কোন দিকে মোড় নিচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ?

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ?

সুদীপ চক্রবর্তী

ইউক্রেনে এখন সবেমাত্র গ্রীষ্ম শুরু হচ্ছে। কিন্তু সময়টা তাদের জন্য ভালো যাচ্ছে না। রাশিয়ার নিকটবর্তী উত্তর-পূর্বে দেশটির দ্বিতীয় শহর খারকিভ রাশিয়ার বিমান হামলার বিরুদ্ধে একধরনের অসহায় এবং রক্ষাহীন হয়ে পড়েছে।

গত শনিবার বিকেলে খারকিভের একটি সুপারস্টোর এবং বাগানকে ধ্বংস করে দুটি রাশিয়ান গাইডেড বোমা।

বিল্ডিংটি পুড়ে যাওয়ার সাথে সাথে খারকিভ জুড়ে কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে। সেই শপিং সেন্টারের একটি স্টোরের ম্যানেজার আন্দ্রি কুদেনভ জানান, 'রাশিয়ানরা সবকিছু পুড়িয়ে ফেলতে চায়। কিন্তু আমরা হাল ছাড়ব না। '

সেখানে এখন গ্রীষ্মমন্ডলীয় আবহাওয়া থাকায় এবং বাগান করার মৌসুম শুরু হওয়ায় প্রচুর লোকের সমাগম ছিলো।

যে দোকানে হামলা হয়েছিলো সেখানে মাটি, চারাগাছ এবং অন্যান্য রোপণের গাছপালা ছিল। '

হামলার ঠিক আগে আন্দ্রি নামে এক ব্যক্তি তার মোবাইল বের করে সুপারস্টোরের ছবি তোলে। হামলার পর সে ওই ছবিগুলো স্ক্রল করে দেখিয়ে তিনি বলেন, 'দেখো, ওদের এখানে কত সুন্দর ফুল ছিল। যারা এখানে ছিলেন সবাই বেসামরিক লোক। '

এই হামলায় কমপক্ষে ১৫ জন নিহত হয়েছে বলে নিশ্চিত করা হয়েছে। বাকিদের মৃতদেহ খোঁজার চেষ্টা চলছে। প্রতিটি যুদ্ধে, বেসামরিক নাগরিকরা যুদ্ধ পূর্ববর্তী জীবনে তাদের স্মৃতি চিহ্নগুলো সংরক্ষণ করার চেষ্টা করে।

বাগানের কেন্দ্রটি পুড়ে যাওয়ার সময় দম্পতিরা তাদের কুকুর নিয়ে হাঁটছিলো। খারকিভের কেন্দ্রের সেই মনোমুগ্ধকর চত্বরে হামলার সময় ক্যাফেগুলি খোলা ছিল। সেখানকার মানুষ মোবাইল অ্যাপে বিমান হামলার সাইরেন এবং সতর্কতা উপেক্ষা করে।

সেখানকার এক অপেরা হাউসের কিশোর ছেলেরা তাদের স্কেটবোর্ডের মাধ্যমে স্কেটিং অনুশীলন করে এবং মেয়েরা তাদের মোবাইল ফোনে টিকটকে নাচ রেকর্ড করে। অপেরা হাউসের ভিতরে, একটি গভীর কংক্রিটের বেসমেন্ট রয়েছে। একদল একটি অর্কেস্ট্রা সঙ্গীত উত্সবের জন্য মহড়া দিচ্ছিল যে যুদ্ধ থামেনি।

রাশিয়ার পূর্ণ মাত্রায় আগ্রাসনের পর থেকে ইউক্রেন বর্তমানে সবচেয়ে খারাপ সংকটে রয়েছে।

বাগান কেন্দ্রের আক্রমণটি এখানে উত্তর-পূর্বে, সেইসাথে পূর্ব ফ্রন্টে এবং খেরসনের কাছে দক্ষিণে অনেকগুলো হামলার মধ্যে অন্যতম ছিল।

