বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপরে ‘অত্যাচার’ নিয়ে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর হিড়িক

বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপরে ‘অত্যাচার’ নিয়ে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর হিড়িক

অনলাইন ডেস্ক

গণ-বিক্ষোভের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালান শেখ হাসিনা। স্বৈরাচারী সরকারের পতনে পুরো দেশে যখন উৎসবের আমেজ, তখন দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। অনেক স্থাপনা, ঘর-বাড়িতেও হয় হামলা।

তবে অবাক করা বিষয় এই যে, দেশে চলমান এই সহিংসতা নিয়ে মিথ্যাচারে মাতে একটি চক্র।

প্রতিপক্ষকে আক্রমণ এবং বাড়ি-ঘর জ্বালানোর ঘটনাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ভারতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যেখানে দাবি করা হয়  বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপরে ব্যাপক অত্যাচার শুরু হয়েছে।

সম্প্রতি এ নিয়ে বিস্তারিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি। তাদের তথ্য যাচাই বিভাগ বিবিসি ভেরিফাই সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া অনেক পোস্ট যাচাই করে দেখেছে, বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা যেমন ঘটেছে, তেমনি অনেক হামলার গুজবও ছড়ানো হয়েছে।

এর মধ্যে, গতকাল শনিবার (১১ আগস্ট) বাংলাদেশে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ এবং বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ নামে দুটি সংগঠন দাবি করেছে, শেখ হাসিনার পতনের পর দেশের ৫২টি জেলায় সংখ্যালঘু মানুষের ওপর ২০৫টি হামলার ঘটনা ঘটেছে।

তবে এসব হামলা ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে হয়েছে নাকি নাকি সরকার ঘনিষ্টদের ওপর ক্ষোভের অংশ হিসেবে হয়েছে, তা নিরপেক্ষভাবে যাচাই সম্ভব হয়নি।

এদিকে, বাংলাদেশের হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু এবং সেদেশে বসবাসকারী ভারতীয়দের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে একটি বিশেষ কমিটি গড়েছে ভারত সরকার। আর বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার অভিযোগ ওঠার পর দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় রোববার থেকেই হটলাইন চালুর কথা ছিল।

সামাজিক মাধ্যমে গুজব যেভাবে
বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপরে ‘ব্যাপক অত্যাচার’ হচ্ছে বলে যেসব ভুয়া পোস্ট সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল, তার বেশিরভাগই ভারতীয় বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা হয়েছিল বলে ফ্যাক্ট-চেকাররা নিশ্চিত করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকেও এধরনের গুজব ছড়ানো হয়েছিল সামাজিক মাধ্যমে, এমনটাও ফ্যাক্ট-চেকাররা বলছেন। তারা এটাও বলছেন, নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপরে কিছু আক্রমণ হয়েছে, বাড়িঘর জ্বালানো হয়েছে। কিন্তু তথ্য যাচাই করতে গিয়ে দেখা গেছে মুসলমানদের বাড়িঘরও ভাঙচুর করা হয়েছে, জ্বালানো হয়েছে।

এক্ষেত্রে আক্রমণকারীদের লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর, সম্পত্তি। ধর্মীয় পরিচয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গৌণ ছিল, তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ের জন্যই তারা আক্রান্ত হয়েছেন।

বাংলাদেশ থেকে আওয়ামী লীগের যেসব স্থানীয় নেতা-কর্মী পালিয়ে ভারতে চলে এসেছেন অথবা আসার চেষ্টা করছেন, তারাও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন যে হিন্দু আর মুসলমান–উভয় সম্প্রদায়ের আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বাড়িতেই হামলা হয়েছে।

কিন্তু ভারত থেকে সামাজিক মাধ্যমে বিষয়টিকে রাজনৈতিক না রেখে সাম্প্রদায়িক রঙ দেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন একাধিক ফ্যাক্ট চেকার। বিবিসির তথ্য যাচাইয়ের বিভাগ ‘বিবিসি ভেরিফাই’-ও একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে।

চট্টগ্রামের এই মন্দিরে আগুন লাগানো হয় বলে গুজব ছড়ানো হয়
চট্টগ্রামের এই মন্দিরে আগুন লাগানো হয় বলে গুজব ছড়ানো হয়


