বাতিল করা কোম্পানিকেই কাজ দিতে তোড়জোড়

মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র।

মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা আমদানি

বাতিল করা কোম্পানিকেই কাজ দিতে তোড়জোড়

অনলাইন ডেস্ক
  • প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অভিযোগ
  • দরপত্র প্রক্রিয়ায় আদর্শমানের ঘাটতি দেখছে আইএমইডি
  • বাতিলকৃত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নেগোশিয়েশন ক্রয় নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন- টিআইবি
  • পুনরায় দরপত্র দেওয়ার আহ্বান ক্যাবের

মহেশখালীতে অবস্থিত মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কয়লা সরবরাহের দরপত্র প্রক্রিয়ায় বাতিল হওয়া এক প্রতিষ্ঠানকেই কাজ দিতে তোড়জোড় শুরু করেছে প্রকল্পটি বাস্তবায়নকারী রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (সিপিজিসিবিএল)। সম্প্রতি দরপত্র প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অভিযোগ জমা দিয়েছেন দরপত্রে অংশ নেওয়া একটি আন্তর্জাতিক কনসোর্টিয়াম।

গত বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব বরাবর পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, দরপত্রে অংশ নেওয়া চারটি কনসোর্টিয়ামের আর্থিক প্রস্তাবনা মূল্যায়ন না করেই সবাইকে বাতিল ঘোষণা করা হয়। চলমান দরপত্রটিতে বাছাই প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ উল্লেখ করে চিঠিতে আরও বলা হয়, বাতিলকৃত একটি আর্থিক প্রস্তাবনাকে পুনর্বহাল করার জন্য সংশ্লিষ্ট কিছু কর্মকর্তা ও কতিপয় বোর্ড সদস্য সংঘবদ্ধভাবে বিশেষ কোম্পানিটির সঙ্গে অবৈধ ভাবে দেশের প্রচলিত আইন ও বিধিমালা অমান্য করে গত ৫ জুন বিকালে নেগোশিয়েশন মিটিং (সমঝোতা সভা) করে।

যা সম্পূর্ণ অনৈতিক ও অবৈধ।

সভা সূত্রে জানা গেছে, সিপিজিসিবিএল-এর কিছু কর্মকর্তা দরপত্র প্রক্রিয়ার অনিয়ম নিয়ে কথা বললেও একটি চক্র প্রকল্পের বিনিয়োগকারী সংস্থা ‘জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থার (জাইকা)’ কাছে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্নের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, যে প্রক্রিয়ায় কয়লা আমদানির কাজ দেওয়া হচ্ছে সেটি রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি এবং বিদেশি বিনিয়োগ পরিবেশের জন্য খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করবে। ওই নেগোশিয়েশনের (সমঝোতা) মাধ্যমে ব্যক্তিগত লাভবান হওয়ার লক্ষ্যেই বাতিলকৃত কোম্পানিকে কাজ দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে।

এদিকে গত এপ্রিলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পের কয়লা আমদানির দরপত্র প্রক্রিয়ায় আদর্শমান বজায় রাখা হয়নি জানিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব বরাবর একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। সরকারি নিরীক্ষণ প্রতিবেদন উপেক্ষা করে প্রকল্প কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থে ‘পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে’ নিয়মবহির্ভূতভাবে কাজ দেওয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে সূত্রে জানা গেছে।  

এ বিষয়ে দুর্নীতি বিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘যারা কয়লা সরবরাহের প্রস্তাব দিয়েছে, তাদের চার প্রতিষ্ঠানকেই যদি বাতিল করা হয়ে থাকে, তাহলে এর পিছনে সুনির্দিষ্ট এবং যৌক্তিক কারণ ছিল। যে কোনো যুক্তিতে হয়তো তাদের দরপত্র বাতিল করা হয়েছে। বাতিল হওয়া কোনো একক কোম্পানির সঙ্গে যদি নেগোশিয়েশন (সমঝোতা) করা হয়, তাহলে এটা ক্রয় নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। আন্তর্জাতিক মানদন্ডেও বাতিল করা কোম্পানির সঙ্গে এমন নেগোশিয়েশন গ্রহণযোগ্য নয় বলেও মনে করেন টিআইবির প্রধান।

ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, কয়লা সরবরাহের দরপত্রে অংশগ্রহণকারীদের বাতিল করে আবার তার মধ্য থেকে কোনো একক কোম্পানিকে কাজ দেওয়ার চেষ্টা করা হলে সেখানে সন্দেহের অবকাশ আছে। কোন যোগসাজেশ এবং অনিয়মের মাধ্যমে ‘বিশেষ মহলকে’ সুবিধা দেওয়ার জন্য এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে, এমন প্রশ্ন ওঠা যৌক্তিক। কাজেই এমন পদক্ষেপ থেকে সরে আসা উচিত। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে পুনরায় দরপত্র আহ্বান করে, তার ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ হবে কোন প্রতিষ্ঠানকে কয়লা সরবরাহের কাজ দেওয়া হবে। ’ কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, ‘যে কোনো কারণেই বাতিল হোক না কেন নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে বাতিলকৃতদের মধ্য থেকে একটি প্রতিষ্ঠানকে কোনোভাবে বৈধ করার এখতিয়ার নেই। এখন তাদেরকে যে প্রক্রিয়ায় কাজ দেওয়া হচ্ছে, এটা নিজেদের ক্ষমতাবলে দিচ্ছে। যার এখতিয়ার তাদের নেই। পুনরায় দরপত্র আহ্বান করে সব মানদন্ড যেসব কোম্পানি পূরণ করতে পারবে, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি তাদের যোগ্য বলে বিবেচনা করবে। ’

বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, মহেশখালীতে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রেটির দ্বিতীয় ইউনিটের বাণিজ্যিক উৎপাদন চলতি মাস থেকে শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। জাপানের আর্থিক সহায়তায় নির্মিত দুই ইউনিটের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর পর দ্বিতীয় ইউনিটও পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করেছে। গত বছর ২৪ ডিসেম্বর থেকে দ্বিতীয় ইউনিটের পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হলেও প্রথম ইউনিটের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়েছে একই মাসের ২৬ তারিখ থেকে।

দরপত্রে অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর সূত্রে জানা গেছে, দরপত্রপ্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী দেশি-বিদেশি চার প্রতিষ্ঠান যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রস্তাবনা দাখিল করলেও ‘আর্থিক সক্ষমতা নেই’ অজুহাতে প্রথমেই তিন প্রতিষ্ঠানকে বাদ দেওয়া হয়। পরে গত ২৭ মে কারিগরি কমটির সভায় চারটি কনসোর্টিয়ামের সবগুলোর আর্থিক প্রস্তাবনা বাতিল করা হয়। সর্বশেষ ৩১ মে সিপিজিসিবিএলের বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জাতীয় গুরুত্ব বিবেচনায় বাতিল করা ইউনিক সিমেন্ট কনসোর্টিয়ামকে নিয়ে সমঝোতা করার অনুমোদন দেওয়া হয়।

অবশ্য প্রকল্প কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতায় বাতিল হওয়া তিন কনসোর্টিয়ামের একটি গত ২৯ মে বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব বরাবর দরপত্র পুনর্মূল্যায়নের জন্য আবেদন করে। কিন্তু এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি কোনো উত্তর পায়নি।

প্রাথমিক শর্তানুযায়ী, দরপত্রে কমপক্ষে ১২ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা আমদানির অভিজ্ঞতার শর্ত উল্লেখ ছিল, যা কয়লা আমাদানি সংশ্লিষ্ট দরপত্রের জন্য একটি প্রাসঙ্গিক শর্ত। কিন্তু একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই শর্ত শিথিল করে ১২ মিলিয়ন মেট্রিক টন লোহা, সার, কেমিক্যাল, সিমেন্ট অথবা খাদ্যশস্য আমদানির অভিজ্ঞতাকে যোগ্যতা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা একটি অসম প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করেছে।

news24bd.tv/DHL