ইউক্রেনের নিজেকে রক্ষা করার ক্ষমতা অন্যদের উপর নির্ভর করে। কারণ তাদের পশ্চিমা মিত্রদের গৃহীত সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে খারকিভ এবং অন্যান্য শহরগুলোর পাশাপাশি ১ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি (৬২১ মাইল) এলাকার রূপরেখা নির্ধারণ করা হচ্ছে।

আরেকটি কৌশলগত কারণ যা যুদ্ধের গতিপথ পরিবর্তন করছে তা হল রাশিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে দক্ষতা এবং মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা। এটি ইউক্রেনের দুর্বলতার সুযোগ নিতে রাশিয়াকে সাহায্য করছে। বিশেষ করে রাশিয়ার বিমান প্রতিরক্ষা। কারখানাগুলোতে রাশিয়া অনেক বড় এবং পশ্চিমাদের তুলনায় অনেক বেশি অস্ত্র ও গোলাবারুদ উৎপাদন করছে।

যুদ্ধের প্রথম বছরে পশ্চিমাদের লক্ষ্য ছিলো রাশিয়াকে পিছিয়ে দেওয়া। সেক্ষেত্রে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীকে ইউক্রেনের অভ্যন্তরে অগ্রসর হওয়া বন্ধ করতে চেষ্টা করা হয়েছিলো।

কিন্তু যুদ্ধের তৃতীয় বছর হতে চললেও এর কোনো শেষ দেখা যাচ্ছে না।  

এখানেই কি শেষের শুরু?

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে আক্রমণের শুরুর দিকে দ্রুতই নিজেদের বিজয়ের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছিলেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটোও একই রকম প্রত্যাশা করেছিলো। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি তাদের প্রথমে তাদের অঞ্চলগুলো খালি করার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন।

ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনী ২০১৪ সালে নিজেদের সামরিক প্রদর্শনে উন্নতি দেখালেও, সিরিয়া যুদ্ধে সফল হস্তক্ষেপের পরে, রাশিয়াকে অনেকটাই শক্তিশালী মনে হচ্ছিলো।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ান সৈন্যরা ইউক্রেনে নিজেদের সৈন্য দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য যেভাবে অগ্রসর হওয়া শুরু করেছিলো, তা দেখে ইউক্রেন ন্যাটো দ্বারা সশস্ত্র বিদ্রোহ সংগঠিত করার চেষ্টা করেছিলো।

রাশিয়া ইউক্রেনীয় ভূখণ্ডের একটি দীর্ঘ অংশ দখল করেছে যা পূর্বে দনবাসকে দক্ষিণে ক্রিমিয়ার সাথে সংযুক্ত করার জন্য একটি স্থলসেতু।

ন্যাটো ধারণা করেছিলো ইউক্রেন শক্তভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে পারবে। ধীরে ধীরে, ইউক্রেনকে শক্তিশালী অস্ত্র সরবরাহ করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো তাদের নিজস্ব সৈন্য নিয়ে হস্তক্ষেপ করলে কিংবা তারা ইউক্রেনকে সবচেয়ে আধুনিক সামরিক প্রযুক্তি সরবরাহ করলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা করছিলেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন।

রাশিয়ার মিত্র চীন স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে তারা কোনো পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে চায় না। কারণ এতে করে পূর্ব এশিয়ায় পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা শুরু হবে। জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া যদি যথেষ্ট হুমকি বোধ করে তাহলে উভয়েরই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রযুক্তিগত ক্ষমতা প্রদর্শন করবে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সরবরাহ করা অস্ত্র ব্যবস্থার ব্যবহারের উপর সীমাবদ্ধতা অব্যাহত রেখেছে। তারা চায় না যে রাশিয়ার কোনো লক্ষ্যবস্তুতে ইউক্রেন আঘাত করার চেষ্টা করুক।

