সিগারেটে কার্যকর করের প্রস্তাব

ড. আতিউর রহমান

বিশেষজ্ঞদের বাজেট পর্যবেক্ষণ 

সিগারেটে কার্যকর করের প্রস্তাব

ড. আতিউর রহমান

প্রতিবছরের মতো এ বছরও ৩১ মে পালিত হচ্ছে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘তামাক কম্পানির হস্তক্ষেপ প্রতিহত করি, শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করি’ (Protecting children from tobacco industry interference) । এই প্রতিপাদ্যটি বাংলাদেশের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, যদিও বাংলাদেশে তামাকের ব্যবহার খানিকটা কমেছে, তবে তরুণদের এই আসক্তি থেকে পুরোপুরি দূরে রাখা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ (২০১৭ সালের) তথ্য মতে, ১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সীদের মধ্যে ১৪ শতাংশ সিগারেট ব্যবহার করছে।

এ ছাড়া পরোক্ষ ধূমপানের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ৩৯ থেকে ৪৪ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক। আর প্রতিবছর তামাক ব্যবহারজনিত কারণে অকালে প্রাণ হারাচ্ছে এক লাখ ৬১ হাজার মানুষ। সিগারেট ব্যবহারের বিচারে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। ফলে আগামী প্রজন্মকে তামাকের প্রভাব থেকে রক্ষা করার জন্য বিশেষ পদক্ষেপ একান্ত জরুরি।

বিশ্বব্যাপী কিশোর-তরুণদের তামাকের প্রভাব থেকে সুরক্ষিত করার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা হয় তামাক কম্পানির বিভিন্ন অপপ্রচারমূলক তৎপরতাকে। সমাজে তামাকবিরোধী সচেতনতার কল্যাণে সারা বিশ্বেই বিগত দুই দশকে তামাক ব্যবহারের হার কমেছে। বাংলাদেশেও কমেছে। তবে সমাজকে পুরোপুরি তামাকমুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না অনেক ক্ষেত্রেই।

তামাক কম্পানিগুলো তাদের ক্ষতিকারক পণ্য বাজারজাত করা অব্যাহত রাখতে নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। তাদের বিভিন্ন অপপ্রচারে প্রভাবিত হয়ে কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না নীতিনির্ধারকরা। বাংলাদেশেও এমন নজির রয়েছে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১৬ সালেই নির্দেশনা দিয়েছেন যে তিনি ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত দেশ গঠন করতে চান। পরবর্তীকালে প্রতিবছরের জাতীয় বাজেটে আমরা সিগারেটের দাম একটু একটু করে বাড়তে দেখছি।

আপাতদৃষ্টিতে প্রতিবছর সিগারেটের দাম বাড়ানোর এই উদ্যোগকে একটি যথাযথ পদক্ষেপ মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা এ ক্ষেত্রে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না।
সিগারেটে কার্যকর করের প্রস্তাবপ্রতিবছরই সংসদে বাজেট প্রস্তাব উত্থাপনের আগে ও পরে সিগারেটের দাম বাড়ানোর ফলে সিগারেটশিল্পের ওপর চাপ পড়ার কথা বলতে শোনা যায় সিগারেট কম্পানিগুলোকে। আদতে বাজেটে যে মাত্রায় সিগারেটের দাম বাড়ানো হয়, তা খুব একটা কার্যকর নয়। কারণ সিগারেটের দাম বাড়ানোকে বিচার করতে হবে মূল্যস্ফীতির আলোকে। সবচেয়ে সস্তা যে সিগারেট, অর্থাৎ নিম্নস্তরের সিগারেট বাজারে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় (মোট বিক্রির ৭০ শতাংশের বেশি)। সর্বশেষ পাঁচ অর্থবছরে এই স্তরের সিগারেটের ১০ শলাকার এক প্যাকেটের দাম ৩৭ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ দাম বেড়েছে ২২ শতাংশ। সিগারেট কম্পানিগুলো এই দাম বাড়ানোকে বড় করে দেখাতে সচেষ্ট রয়েছে। কিন্তু সত্য হলো, আদতে সিগারেট এতে আরো সহজলভ্য হয়েছে। একটু ব্যাখ্যা করা যাক। একই সময়ের ব্যবধানে সিপিআই মূল্য সূচক বেড়েছে ৩২ শতাংশ। অর্থাৎ গড়ে পাঁচ বছর আগে ১০০ টাকায় যে পণ্য পাওয়া যেত, এখন তার দাম ১৩২ টাকা। অথচ আগে ১০০ টাকায় যে পরিমাণ নিম্নস্তরের সিগারেট পাওয়া যেত, এখন সে পরিমাণের জন্য দাম দিতে হচ্ছে ১২২ টাকা। অর্থাৎ গড়ে অন্যান্য পণ্যের তুলনায় সিগারেটের দাম (১৩২-১২২) = ১০ শতাংশ কম বেড়েছে। অর্থাৎ নিম্নস্তরের সিগারেট বরং সহজলভ্য হয়েছে। আর নিম্নস্তরের সিগারেট সবচেয়ে সস্তা হওয়ায় কিশোর-তরুণ এবং কম আয়ের মানুষ প্রধানত এই স্তরের সিগারেটই ব্যবহার করে থাকে।

