শ্রমবাজার বন্ধের দায় কার

এ কে এম আতিকুর রহমান

শ্রমবাজার বন্ধের দায় কার

এ কে এম আতিকুর রহমান

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য মতে, আমাদের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ২০২২ সালের জুলাই থেকে ৩১ মে পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় যেতে ইচ্ছুক পাঁচ লাখ ২৬ হাজার ৬৭৩ জন কর্মীকে অনুমতি দেয়। তাঁদের মধ্যে চার লাখ ৯৩ হাজার ৬৪২ জন কর্মীকে বিএমইটি থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ১৬ হাজার ৯৭০ জন।

মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি, যদিও এ বছরের মার্চ মাসেই মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশকে ৩১ মে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর ডেডলাইনের বিষয়টি অবহিত করেছিল। তাহলে কেন এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো? আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মধ্যে কি সমন্বয়ের অভাব ছিল? নাকি এদের কেউ আঁচ করতে পারেনি যে এ রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে? 

সহজভাবে বলতে গেলে এই বিপর্যয়ের সৃষ্টি হতো না, যদি এ বছরের মার্চ মাসে ৩১ মে কর্মী প্রেরণের ডেডলাইন জানার পরপরই বাংলাদেশ সরকারের নির্দিষ্ট দপ্তরের পক্ষ থেকে এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেত—১. যেসব রিক্রুটিং এজেন্সি মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণে সম্পৃক্ত তাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে কার কতজন কর্মীকে ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হয়েছে, কতজন ভিসা পেয়েছে, কতজন এরই মধ্যে মালয়েশিয়ায় চলে গেছেন, কতজনের ৩১ মের মধ্যে যাওয়ার টিকিট রয়েছে, কতজনের যাওয়া বাকি আছে, কতজনের এখনো ক্লিয়ারেন্স পাওয়া যায়নি, কতজনের ভিসা প্রক্রিয়াধীন ইত্যাদি তথ্য সংগ্রহ করা।

২. ৩১ মের মধ্যে ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে নিয়মিত ফ্লাইটে কতজনকে পাঠানো সম্ভব হবে সেসব তথ্য সংগ্রহ করা।

অতিরিক্ত ফ্লাইটের প্রয়োজন হলে যথাসময়ে তার আয়োজন করা, যাতে সবাই ডেডলাইনের আগেই মালয়েশিয়ায় যেতে সক্ষম হন। ৩. মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষকে আগেই জানিয়ে দেওয়া, যাতে ৩১ মের কমপক্ষে এক সপ্তাহ আগেই সবার ভিসা ইস্যু করা হয়। জানি না, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে এসব তথ্য ছিল কি না।

বর্তমান প্রযুক্তির (স্মার্ট!) যুগে এসব তথ্য সংগ্রহে রাখা খুব একটা কঠিন কাজ ছিল কি? 

যা হোক, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রবাসী কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী জানিয়েছেন, যাঁরা টাকা জমা দিয়েও যেতে পারেননি, তাঁদের টাকা অবশ্যই ফেরত দেওয়া হবে। কোন এজেন্সির মাধ্যমে কতজন টাকা জমা দিয়েছেন, সেই তালিকা করতে মন্ত্রণালয় থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া তিনি গত ৫ জুন তাঁর মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত মালয়েশিয়ার হাইকমিশনারের সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে বৈঠক করেন এবং না যেতে পারা কর্মীরা যাতে যেতে পারেন, তা বিবেচনা করার জন্য পুনরায় হাইকমিশনারকে অনুরোধ জানান। তবে মালয়েশিয়া আর সময় বাড়াবে না বলে মালয়েশিয়ার দূত জানিয়ে দিয়েছেন।

উল্লেখ্য, এর আগেও বাংলাদেশ সময় বাড়ানোর জন্য মালয়েশিয়াকে অনুরোধ করেছিল, কিন্তু তারা সময় বাড়াতে সম্মত হয়নি। ওই সময় মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাইফুদ্দিন নাসুসন ইসমাইল দেশটির সাংবাদিকদের করা প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন যে আর সময় বাড়ানো হবে না।  

