ফেনীতে গত ২৪ ঘণ্টা...

ফেনীর বন্যা পরিস্থিতি ও লেখক মুরাদ কিবরিয়া

ফেনীতে গত ২৪ ঘণ্টা...

মুরাদ কিবরিয়া

প্রায় ১০ ঘণ্টার জার্নি শেষ করে ফেনী থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছালাম। গতকাল (বুধবার) রাত ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত যখন ফেনী শহরে হাঁটছিলাম তখন বৃষ্টি আর বজ্রপাত ছিল। শহরের কোনো কোনো এলাকায় হালকা পানি উঠতেছিল। তবে শহরবাসীকে মনে হচ্ছিল উদাসীন; পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া নিয়েই তারা চিন্তিত ছিল।

 

রাত ১২টা নাগাদ যখন ফেনী থেকে সোনাগাজীর ডাকবাংলা পার হই, তখন আবহাওয়া ছিল চমৎকার। কোনো বৃষ্টি নেই। সোনাগাজী এবং এর আশেপাশে প্রচুর মাছ ধরা পড়ছিল। ধামা ধরে মাছ বিক্রি হয়েছে সারাদিন।

অন্যান্য অঞ্চলের ঘের এবং মাছের খামার প্লাবিত হয়ে মাছগুলো সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল। সোনাগাজীর লোকজনও ছিল উদাসীন। ডাকবাংলা, মতগঞ্জ, জিতপুর—কোথাও কোনো টেনশন ছিল না। এই এলাকাগুলো থেকে ভলান্টিয়াররা প্রস্তুত হচ্ছিল পরদিন (বৃহস্পতিবার), অন্যান্য এলাকায় উদ্ধার কাজে নামার জন্য।  

কিন্তু বৃহস্পতিবার ভোরে শুরু হয় প্রবল বৃষ্টি। সবকিছু এলোমেলো করে দিয়ে ফেনী শহর ডুবতে থাকে। ফেনীর সঙ্গে সোনাগাজীর সংযোগকারী রাস্তার কিছু অংশ পানিতে প্লাবিত হয়, কয়েক জায়গায় বড় গাছ উপড়ে পড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। ফেনীর সঙ্গে সোনাগাজীর যোগাযোগ কার্যত বন্ধ হয়ে যায়।  

আমরা বুঝতে পারি ঘটনা খারাপের দিকে যাচ্ছে। এলাকার লোকজনকে জিজ্ঞাসা করি, আপনাদের এলাকা ডুবে গেলে কী করবেন? ব্যবস্থা আছে কোনো? তখনও তারা আত্মবিশ্বাসী যে তেমন কিছু হবে না। মুহুরী বাঁধ খুলে দেওয়া হয়েছে। আর পানি সোনাগাজীতে স্থায়ী হয় না, নেমে যায়। কথার সত্যতা আছে কিন্তু একই সঙ্গে আশঙ্কার সাথে লক্ষ্য করি, সোনাগাজী একেবারেই প্রস্তুতিহীন। যেমনটা দেখেছিলাম রাতের বেলা ফেনী শহর। তখন কেবল বেলা ১০টা সাড়ে ১০টা। ডাকবাংলা থেকে ফেনীগামী মানুষ পায়ে হেঁটে রওনা দিয়েছে। সিএনজিসহ সব ধরনের যানবাহন তখন বন্ধ হয়ে গেছে।  

আর ততক্ষণে ফেনী শহর পানির তোড়ে তছনছ হতে শুরু করেছে। গলা সমান পানি। মহীপাল থেকে ফেনী শহর পর্যন্ত রাস্তায় বিপুল পানির স্রোত। সঙ্গে বৃষ্টি। একে একে শহরের একের পর এলাকা আমাদের চোখের সামনে ডুবতে থাকে। আমাদের যাবতীয় প্ল্যান ভণ্ডল হয়ে যায়। ১১টা নাগাদ ফেনী শহর প্রায় পুরোটা তলিয়ে যায়। ফেনী শহরে তখন কোনো বোট কিংবা কিছু নেই৷ মাস্টারপাড়া, ট্রাংক রোড ডুবতে থাকে আর লস্করহাটের পানি দোতলা ছুঁই ছুঁই।  