সাধারণভাবে সিগারেট কম্পানির বাজারজাতকরণের নতুন নতুন কৌশলকেই তাদের দিক থেকে ‘হস্তক্ষেপ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু কার্যকরভাবে দাম বাড়ানো না হলেও বেশি দাম বাড়ানো হচ্ছে বলে যে দাবি সিগারেট কম্পানিগুলো করে থাকে, সেটিও তাদের একটি বড় কৌশল। এর ফলে আমাদের নীতিনির্ধারকরা বিভ্রান্ত হন। তাই এবারের আন্তর্জাতিক তামাকমুক্ত দিবসে আপাতদৃষ্টিতে দাম না বাড়িয়ে কার্যকরভাবে সিগারেটের দাম বাড়ানোর প্রত্যয় ঘোষণা করতে হবে সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনকে।

আসন্ন অর্থবছরের বাজেটে সিগারেটের দাম কার্যকরভাবে বাড়ানোর প্রস্তাব রেখেছে দেশের তামাকবিরোধী নাগরিক সংগঠনগুলো। দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ গবেষকদের সঙ্গে নিয়েই তারা প্রস্তাব রেখেছে। এই প্রস্তাবে নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম ৩৩ শতাংশ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে (১০ শলাকার এক প্যাকেটের দাম ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৬০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে)। অর্থাৎ প্রস্তাবটি বাস্তবায়িত হলে বছরের গড় মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ বা তার বেশি হলেও নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম বাড়ানো মূল্যস্ফীতির চেয়ে বেশি হবে। ফলে নিম্নস্তরের সিগারেটের সহজলভ্যতা কমবে। মধ্যম, উচ্চ ও প্রিমিয়াম স্তরের সিগারেটের দামও যথাক্রমে ১৯, ১৫ ও ১৩ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

সিগারেট কম্পানির দিক থেকে নিয়মিত আরেকটি যে অপপ্রচার করা হয়ে থাকে তা হলো সিগারেটের দাম বেশি বাড়ানো হলে সিগারেট বিক্রি কমবে এবং সিগারেট বিক্রি থেকে সরকার যে রাজস্ব পায়, তা-ও কমবে। যেহেতু কর আয় বৃদ্ধি নিয়ে এ মুহূর্তে আমাদের ওপর চাপ রয়েছে, তাই এই অপপ্রচারেও অনেকে বিভ্রান্ত হতে পারে। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলে সিগারেটের দাম উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়িয়ে সেই বিক্রয়মূল্যের ওপর বেশি বেশি করারোপ করা গেলে সিগারেটের বিক্রি কমলেও ওই বিক্রি থেকে আগের থেকে বেশি কর আদায় করা সম্ভব। এ কারণেই এ বছর নিম্নস্তরের সিগারেটের ওপর সম্পূরক শুল্ক ৫৭ থেকে বাড়িয়ে ৬৩ শতাংশ করার কথা বলা হয়েছে। এতে কার্যকর মাত্রায় দাম বাড়ানোর পরও নিম্নস্তরের সিগারেট বিক্রি থেকে সরকার আগের তুলনায় বেশি কর পাবে। অন্যান্য স্তরের সিগারেটগুলোর ওপর প্রযোজ্য কর হার বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়নি। তবে সেগুলোর বিক্রয়মূল্য যেহেতু উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে, তাই ওই সিগারেট বিক্রি থেকে পাওয়া মোট করও বাড়বে। মোট হিসাবে আগের বছরের তুলনায় ২৮ শতাংশ বেশি (১০ হাজার কোটি টাকা বেশি) কর আদায় করা সম্ভব হবে। আর তার চেয়েও বড় কথা হলো, এতে সিগারেটের ব্যবহার কমবে, কিশোর-তরুণরা ধূমপান শুরু করা থেকে বিরত হবে এবং অনেক অকালমৃত্যু ঠোকানো যাবে।

বাংলাদেশে সিগারেটের বিস্তার ঠেকাতে করারোপের পাশাপাশি তার উৎস যেতে হবে। আর তখনই তামাক উৎপাদনের কথাটি এসে যায়। স্বীকার করতেই হবে যে তামাক চাষকে এরই মধ্যে কঠিন করে তোলা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তামাক চাষে যেন সহজ শর্তে ঋণ সরবরাহ না হয়, তা নিশ্চিত করতে আমি সক্ষম হয়েছিলাম। তাই ২০১২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে বিশেষ সম্মাননার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইতিবাচক ভূমিকার স্বীকৃতি দিয়েছিল। গণপরিবহনে ধূমপান নিষিদ্ধকরণ ও এ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরির জন্য এ বছর এই স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে আমাদের রেল মন্ত্রণালয়। ফলে বলা চলে, সিগারেটের বিস্তার ঠেকাতে শক্তিশালী সামাজিক প্রতিরোধ এ দেশে রয়েছে। তবে এর সম্পূরক ভূমিকা থাকতে হবে সরকারের রাজস্বনীতিতে তথা জাতীয় বাজেটেও। তাই আমাদের প্রত্যাশা, আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সিগারেটের ওপর কার্যকর করের প্রস্তাবগুলো প্রতিফলিত হবে।

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।

news24bd.tv/আইএএম