ’৭১-এ সংঘটিত মহান মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দেয়। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়।

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ১৯৮১ সালে সম্মেলন করে প্রবাসে থাকা বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে শেখ হাসিনা দলের হাল ধরেন। তার নেতৃত্বে দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি উল্লেখ করার মতো।

বঙ্গবন্ধু যে দলের ভিত্তি দিয়েছেন, সেই দলকে বহন করে চলেছেন শেখ হাসিনা। বহুবার ঘাতকের বুলেট-বোমার সামনে নিজের জীবনকে বিপন্ন করতে হয়েছে, তবুও দলের রক্ষাকবচ হয়ে থেকেছেন শেখ হাসিনা। তবে অমসৃণ দীর্ঘ এই চলার পথে আওয়ামী লীগের সামনে এসেছে নানা বাধা-বিপত্তি, দুর্যোগ-দুর্বিপাক। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে খুনিচক্র মনে করেছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করে দেবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে দীর্ঘ নির্বাসন শেষে স্বদেশের মাটি স্পর্শ করে শহীদের রক্তে ভেজা আওয়ামী লীগের পতাকা হাতে তুলে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ তথা অর্থনৈতিক মুক্তির দায়িত্বভার গ্রহণ করে বাংলাদেশকে আজ অনন্য উচ্চতায় উন্নীত করেছেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। এরপর দীর্ঘ সামরিক শাসন শেষে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হওয়ার পর ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। কিন্তু ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের আসনে বসে।

এরপর ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে আওয়ামী লীগের জয়যাত্রা শুরু হয়। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ, ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ ও ২০২৪ সালে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। সেই হিসেবে ২০০৮ সালের পর থেকে টানা চতুর্থবার এবং ১৯৭৩ সাল থেকে মোট ষষ্ঠবার সরকার গঠন করে রেকর্ড সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগ।

এ দেশের মানুষের যা কিছু মহৎ অর্জন তা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই অর্জিত হয়েছে। কালের বিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আজ ডিজিটাল বাংলাদেশের পথ পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বাপ্নিক অভিযাত্রী আওয়ামী লীগ। দীর্ঘ সাফল্য-সংগ্রামের পথ ধরে সফল রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে এবং তারই ধারাবাহিকতায় উন্নত-সমৃদ্ধ স্মার্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অভীষ্টে এগিয়ে যাচ্ছে।

শেখ হাসিনার সফল নেতৃত্বে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন। উত্তরা থেকে মতিঝিল চলছে ঢাকাবাসীর স্বস্তির মেট্রোরেল। চট্টগ্রামে চালু হয়েছে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে দেশের প্রথম টানেল। খরস্রোতা পদ্মা নদীর ওপর বহুমুখী দ্বিতল সেতু নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। পাবনার রূপপুরে ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনও শুরু হবে শিগগির। এছাড়া যমুনা নদীর উপর ৪.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতুর নির্মাণকাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন, নারী ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা, স্যানিটেশন বিশ্বে আজ প্রশংসিত। অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো উন্নয়ন সবকিছুতেই বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ’৭১-এর শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে, অনেকের শাস্তি কার্যকর হয়েছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ মানবিকতার অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে গৌরবান্বিত করেছেন।

বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্বে মর্যাদার নতুন মাত্রা দিয়েছেন। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়োপযোগী উন্নয়ন দর্শন। এখন সরকারের লক্ষ্য বাংলাদেশকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এ রূপান্তরিত করা। এ ক্ষেত্রে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে যদি আমরা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে অর্থাৎ কর্মক্ষম জনসম্পদকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারি, তাহলে স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট এবং স্মার্ট সোসাইটি এই চারটি মূল ভিত্তির ওপর নির্ভর করে আগামী ২০৪১-এর মধ্যে বুদ্ধিদীপ্ত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে উঠবে বলে আশা রাখি।

৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এ লগ্নে আওয়ামী লীগ কোথায় দাঁড়িয়ে। রাষ্ট্র পরিচালনার ইতিহাসে প্রথম টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় থাকলেও অসীম ত্যাগ ও আদর্শনির্ভর এই রাজনৈতিক দলটি স্বাধীন স্বকীয়তা নিয়ে সম্প্রীতির কর্মকাণ্ডে প্রশ্নও রয়েছে। তবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে তার সরকার সাফল্য পেয়েছে, এটা নিয়ে দ্বিমত নেই। কিন্তু রাজপথের চ্যালেঞ্জ রয়েই গেছে।

এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ পাশে রয়েছে, সেটা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। দলের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। এই চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই। সব প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের উত্থান সাময়িক নিষ্ক্রিয় হলেও তারা থেমে যায়নি। ৭৫ বছরের ঐতিহ্যবাহী দলটি অন্য দলের জন্য অনুসরণীয় হয়ে উঠুক এমন প্রত্যাশা রইলো।

news24bd.tv/SC