ইউক্রেনের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা হল এটি অর্থায়ন এবং অস্ত্রের জন্য মিত্রদের ওপর নির্ভর করে। এটি মুখোমুখি এমন এক দেশের যারা নিজেরাই বেশিরভাগ অস্ত্র তৈরি করে। রাশিয়ার জনসংখ্যা ১৪০ মিলিয়নের বেশি যা ইউক্রেনের জনসংখ্যার সাড়ে তিনগুণ।

ইউক্রেনের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ৬০ বিলিয়ন ডলারের (৪৭ বিলিয়ন পাউন্ড) 'নিরাপত্তা সম্পূরক' মার্কিন কংগ্রেসে মাসের পর মাস আটকে রাখা হয়েছিলো। যারা এই বিলটি আটকে রাখে তাদের বেশিরভাগই ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থক বলে অভিযোগ করা হয়। মূলত তারা এই অর্থ ইউক্রেনকে দেওয়ার পরিবর্তে নিজেদের ইমিগ্রেশন সমস্যা এবং মেক্সিকোর সাথে সীমান্ত সমস্যা সমাধানে ব্যয় করার তাগিদ দিচ্ছিলেন।

বেলজিয়ামে ন্যাটো সদর দপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মতে 'এটি একটি উৎপাদন যুদ্ধ। ' তিনি আরও বলেন, আমরা ইউক্রেনের প্রয়োজন জানি। কিন্তু রাশিয়া আমাদের ছাড়িয়ে যাচ্ছে। '

পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার অর্থনীতিকে পঙ্গু করতে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ রাশিয়া তেল এবং গ্যাসের জন্য নতুন বাজার খুঁজে পেয়েছে।

ন্যাটোর এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, 'এতে কোনো সন্দেহ নেই যে চীন বস্তুত রাশিয়ার যুদ্ধ প্রচেষ্টায় অবদান রাখছে। ' এটি প্রতিরক্ষা শিল্প বেস পুনর্নির্মাণ করছে।   মেশিন টুলস এবং মাইক্রোইলেক্ট্রনিক্স চীন থেকে আসে এবং প্রতিরক্ষা শিল্পকে শক্তিশালী করার জন্য সরাসরি ব্যবহৃত হয়।  তাই তারা আরও ট্যাঙ্ক এবং মিসাইল তৈরি করছে। '

যদিও সবকিছু ছাপিয়ে এখন একটি প্রশ্নই বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে যে, এই গ্রীষ্মেই কী রাশিয়া তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্যের পথে বড় একটি পদক্ষেপ নিতে চলেছে? পাশাপাশি অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়া ইউক্রেনের সেনারা কি আদৌ তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিরোধ ধরে রাখতে সক্ষম হবে?

ইউক্রেন কমবয়সী পুরুষদের নিয়োগের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তাদের বেশিরভাগ ফ্রন্ট লাইন যোদ্ধা মধ্যবয়সী এবং দীর্ঘদিনের যুদ্ধে তারা এখন ক্লান্ত।

ইউক্রেনের ইউরোপীয় মিত্ররা চেষ্টা করছে, বিভিন্ন মাত্রায় সমর্থন বাড়ানোর জন্য। সামরিক সহায়তার নতুন আমেরিকান প্যাকেজটি আসার পরে এটি একটি পার্থক্য তৈরি করবে বলে মনে করা হচ্ছে। এর মানে ইউক্রেন যাতে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারে তার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে মিত্ররা।

আগামী নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হলে, তিনি ইউক্রেনকে সাহায্য করার জন্য জো বাইডেনের মতো কঠোর চাপ দেবেন কিনা তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।  

এখন রাশিয়া এবং ইউক্রেন ও তাদের মিত্ররা কিভাবে নিজেদের কৌশল সাজায় তা সময়ই বলে দেবে। (সূত্র: বিবিসি)

news24bd.tv/SC