মন্দির পাহারায় মইনুল
হিন্দু মন্দিরে আক্রমণ হয়েছে বলে যে ধরনের পোস্ট ভাইরাল হয়েছিল, তার কয়েকটি চোখে পড়েছিল চট্টগ্রামের এক বিক্ষোভকারী মইনুলের। বিবিসির তথ্য যাচাই বিভাগ ‘বিবিসি ভেরিফাই’ যখন তার সঙ্গে যোগাযোগ করে, তিনি সেসময়ে চট্টগ্রাম লাগোয়া ‘শ্রী শ্রী সীতা কালী মাতা মন্দির’ পাহারা দিচ্ছিলেন।

মইনুল বিবিসিকে বলছিলেন, ‘তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব তো আমাদের। আমরা সব সরকারি স্থাপনা, মন্দির, গির্জা–সব কিছুই রক্ষা করব। ’ তার কথায়, যেসব পোস্ট ছড়াচ্ছে, সেগুলো কিন্তু ‘আমাদের চোখে দেখা বাস্তব ছবির সঙ্গে মিলছে না। ওই সব পোস্ট বিশ্বের সামনে বাংলাদেশ সম্বন্ধে একটা ভুল ছবি তুলে ধরছে। ’ 

বিক্ষোভকারীদের ওপরে ব্যাপক নির্যাতন ও হত্যা শেষে যখন শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালালেন, বিক্ষোভকারী ও বিরোধী দলীয় সদস্যদের ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠা খুব আশ্চর্যের কিছু ছিল না বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে বিবিসি। অন্যদিকে, থানাগুলোতে আক্রমণ হওয়ার ফলে পুলিশ ছিল না পুরো বাংলাদেশেই। এই সময়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাড়ি-ঘরে লুট চলে, সহিংসতা শুরু হয়।

তবে বাস্তবে দেখা গেছে, সাধারণ নাগরিকদের বাড়িতেও লুট চলেছে, তাদেরও কেউ কেউ সহিংসতার শিকার হয়েছেন। ‘বিবিসি ভেরিফাই’ বলছে, ব্যাপক সহিংসতার ফলেই সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের মনে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল।


ভারত থেকে ছড়ানো হয় ভুয়া খবর
চারদিকে যখন একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি চলছিল, সেই সময়ে ভারতের অতি-দক্ষিণপন্থী ‘ইনফ্লুয়েন্সর’রা সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিভ্রান্তিকর ভিডিও শেয়ার করতে থাকেন, যাতে মনে হয় যে বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপরে অত্যাচার হচ্ছে। এছাড়া এরকম গুজবও ছড়ানো হয় যে ছাত্র-বিক্ষোভকারীরা ‘ইসলামি কট্টরপন্থী’।

সামাজিক মাধ্যমের ওপরে নজর রাখে ‘ব্র্যান্ডওয়াচ’ অ্যাপ। তারা খুঁজে পেয়েছে যে ৪ আগস্টের পর থেকে ভুয়া কাহিনীগুলো ছড়ানো হয়েছে এমন একটি হ্যাশট্যাগ দিয়ে, যেটি সামাজিক মাধ্যম ‘এক্স’-এ (সাবেক টুইটার) সাত লাখ বার মেনশন হয়েছে। যেসব অ্যাকাউন্ট থেকে ট্রেন্ডিং পোস্টগুলো করা হয়েছিল, তার প্রায় সবই ভারতে অবস্থান করছে, এমনটাও জানা গেছে ‘ব্র্যাণ্ডওয়াচ’ থেকে।

বাংলাদেশ ভিত্তিক ফ্যাক্ট-চেকাররাও গত কয়েকদিনের সামাজিক মাধ্যম বিশ্লেষণ করে অনেকটা এরকম তথ্য পেয়েছেন যে, মূলত ভারতের বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকেই হিন্দুদের ওপরে আক্রমণের ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয়েছে।

