দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’

ড. সুলতান মাহমুদ রানা

দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’

ড. সুলতান মাহমুদ রানা

দেশের উন্নয়ন প্রসঙ্গে কারো কোনো দ্বিমত নেই। চলমান এই উন্নয়ন আরো ত্বরান্বিত হতে পারে সর্বস্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। আর এ কারণেই সুশাসন প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলাই সরকারের অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে সামনে রয়েছে। এখন সবার মনে একটিই প্রশ্ন, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকার কি সফল হতে পারবে? এমন প্রশ্নের উত্তর পেতে একটু সময় লাগবে।

বিগত সাড়ে ১৫ বছরে সরকারের উন্নয়নের মাত্রার দিকে লক্ষ করলে সফলতার বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য দিক আমাদের চোখে পড়ে। ব্যর্থতা কিংবা ভুল যে থাকবে না, তা নয়। তবে ব্যর্থতা এবং ভুলকে মাথায় নিয়েই সরকার বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ যথাযথভাবে মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে বলে সবার প্রত্যাশা রয়েছে।
সফলতা থাকলে, ব্যর্থতা থাকবে—এটাই স্বাভাবিক।

তবে প্রত্যাশা হলো, বিগত সময়ের ভুলত্রুটি শুধরে সরকার সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। জনগণ সরকারের কাছে চায় স্বাধীনতা, সহযোগিতা ও শান্তি-শৃঙ্খলার মধ্যে বাঁচার ন্যূনতম অধিকার এবং নির্বিঘ্নে চলাফেরা ও কাজকর্মের সুযোগ এবং নিজেদের মেধা-মননশীলতা ও যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে আত্মপ্রকাশ ও বিকাশের নিশ্চয়তা।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’প্রধানমন্ত্রী নিজে দল এবং সরকার তথা শাসনব্যবস্থাকে শুদ্ধ করতে হার্ডলাইনে রয়েছেন। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা যতই শক্তিশালী হোন না কেন, প্রধানমন্ত্রীর তাঁদের বিষয়ে আপস নেই।

সাম্প্রতিক সময়ে যেসব সরকারি কর্মকর্তার বিষয়ে গণমাধ্যমে দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে, তাঁদের বিষয়ে সরকার যথেষ্ট সচেতন রয়েছে। এ থেকে অনুমান করা যায় যে সরকার দুর্নীতির বিষয়ে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে অটল রয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবিসংবাদিত নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই সুশাসন এবং সোনার বাংলা বিনির্মাণের প্রচেষ্টা যথাযথভাবে শুরু হলেও তা থমকে গিয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালি চেতনার পরিপন্থী ঘাতকচক্র ও তাদের দেশি-বিদেশি দোসররা জাতির সে স্বপ্ন ভেঙে দেয়।

বৈষম্যহীন, সমতাভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী চেতনার আলোকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের প্রত্যাশার বিপরীতে প্রতিষ্ঠিত হয় ধর্মীয় লেবাসে একটি সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের সমন্বয়ে লুটেরা, ধনিক ও বণিক শ্রেণির স্বার্থকেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। সাধারণ জনগণ এই অপরাজনৈতিক সংস্কৃতির হাতে নির্যাতিত ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ১৯৯০ সালের গণ-আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রত্যাশায় তিন জোটের রূপরেখার ভিত্তিতে জনগণের ব্যাপক আশা-আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়। কিন্তু জনগণের যথাযথ প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয় তৎকালীন বিএনপি সরকার। পরে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে ১৯৯০ সালের সম্পাদিত তিন জোটের রূপরেখা বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হয়। কিন্তু সে যাত্রায়ও অপূর্ণতা থেকে যায়। অনেক ক্ষেত্রেই সফল হয়েছে আবার বেশ কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থতাও আছে।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে একটি বৃহৎ ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের নির্বাচন বর্জনের প্রেক্ষাপটেও জনগণ বর্তমান সরকারকে ভোট দেয়। বিরোধী দলের নানা বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে নির্বাচিত করেছে বর্তমান সরকারকে। কাজেই জনপ্রত্যাশার মাপকাঠিও এসব বাধা-বিপত্তির ঊর্ধ্বে, যদিও ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সরকার জনগণের কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে না।