ফেনী শহরের কিছু মানুষ সব ফেলে বেরিয়ে পড়ে। মহীপাল তখনো কিছুটা সচল। মহীপালের লোকাল বাসগুলো কিছু যাত্রী নিয়ে ঢাকা এবং চট্টগ্রাম রওনা দেয়। তখনো প্রবল বৃষ্টি।  

দুপুর ১টা নাগাদ সোনাগাজীর ডাকবাংলার ধলিয়া মেইন রোড প্লাবিত হয়ে যায় এবং আমাদের কাছে একের পর ফোন আসতে থাকে ফেনী শহরের নানান জায়গায় আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধারের জন্য। আমরা পরিচিত বোটগুলিতে সেগুলো ফরওয়ার্ড করতে থাকি। আর আশঙ্কা করতে থাকি ফেনী শহরের লোকদের উদ্ধার করার তোড়জোড়ে দুই দিন ধরে আটকে থাকা ফুলগাজী, পরশুরাম আর ছাগলনাইয়া মানুষেরা হয়ত প্রায়োরিটির বাইরে চলে যাবে। যদিও সাধারণ সিভিলিয়ানদের জন্য এ সব এলাকায় যাওয়াটাই অসম্ভব হয়ে পড়েছে আগেই৷ 

বৃহস্পতিবার দুপুরের পর ডাক বাংলা, মতিগঞ্জ আর সোনাগাজীর আশেপাশের লোকজন ভয় পেতে শুরু করে। আমি সাবধান করেছিলাম বলে, তারা আমার কাছেই জানতে চায় কোনো শেল্টার খোলা হয়েছে নাকি, খুব বিপদ হলে কোথায় যাওয়া যায়? কীভাবে যাওয়া যায়? আমি উত্তর দিতে পারিনি। আশেপাশে এতবড় ডিজাস্টার কিন্তু ফেনী শহর আর সোনাগজীর নিজস্ব কোনো প্রস্তুতি নেই৷ কেউ কিছু জানে না।  

বিকাল নাগাদ বোঝা যায়, ফেনী জেলায় একটা লাশ কবর দেওয়ারও জায়গা অবশিষ্ট নেই।  

ততক্ষণে অবশ্য ঢাকা এবং চট্টগ্রাম থেকে একের পর আর্মি, আর স্পিডবোটসহ ভলান্টিয়ার ঢুকতে থাকে। ভালো হতে থাকে আবহাওয়া। বৃষ্টিও থেমে যায়। পরশুরাম থেকে পানি সরতে থাকে, তবে আগের মতোই কারো সাথেই যোগাযোগ করা যায়নি। মানুষ দিশেহারার মতো হয়ে যেতে থাকে। অনেকে ফুলগাজী, পরশুরাম আর ছাগলানাইয়াতে আত্মীয়ের খোঁজ করতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে ফেনী শহরে এসে আটকা পড়ে যায়।  

ঢাকা চট্টগ্রাম হাইওয়ে যানজটে স্থবির হয়ে পড়ে। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম প্লাবিত হয়ে হাইওয়েতে পানি উঠে যায়। বাড়তে থাকে স্রোত। আর রাস্তায় দেখা যায় এক্সোডাস। যারা বুঝতে পেরেছিল আগেই, তারা সবাই ফেনী থেকে বেরোবার জন্য যে যা পায় তাই নিয়ে ছুটতে থাকে ঢাকার দিকে।  

আজকের (বহস্পতিবার) রাত ক্রুশিয়াল। ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া, পরশুরামে আজকে নিয়ে দুই রাত ধরে মানুষ পানিবন্দি৷ আজকে তাদের উদ্ধার করতেই হবে। সাথে আছে ফেনী শহর। এখন বৃষ্টি নেই, কিন্তু সোনাগাজীর অবস্থাও কিছু বলা যায় না।  

পরিস্থিতি কঠিন। ব্ল্যাক আউটের কারণে মানুষ জানতেও পারছে না গত ২৪ ঘণ্টায় আসলে কী ঘটেছে এলাকাগুলোতে। অনেকের আশঙ্কা হতাহতের সংখ্যার কোনো হিসাবই হয়ত আমরা জানি না।  

তবে অটুট আছে সামাজিক বন্ধন। মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আর আছে রেজিলিয়েন্স। মানুষ হাল ছাড়ছে না। মানুষ হেরে যেতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে।  

আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমীন।

লেখক পরিচিতি: উপন্যাসিক ও চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট

news24bd.tv/আইএএম

এই রকম আরও টপিক