ইউনিভার্সিটি অফ লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ বা ইউল্যাবের অনুমোদনপ্রাপ্ত স্বাধীন তথ্য যাচাই করার উদ্যোগ ‘ফ্যাক্ট ওয়াচ’এর প্রধান অধ্যাপক সুমন রহমান বলছিলেন, ‘কিছু ঘটনা ঘটেছে ঠিকই, যেখানে হিন্দুদের বাড়ি আক্রমণ করা হয়েছে। তবে প্রায় সব ক্ষেত্রেই ওই ব্যক্তিরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি। কিন্তু এমন একটা আখ্যান তৈরি করা হয়েছে, যাতে মনে হচ্ছে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হচ্ছে। এটা একেবারেই ভুল আখ্যান ছড়ানো হয়েছে। যেসব অ্যাকাউন্ট থেকে এই ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয়েছে, সেগুলির বেশিরভাগই ভারতের। ’

আবার ঢাকার ‘দৈনিক আজকের পত্রিকার’ ফ্যাক্ট চেকার রিদওয়ানুল ইসলাম বলছিলেন ভারতীয় অ্যাকাউন্টগুলো থেকেই বেশিরভাগ ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘তবে বাংলাদেশের ভেতর থেকেও হিন্দুদের ওপরে আক্রমণের ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয়েছে বলে আমাদের অনুসন্ধানে জানতে পারছি। ’ 

বাংলাদেশের 'হিন্দু ক্রিকেটার' লিটন দাশের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে গুজব ছড়ানো হয়
বাংলাদেশের 'হিন্দু ক্রিকেটার' লিটন দাসের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে গুজব ছড়ানো হয়। আদতে এটি ছিল সাবেক ক্রিকেটার ও আওয়ামী লীগের এমপি মাশরাফি বিন মর্তুজার বাড়ি।  

হিন্দুদের বাড়ি, মন্দির ‘জ্বালানো’র ভুয়া খবর
সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্ট ভাইরাল হয়, যেখানে দাবি করা হয় বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের ‘হিন্দু ক্রিকেটার’ লিটন দাসের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেক অ্যাকাউন্ট থেকে দাবি করা হয়, কট্টর ইসলামপন্থীরা তার বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। কিন্তু যে বাড়িটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয়েছিল, সেটা যে আসলে বাংলাদেশের জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার। প্রসঙ্গত, মাশরাফি আওয়ামী সরকারের দুই দফার এমপি।  

আরেকটি ভাইরাল হওয়া পোস্টে দাবি করা হয়েছিল ‘বাংলাদেশের ইসলামী জনতা’ একটা মন্দিরে আক্রমণ করেছে। চট্টগ্রামের ‘নবগ্রহ মন্দির’এর কাছে আগুন লাগানোর ভিডিও ছড়ানো হয়েছিল। তবে দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে মন্দিরে আগুন লাগে নি।

বিবিসি জানিয়েছে, তাদের বিবিসি ভেরিফাইয়ের কাছে ছবি এসেছে যে, ওই মন্দিরের কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে ওই মন্দিরের পিছনে আওয়ামী লীগের একটি কার্যালয়ই আসল লক্ষ্য ছিল বলে মনে হয়েছে।

মন্দিরের কর্মকর্তা স্বপন দাস বিবিসিকে জানিয়েছেন, ওই দলীয় কার্যালয় থেকে চেয়ার-টেবিল বার করে আগুন লাগানো হয়েছিল মন্দিরটির পিছন দিকে। এই ঘটনা ৫ আগস্ট দুপুরের। অগ্নিকাণ্ডের পরের কয়েকটি ছবিতে দেখা গেছে যে আওয়ামী লীগ নেতাদের ছবি সহ বেশ কিছু পোস্টারও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। স্বপন দাস আরও জানিয়েছেন, ২৪ ঘণ্টাই এখন মন্দিরে পাহারা দিচ্ছেন মানুষ।


লক্ষ্য আওয়ামী লীগ, হিন্দুরা নয়
আরও দুটি ভাইরাল হওয়া পোস্টে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে দাবি করা হয়েছে হিন্দুদের ওপরে আক্রমণ হয়েছে। কিন্তু যাচাই করে দেখা গেছে, যাদের ওপরে আক্রমণ করা হয়েছিল, তারা আসলে আওয়ামী লীগের নেতা এবং তারা মুসলমান। এসব পোস্টই ভারতীয় দক্ষিণ-পন্থী অ্যাকাউন্টগুলো থেকে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ‘সেভবাংলাদেশীহিন্দু’ হ্যাশট্যাগ দিয়ে সেসব শেয়ার করা হয় হিন্দুত্ববাদীদের ‘ভেরিফায়েড’ অ্যাকাউন্ট থেকে।