নিশ্ছিদ্রভাবে সরকারের যাত্রা অক্ষুণ্ন রাখতে নির্বাচনী ইশতেহারে বর্ণিত প্রতিশ্রুতি রক্ষায় তৎপর থাকার বিকল্প নেই। ক্ষমতার পালাবদলের বাস্তবতাকে স্মরণ করে সরকারকে দেশে অপরাধ ও লুটপাটের  সংস্কৃতির পরিবর্তে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী থাকতে হবে। সংকীর্ণ দলীয় আনুগত্যের বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে যোগ্যতা ও দক্ষতার দিকে নজর রাখার বিকল্প নেই। একই সঙ্গে দেশের সব নাগরিকের সরকারে অংশগ্রহণের প্রক্রিয়াকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। মন্ত্রিসভা মানুষের জন্য কাজ করবে, দেশের সেবা করবে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকরের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হবে। একই সঙ্গে তৃণমূল রাজনীতিকেও শক্তিশালী না করলে চলবে না।

আমরা জানি, রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় আসে, ক্ষমতা থেকে যায়। আর এই ক্ষমতায় আসা এবং ক্ষমতায় থাকার মানদণ্ড হলো জনগণের পূর্ণ সমর্থন। জনগণের সমর্থনের ঘাটতি হয় এমন আচরণ কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা তাদের অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতাদের থাকা উচিত নয়। তবে অনেক ক্ষেত্রে রাতারাতি অনুপ্রবেশকারী সুবিধাবাদীদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাজনৈতিক দলের ভাবমূর্তি। সেদিকেও বিশেষ লক্ষ রাখা দরকার সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর। সাধারণ মানুষের অফিস-আদালতের সব কাজ স্বাভাবিকভাবে হওয়ার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিশ্চিত করার বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। এর জন্য যেন কারো কাছে ধরনা দিতে না হয়, তদবির করতে না হয়, স্পিড মানি দিতে না হয়। এসব বিষয় সাধারণ জনগণের জন্য নিশ্চিত করতে পারলেই সুশাসন ত্বরান্বিত হতে পারে। প্রয়োজনে সাধারণ মানুষ গঠনমূলক সমালোচনা করতে পারে।

প্রধানমন্ত্রীর একার পক্ষে প্রশাসনের সব স্তরে মনিটরিং রাখা সম্ভব নয়। এ জন্য সর্বস্তরের রাজনৈতিক দল, বিশেষত বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠনগুলো এবং জনগণকে গঠনমূলক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। বিশেষ করে স্বাধীন সত্তা হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলোকে ভূমিকা পালন করতে হবে। কোনো বিদেশি শক্তির লেজুড়বৃত্তি করলে কোনোভাবেই দেশের মঙ্গলে রাজনৈতিক কর্মসূচি নির্ধারণ করা সম্ভব হবে না। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও প্রশাসনকে অবশ্যই দলনিরপেক্ষ ও পেশাদারি মানসিকতা নিয়ে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি—সব কিছু ন্যায্যতা, যোগ্যতা, মেধা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে হতে হবে, দলীয় কোনো আনুগত্যের ভিত্তিতে নয়।

সংসদীয় ব্যবস্থার মূল কেন্দ্র ‘জাতীয় সংসদ’কে কার্যকর করতে হবে। শুধু কথায় নয়, কাজে প্রমাণ দিতে হবে। সব বিষয়েই বিরোধী দলের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। সংসদকে আলোচনা ও সমাধানের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্পিকারকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সংসদ কার্যকর না হলে জনপ্রত্যাশা পূরণের মূল জায়গাটিও ব্যর্থ হিসেবে বিবেচিত হয়। সংসদ কার্যকর রাখতে বিরোধী দলের উপস্থিতির গুরুত্ব অনেক বেশি। এতে আসন যতই কম হোক না কেন, সেটি কোনো বিষয় না। সংসদে বিরোধী দলের নিয়মিত উপস্থিতি সংসদ কার্যকর হওয়ার মূল চাবি। সংখ্যা বিচারে নয়, বিরোধী দলকে সংসদীয় কাঠামো অনুযায়ী যথাযথ সাংবিধানিক মর্যাদার ভিত্তিতেই মূল্যায়ন করা সরকারের কর্তব্য। জনগণ গতানুগতিক রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি থেকে নিজেদের মুক্ত করতে চায়। গঠনমূলক রাজনীতি, দেশ গড়ার রাজনীতি, ঐক্য আর সহযোগিতার রাজনীতিই সবার কাম্য।

লেখক : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

sultanmahmud.rana@gmail.com

news24bd.tv/আইএএম