শ্রমবাজার বন্ধের দায় কার৫ জুন সংসদের বাজেট অধিবেশনে এসংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর বিষয়টি যদি নিয়ম মেনে করা হতো, তাহলে সমস্যার সৃষ্টি হতো না। এখন যে সমস্যা হয়েছে, সে বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হবে। এর জন্য যদি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দায়ী থাকে, তাহলে তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে। ’ 

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশের এক শ্রেণির লোক, যারা জনশক্তির ব্যবসা করে, তারা তড়িঘড়ি করে লোক পাঠানোর চেষ্টা করে। তাদের সঙ্গে মালয়েশিয়ার কিছু লোকও সংযুক্ত আছে, যার ফলে জটিলতার সৃষ্টি হয়। প্রতিবারই যখন সরকার আলোচনা করে সমাধানে যায়, তখনই কিছু লোক ছুটে যায়, একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। যারা যায়, তাদের কাজের ঠিক থাকে না, চাকরিও ঠিক থাকে না। এটা শুধু মালয়েশিয়া না, অনেক জায়গায় ঘটে। ’

যাঁরা যেতে পারেননি, তাঁদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ কিভাবে দেওয়া হবে তার জন্য এরই মধ্যে ‘তদন্ত কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কর্মীরা কত টাকা ফেরত পেতে পারেন, তা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে আমাদের সম্ভাব্য যে দুটি চিত্রের কথা বিবেচনায় আনতে হবে তা হচ্ছে—১. মালয়েশিয়াগামী প্রত্যেক কর্মীর জন্য সরকার নির্ধারিত ফি ছিল ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা। এই টাকা থেকে যদি ভিসা ফি, স্বাস্থ্য পরীক্ষা ফি, বিএমইটির ক্লিয়ারেন্স ফিসহ আনুষঙ্গিক সব খরচ বাদ দিয়ে বাকি যা থাকবে অর্থাৎ বড়জোর ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার মতো ফেরত পেতে পারেন প্রত্যেক কর্মী। তা ছাড়া যে দালালের মাধ্যমে এজেন্সিতে কর্মীরা এসে থাকেন, তাঁদের প্রদেয় অর্থ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে ঢাকায় আসা-যাওয়াসহ অন্যান্য কারণে ব্যয়িত অর্থও ফেরত পাওয়া যাবে না।

২. বিভিন্ন সূত্রের তথ্যানুযায়ী, কর্মীদের থেকে চার থেকে ছয় লাখ টাকার মতো নেওয়া হয়েছে। এর মধ্য থেকে ক. মালয়েশিয়ার কম্পানিগুলো থেকে চাহিদা জোগাড় ও ওই দেশের কর্তৃপক্ষের অনুমোদনসহ অন্যান্য কাজের খরচ বাবদ মালয়েশিয়ার পক্ষকে প্রদেয় অর্থ, খ. সিন্ডিকেটের চাঁদা, গ. ভিসা ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা ফি, ঘ. কর্মী সংগ্রহের জন্য স্থানীয় দালালদের প্রদেয় অর্থ, ঙ. প্রেরণকারী এজেন্সির প্রাপ্য অর্থ, চ. বিমানভাড়া এবং ছ বিএমইটিকে ছাড়পত্র বাবদ প্রদেয় ফিসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ মেটানো হয়। এখানে প্রেরণকারী এজেন্সির প্রাপ্য অর্থ এবং বিমানভাড়া ছাড়া অন্য সব ব্যয় পরিশোধ করা হয়েছে বিধায় ব্যয়িত সম্পূর্ণ অর্থ ফেরত পাওয়ার সুযোগ নেই। যে অর্থ পরিশোধ করা হয়নি অর্থাৎ এজেন্সির প্রাপ্য অর্থ এবং বিমানভাড়ার অর্থই ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।   