সম্প্রতি আরও একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, যেখানে দাবি করা হয়েছে যে ‘ইসলামী জনতা’ হিন্দুদের গ্রাম আক্রমণ করেছে এবং একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী পুকুরে সাঁতার কেটে পালানোর চেষ্টা করছে। ভারতীয় ফ্যাক্ট-চেকাররাই খুঁজে বার করেছেন যে ওই ব্যক্তি মুসলমান।

এক হিন্দু ব্যক্তি সাঁতার কেটে পালাচ্ছেন বলে যে ভিডিও ছড়িয়েছে, তিনি আসলে মুসলমানা
এক হিন্দু ব্যক্তি সাঁতার কেটে পালাচ্ছেন বলে যে ভিডিও ছড়িয়েছে, তিনি আসলে মুসলমান

ইউল্যাবের ‘ফ্যাক্ট-ওয়াচ’এর প্রধান অধ্যাপক সুমন রহমান বলেন, ‘সম্প্রতি দুই নারীকে কিডন্যাপের কাহিনী ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক মাধ্যমে। এর মধ্যে একটি ঘটনা ঢাকার, অন্যটি নোয়াখালীর। ঢাকার ঘটনাটি হলো, একটি ছাত্রী রাস্তায় ট্র্যাফিক ডিউটি করছিল দীর্ঘক্ষণ। তার বাবা মা-ই জোরপূর্বক তাকে বাড়ি নিয়ে যান। তবে সেই ভিডিওকে বলা হলো, ওই ছাত্রীকে নাকি কিডন্যাপ করা হয়েছে। আর নোয়াখালীর ঘটনায় যে নারীকে কয়েকজন ‘গণধর্ষণ’-এর জন্য কিডন্যাপ করা হয়েছে বলা হচ্ছে, আসল ঘটনা হল ওই হিন্দু নারী সাবেক স্বামীর থেকে আলাদা হয়ে নিজের বাবা-মায়ের কাছে থাকছিলেন। কিন্তু তার স্বামী কয়েকজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে ওই নারীকে উঠিয়ে নিয়ে যান। এটাকে ‘হিন্দু নারীকে গণধর্ষণের জন্য কিডন্যাপ’ বলে চালানো হয়েছে। ’

দৈনিক আজকের পত্রিকার ফ্যাক্ট-চেকার রিদওয়ানুল ইসলামের কথায়, ‘শুধু যে সামাজিক মাধ্যমে গুজব ছড়ানো হয়েছে, তা নয়। কয়েকটি টিভি চ্যানেল এবং পোর্টালও সামাজিক মাধ্যমের ওই সব গুজবের ওপরে ভিত্তি করে সংবাদ প্রতিবেদন পর্যন্ত বানিয়ে ফেলেছে। ’ যে কটি টিভি চ্যানেল এবং পোর্টালর নাম তিনি নেন, সেগুলো সবই পরিচিত হিন্দুত্ববাদী সংবাদ মাধ্যম।

বিবিসি জানায়, তারা এটাও জানতে পেরেছে শুধু ভারত বা বাংলাদেশ নয়, যুক্তরাজ্যের এক পরিচিত অতি-দক্ষিণপন্থী ইনফ্লুয়েন্সারও এ ধরনের গুজব ছড়িয়েছেন। টমি রবিনসন নামের ওই ইনফ্লুয়েন্সার যাচাই না করা নানা ভিডিও ছড়িয়ে লিখেছেন যে বাংলাদেশে ‘হিন্দুদের গণহত্যা চলছে’।


দুই সরকার যা ব্যবস্থা নিচ্ছে
বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপরে ব্যাপক আক্রমণ হচ্ছে, এই তথ্যের প্রেক্ষিতে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ একটি কমিটি গড়েছেন, যারা বাংলাদেশে ভারতীয় নাগরিক, হিন্দু এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভাল করবেন। ওই কমিটির প্রধান করা হয়েছে বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিচালক রভি গান্ধীকে। অন্য সদস্যরা হলেন বিএসএফের দক্ষিণ বঙ্গ এবং ত্রিপুরা সীমান্ত অঞ্চলের দুই আইজি এবং ল্যান্ড পোর্ট অথরিটির দুই প্রতিনিধি।

