রাসেলস ভাইপার আসছে-চলে যাবে, মানবরূপী সরীসৃপ তাড়াবে কে?

সোহেল সানি

রাসেলস ভাইপার আসছে-চলে যাবে, মানবরূপী সরীসৃপ তাড়াবে কে?

সোহেল সানি

রাসেলস ভাইপার এসেছে, একটা সময় হারিয়ে যাবে এটাই প্রকৃতি। কিন্তু রাষ্ট্র-সমাজের মানবরূপী যে সরীসৃপের উত্থান ঘটেছে, যারা যুগ যুগ ধরে সাধারণ মানুষকে দংশন করছে, রক্ত চুষে খাচ্ছে, তাদের তাড়াবে কে? ত্রিশ লাখ শহীদের জীবন এবং দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমে কেনা স্বাধীন বাংলাদেশে এদের দৌরাত্ম্য মেনে নেওয়া যায় না। এদের কেউ ছোবল মেরে রাষ্ট্রমুণ্ডুকেই কতল করতে চায়, আবার কেউ সম্পদ লুট করে রাষ্ট্রকেই দেউলিয়া বানিয়ে দেয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাসেলস ভাইপার সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন, ভালো মানুষকে সাপ কামড়ায় না, আঘাত করলেই কেবল কামড় দেয়।

গত মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে প্রসঙ্গটির অবতারণা করেন চ্যানেল আইর অনত্যম কর্ণধার শাইখ সিরাজ। এ মুহূর্তে আমার ইতিহাস পাঠের একটি পর্বের কথা মনে পড়ছে। আওয়ামী লীগের প্রথম ম্যানিফেস্টোতে বলা হয়েছিল, ‘সাম্রাজ্যবাদী-সরীসৃপের ফোঁসফোঁস শব্দ সমাজের আনাচে-কানাচে সর্বত্র শোনা যাইতেছে-সেই ফোঁসফোঁস শব্দ যেন এই যুগের সংগীত। আমাদের কওমি প্রতিষ্ঠান আওয়ামী মুসলিম লীগ এই সরীসৃপের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাইয়া তাদের বিষদাঁত উৎপাটন করিতে বদ্ধপরিকর।

কালক্রমে মেনিফেস্টো থেকে কথাগুলো উধাও হয়েছে। কিন্তু সরীসৃপের সেই ফোঁসফোঁস এখনো আওয়ামী লীগ শুনতে পায়? প্রধানমন্ত্রী মাঝেমধ্যেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সার্বভৌমত্বের জানান দেন। নির্বাচন নিয়ে যখন তুমুল ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত চলছিল, তখনো বঙ্গবন্ধুকন্যা সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে কঠোর শব্দবাক্য উচ্চারণ করেছেন।

আওয়ামী লীগকে ২৩ বছর সংগ্রাম করে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটাতে হয়েছে। কিন্তু সেই সাম্রাজ্যবাদী সরীসৃপের লালনপালনে প্রাসাদের ভিতরেও একদল ঘাতক বেড়ে উঠেছিল, যাদের হাতে জাতির পিতাকে সপরিবারে জীবন দিতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সেই সরীসৃপের বিস্তার ঘটেছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতেও। দীর্ঘ সংগ্রাম করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল রূপে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু প্রশাসনে, সমাজের আনাচে-কানাচে সব সরীসৃপের বিষদাঁত ভেঙে দেওয়া কি সম্ভব হয়েছে?