প্রশ্ন হচ্ছে, এই কর্মীদের টাকা কিভাবে ফেরত দেওয়া হবে? তাঁরা কি এজেন্সিকে পরিশোধিত সব টাকা ফেরত পাবেন? তাঁরা কিভাবে প্রমাণ করবেন যে কত টাকা তাঁরা এজেন্সিকে দিয়েছেন? তাঁদের কাছে কোনো প্রমাণ (টাকা প্রদানের রসিদ) আছে বলে মনে হয় না। একজন কর্মী চার, পাঁচ বা ছয় লাখ টাকা দিয়ে থাকলেও কোনো প্রমাণ না থাকার কারণে তাঁদের মৌখিক দাবির সত্যতা এজেন্সিগুলো মেনে নেবে কি? যেহেতু সম্পূর্ণ অর্থই নগদ পরিশোধ করা হয়েছে, তাই ব্যাংক বা কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের রসিদও কর্মীদের কাছে থাকার কথা নয়। আর এজেন্সিগুলো স্বীকার না করলে সরকারের পক্ষে সেই অর্থ আদায় করা কখনোই সম্ভব হবে না। সুতরাং অর্থ ফেরত প্রদানের ক্ষেত্রে যেটি এজেন্সির কাছে গ্রহণযোগ্য হবে, সেটি হচ্ছে ওপরে বর্ণিত প্রথম চিত্রটি।

আসলে আমাদের কর্মীদের বিদেশে পাঠানোর পদ্ধতিতেই গলদ রয়েছে। সেটি ঠিক না করলে এসব অব্যবস্থাপনা বা কর্মীদের শোষণ চলতেই থাকবে। সরকার নির্ধারিত অর্থের মধ্যে কর্মী প্রেরণ নিশ্চিত করতে হলে যে পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে, তা যত দিন না করা হবে, তত দিন এ ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে না। আমার জানা মতে, সরকার নির্ধারিত অর্থে কর্মী প্রেরণ নিশ্চিত করা খুবই সহজ একটি কাজ, যদি আমাদের কর্তৃপক্ষ এবং এজেন্সিগুলোর সদিচ্ছা থাকে। মূলত আমরা আমাদের কর্মীদের কল্যাণের কথা কেউ ভাবি না—না সরকার, না এজেন্সিগুলো। সত্য হলো, তদন্ত কমিটি তার প্রতিবেদন দেবে, ক্ষতিগ্রস্ত কর্মীদের নয়ছয় করে বুঝিয়ে দেবে, আবার সেই একই নিয়মে সবাই ফিরে আসবেন। আমরা বুঝি, কিন্তু আত্মশুদ্ধি করি না।  

পরিশেষে যে কথাটি না বললেই নয়, এই অর্থের বড় অংশ অর্থাৎ ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকার অতিরিক্ত যে অর্থ, তার কোনো স্বীকৃত হিসাব না থাকায় পুরো অর্থই ‘কালো টাকার’ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। সেই টাকা দেশের ভেতর লুকিয়ে থাকুক বা পাচার হয়ে বিদেশের কোনো হিসাবের খাতায় অন্তর্ভুক্ত হোক, তার কথা সবাই ভুলে যায়। আমাদের সরকার ওই অর্থের হদিস কোনো সময় করেছে বলে মনে হয় না, ভবিষ্যতেও করার কথা চিন্তা করছে কি না, তা-ও জানি না। হাজার হাজার কোটি টাকা এভাবেই দেশ থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে সরকারের সঠিক পরিকল্পনার অভাবে বা অজ্ঞতায়। ওই অর্থ এ দেশের গরিব কর্মীদের শোষণ করে সংগৃহীত অর্থ, এমনকি যা এজেন্সিগুলোর আয়করের নথিতেও আসে না। আমরা অনেক কথাই বলি, যেসবের সঙ্গে আমাদের কাজের কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায় না। এতে শেষতক দেশের ক্ষতি হয়, জনগণের দুর্ভোগ বাড়ে। আর সেই ফাঁকে কিছু লোক নির্বিঘ্নে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে নেয়। কারো কোনো দায় থাকে না।

লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব
news24bd.tv/আইএএম