এ বিষয়ে অমিত শাহ এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু এবং সেদেশে বসবাসকারী ভারতীয়দের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে বিশেষ কমিটি গড়ল ভারত সরকার। এই কমিটি বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে যাতে সেখানে বসবাসকারী ভারতীয় নাগরিক, হিন্দু এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করবে। বিএসএফের পূর্ব কমান্ডের এডিজি এই কমিটির প্রধান হবেন। ’

ওই কমিটির একজন সদস্য বিবিসিকে জানিয়েছেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যেরকম টুইটে লিখেছেন, বাংলাদেশে কেউ সমস্যায় আছেন, এরকম খবর পেলে আমরা সেদেশে আমাদের কাউন্টারপার্ট, অর্থাৎ বিজিবির সঙ্গে যোগাযোগ করে সমস্যা মেটানোর কাজ করবো। যেরকম শুক্রবার একটা সমস্যা তৈরি হয়েছিল কোচবিহারের শিতলখুচিতে। বাংলাদেশের দিকে বহু মানুষ ভারতে প্রবেশ করতে চেয়ে সীমান্তের অপর পাড়ে জড়ো হয়েছিলেন। আমরা বিজিবির সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ করে তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করি। শনিবার কিন্তু এভাবে কেউ জড়ো হয় নি। ’ 

ভারতীয় অংশ থেকে পোষ্ট করা কিছু ভিডিওতে দেখা যায়, সীমান্তের ওপারে কিছু মানুষ জড়ো হয়েছেন। কিন্তু তাদের মধ্যে নারী বা শিশু ছিলেন না এবং ওই ব্যক্তিদের কাছে ব্যাগ জাতীয় কিছু দেখা যায়নি। তারা সীমান্ত পাড়ি দিতে জড়ো হয়েছিলেন কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

এদিকে, এরইমধ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারও হিন্দুদের সহায়তায় একটা হটলাইন চালু করছে। এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান অন্তর্বর্তী সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন। তিনি জানান, কোথাও যদি সংখ্যালঘুদের ওপর কোনও হামলা বা সহিংসতার ঘটনা ঘটে হটলাইনে জানালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে ব্যবস্থা নেবেন তারা।

খালিদ হোসেন বলেন, ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর, উপাসনালয়ে হামলার খবর আসছে। সরকারকে অস্থিতিশীল করার পায়তারা এবং ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্ট করার চেষ্টা চলছে। এর সাথে গুজবও যুক্ত হয়েছে। এই উপদেষ্টা আরও বলেন, যেকোনো মূল্যে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য বজায় রাখতে চায় সরকার।

মন্দির পাহারায় মইনুল (বাঁদিক থেকে তৃতীয়)
মন্দির পাহারায় মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা 

‘আমরা ফাঁদে পা দেব না’
চট্টগ্রামের ‘শ্রী শ্রী সীতা কালী মাতা মন্দির’-এর বাইরে মুসলমান আর হিন্দু ছাত্ররা কথা বলছিলেন সম্প্রীতি নিয়ে, ভবিষ্যৎ নিয়ে। এসময় মইনুল বলেন, ‘এসব গুজব ছড়ানোর উদ্দেশ্য হলো একটা বিশৃঙ্খলা তৈরি করা, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করা। তবে আমরা ফাঁদে পা দেব না। ’

এলাকার আরেক বাসিন্দা ছোটন নিয়মিত ওই মন্দিরটিতে যান। তিনি তার মুসলমান পড়শিদের ধন্যবাদ দিচ্ছিলেন, ‘তাদের ধন্যবাদ। যতক্ষণ না এই কঠিন সময়টা আমরা পার করতে পারছি, ততক্ষণ যেন তারা এভাবেই পাশে থাকেন। স্বাধীন বাংলাদেশে ভবিষ্যতেও যেন আমরা এভাবেই একসঙ্গে কাটাতে পারি। ’

তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা

এই রকম আরও টপিক