সম্ভব হলে জাতিকে বেনজীর, আসাদুজ্জামান মিয়াদের দুর্নীতির মরণকামড় খেতে হতো না। দেখতে হতো না মতিউরের ‘ছাগল কাণ্ড’। যখন বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের মুখোশ একটার পর একটা উন্মোচিত হচ্ছে, তখন জলজঙ্গল থেকে উঠে আসা রাসেলস ভাইপারের উপদ্রব দেখে কী হবে? রাষ্ট্র-সমাজের এসব সরীসৃপ জনগণের রক্ত চুষে খাচ্ছে, অনুসন্ধান করা হলে আমলাতন্ত্রের ভিতরে এরকম লাখো বেনজীর-আসাদুজ্জামান-মতিউরের দেখা মিলবে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মানবরূপী সরীসৃপের বিস্তার কতটা হয়েছিল, তা তো জাতি খন্দকার মোশতাক গংয়ের উত্থানেই দেখতে পেয়েছে। পূজামণ্ডপে সাপকে যেমন দুধকলা দিয়ে পোষা হয়, তেমনিভাবেই বঙ্গবন্ধু খন্দকার মোশতাকদের পুষেছিলেন। একবারও কি বঙ্গবন্ধুর মনে উদয় হয়েছিল যে, এই মোশতাক বিষধর সাপ হয়ে তাকে এবং তার পরিবারকে মরণ ছোবল বসাবে? মোশতাকের চেয়ে তার মন্ত্রিসভার সদস্যরাই কম কীসে? তারাও তো বঙ্গবন্ধুর ছায়ায় থেকে ফুলেফেঁপে উঠছিলেন, বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। কিন্তু তারাই বঙ্গবন্ধুর লাশ রেখে মোশতাকের মন্ত্রিত্ব গ্রহণই শুধু নয়, খুনি ফারুক-রশীদের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত ছিলেন। এই সরীসৃপরাই স্বাধীনতার চেতনা ও মূল্যবোধ ধ্বংস করার জন্য মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের চার নেতার জীবন কেড়ে নেয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার বেনিফিটটা আসলে হত্যাকারীও নিতে পারেনি বরং পুরোপুরি নিয়েছেন জেনারেল জিয়া। সেই সূত্র ধরেই তো বিএনপি, বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমানের রাজনীতি। স্বভাবতই এটা তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে বলেই বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকার সহ্য করতে পারে না।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টা তাদের হীন চিন্তার ফলশ্রুতি। তিনি ১৯ বার মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছেন। বিরোধী মহল থেকে হুমকি-ধমকি কম শোনা যায়নি গত ১৫ বছরে। তারিখ নির্ধারণ করেও উৎখাতের আলটিমেটাম শোনা গেছে। যেমন- বিএনপির ‘১০ ডিসেম্বর তত্ত্ব’। তাতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ইন্ধন ছিল বলে কিছুটা গন্ধও পাওয়া যাচ্ছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিশেষ করে ইউটিউবের পর্দায় মাঝেমধ্যে লাইভে একজনকে দেখা যায়। সে নিতান্ত হুজুগবাজ। মানসিক ব্যাধির মতো একটা ক্ষমতার মোহ তার মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। নিজের ক্ষমতা সম্বন্ধে ধারণা বাস্তবতার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। দলটি ছেড়ে চলে গেছেন অনেকেই যারা তার পিতার সাহচর্যে বেড়ে উঠেছিলেন। আর এখন যারা নেতা রয়েছেন, তারা কতগুলো খড়ের তৈরি দুর্বল মানুষ মাত্র। এখন তাদেরও বিতাড়িত করা হচ্ছে।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট লোকটির ত্রাস সঞ্চারকারী জিঘাংসা ও ক্রোধের জোর সফল হতে পারেনি। ২৪টি লাশ পড়েছে। হামলার মূল টার্গেট তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে যান। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকেই আগস্টকে ফের রক্তাক্ত করার ঘোষণা নতুন নয় বরং বারবার উচ্চারিত হয়েছে। তাই ভয়-আশঙ্কাটা থেকেই যায়। এ প্রেক্ষিতে প্রশ্ন একটিই, আমরা কি বিশ্বাস করতে পারি যে, প্রধানমন্ত্রীর চারপাশে এখন আর কোনো সরীসৃপ নেই? যদি না থাকে, আলহামদুলিল্লাহ।

লেখক : সহকারী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন