বিচার

অলংকরণ: মৃ

গল্প

বিচার

অবন্তিকা দত্ত

চারদিকে প্রচণ্ড হট্টগোল এবং ভিড়। কচিকাঁচা থেকে শুরু করে বুড়ো হাবড়া পর্যন্ত এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে খুব ত্রস্ত পদক্ষেপে ছুটে বেড়াচ্ছে, না জানি কিসের খুব তাড়া তাদের। বিভিন্ন লোকজন ভিন্ন কলতানে নিজেদের মধ্যে বকবক করে চলছে, কিন্তু আদৌ কেউ কারো কথা শুনছে কিনা সেটা বোঝাই দায়। এই সবকিছুর মধ্যে বিসমিল্লাহ খাঁর সানাইয়ের সুরটুকু খুব বেমানান লাগছে।

আনকোড়া সানাইয়ের ক্রন্দনের সুরটুকু ছাড়া বাঙালি বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার সবকিছুই যেন মেকি মনে হয়। নাহিদ বারবার করে খুঁজছিল তার ‘বন্ধু‘ পিয়ালকে। বর বেশে পিয়ালকে কেমন লাগবে সেটা ভাবতে ভাবতে একেকবার হাসিতে তার পেট ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়, আবার মনের কোণায় একটু হিংসার বিষবাষ্পও বয়ে যায়। আজকে বাবার অসুস্থতার পর তাদের পরিবারটা এত বেশি অগোছালো না হয়ে গেলে আর হুট করে ছোটো চাচা মারা গিয়ে উনার ছোট মেয়ের দায়িত্ব ওদের উপর এসে না পড়লে বিয়ের শেরওয়ানি আজ তার পরনেও উঠতো।
যাই হোক, এসব ভেবে আজকের এই দিনটা নষ্ট করে লাভ নেই। এর মধ্যেই শেরওয়ানি পরিহিত পিয়ালকে দেখে সে হাত তুলে ডাকলো।

“এ্যাই পিয়াল, কিরে শালা, শেরওয়ানি পরে আর চোখই নড়ছে না নাকি? বন্ধুবান্ধবদের দাওয়াত যেমন দিতে হয়, তেমনি তারা বিয়েতে আসলে তাদের আপ্যায়নও কি করতে হয়না, নাকি ভাবীকে দেখে আর অন্য কিছুর দিকে চোখই যাচ্ছে না?” ঠুনকো রসিকতা করতে করতে নাহিদের চোখে পড়লো পিয়ালের গলায় একটা চেইন আর হাতে একটা সোনার আংটি, দেখে তার মাথায়  কেমন রক্ত উঠে গেলো। যে পিয়াল একটু মাংস খাওয়ার জন্য হাভাতের মত বসে থাকতো তার বাসায় এসে, আজকে শুধু একটু দিন ফিরেছে বলে একই সাথে বউ পাচ্ছে, যৌনতা পাচ্ছে, জামাই হওয়ার আদর পাচ্ছে, আবার সোনার আংটি, চেইনও পাচ্ছে। নিজের বাবার ভালো পয়সা থাকলেও বন্ধুদের বাড়িতে এসে হাভাতেগিরি করতে কখনই বাধতে দেখেনি  সে পিয়ালের। না জানি যৌতুক হিসেবে কতো টাকাই হাতিয়েছে শ্বশুরের  কাছ  থেকে, ভাবতে ভাবতে নাহিদের মুখের ভিতরটা তিতা হয়ে উঠলো। অনেকদিন ভালো মন্দ খাওয়া হয়ে ওঠেনা তার। পিয়ালের বিয়েতে বড় আয়োজন হবে শুনে গত রাতের পর থেকেই কিছু খায়নি সে, বড় একটা দাঁও মারবে সেই আশায়। এখন কেন যেন তার  খিদাও মরে যেতে লাগলো আস্তে আস্তে। শুধু বুকের একদম অন্তঃস্থল থেকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে উঠে আসতে লাগলো সমুদ্রসমান ফেনিল ঢেউ।

“আরে ধুর পাগল, কি যে বলিস”, হাসতে হাসতে বললো পিয়াল, তার মুখে একটা সুখের ঝলকানি দেখতে পেলো নাহিদ। “অমন কিছু না রে, কি যে প্যারা খেলাম এই কয়দিন ধরে, বিয়ের সব কিছু নিজেরই করা লাগলো, বাসায় এমন একটা মানুষ নাই যার কাছে একটা দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকবো। এখনও তো ব্যাচেলর আছিস, জীবনের আসল জ্বালা এখনও কিছুই বুঝিসনি, হা হা হা”, কি যে একটা আনন্দের হাসি হাসলো পিয়াল, আসল জ্বালা কি এতই সুখের? নাহিদ হটাৎ করে পিয়ালকে বলে ফেললো, আসলে কোন পরিস্থিতিতেই সে নিজের এই কষ্টের কথাটা কাউকে বলে সেখান থেকে কোন সুযোগ লাভের আশা ছাড়তে পারে না, “শোন দোস্ত, আমার একার আয়ে আর তো সংসার চলে না, ছোটো চাচার মেয়ে রুবি আসার পর আর আব্বার অসুস্থতার পর সংসার যেন এক জায়গায় আটকিয়ে আছে। আমি টাকা এনে দেই কিছু, আর আম্মা সেটুকু দিয়ে কিভাবে যেন রোজকার অন্নের সংস্থান করে ফেলে, কিন্তু এভাবে তো আর চলা যায় না। বিয়ের বয়স হয়ে গেলো, এমনকি রুবির বিয়ের বয়সও হয়ে যাচ্ছে। এখন তো সংসারে একটা হাল হকিকত ফেরানো লাগে, তাই না বল? তুই একটু দেখ না তোর আব্বার বা শ্বশুরের কাছে ভালো কোন চাকরি আছে কিনা। যতোই হোক, জাতীয় ভার্সিটি থেকে অনার্সটা তো করলাম কোনরকম ভাবে। এখন তো কোন না কোন চাকরি করতে পারবোই তাইনা বল?”, বলতে বলতে শেষের দিকে নাহিদের কন্ঠ কেমন করুণ হয়ে আসে। পিয়াল চুপ করে যায়, রোজকার এই অশান্তি তার আর ভালো লাগে না। সারাক্ষণ খালি মানুষের দুঃখের গান শোনা আর তাদের জন্য কাজের ফিরিস্তি শোনা। মনে হয় সে যেন চাঁদের হাট নিয়ে বসে আছে, এক চুটকি মারবে আর সবাই চাকরি পেয়ে যাবে, বড়লোক হয়ে যাবে। হাস্যকর চিন্তা ভাবনা মানুষের। কেন এরা এভাবে চিন্তা করে? একটু যৌক্তিকভাবে চিন্তা করতে কি পয়সা লাগে এদের? পিয়াল এই কয়দিনের মধ্যেই অবশ্য ভুলে গেছে যে মাত্র দুই বছর আগে সেও একটু অপেক্ষাকৃত ধনী বন্ধু বা মুরুব্বী লোক দেখলেই তার কাছে গিয়ে এভাবে চাকরি বা টাকা ধারের আবদার করে বসত। কেই বা অবশ্য চায় নিজের ক্লেদাক্ত  অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ের কথা মনে রেখে উজ্জ্বলতর দিনগুলোকে ম্লান করে দিতে? পিয়াল নাহিদকে কিছুটা দায়সারাভাবে আশ্বস্ত করে বিয়ের আসরে ছবি তুলতে চলে গেলো। অনেক টাকা দিয়ে ক্যামেরাম্যান ভাড়া করেছে, সেই প্রত্যেকটা পয়সা সুদে আসলে উসুল করবে সে।  

অবশেষে নাহিদ খেতে বসেছে, বেশ ভালরকম আয়োজন করা হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে পিয়ালের শ্বশুরের বেশ ভালো পয়সা আছে। নাহিদের বুকের ভেতরটা কেমন জ্বলতে লাগলো। অনেক অম্ল মধুর স্মৃতি তার মনে ভিড় করলো, কিন্তু সেগুলো পাত্তা না দিয়ে সে খেতে বসলো। একটা বার অবশ্য মা বাবা আর রুবির কথা মনে পড়লো তার, কিন্তু পরক্ষণেই সেগুলো ঝেড়ে ফেলে দিল সে। হুহ, ওসব ভাবালুতাকে পাত্তা দিলে তার চলবে না, আগে নিজে বাঁচলে তবে বাপের নাম। ছোটবেলায় বেশ সংবেদনশীল ছিল তার মন, কিন্তু বয়স এবং অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির সাথে সাথে সেসব অনুভূতির সূক্ষ্ম বাণ কেমন ভোঁতা হয়ে এসেছে। নাহিদ খুব আয়েস করে খেতে বসলো, বেশ এক রাশ আশা নিয়ে। কিন্তু সে অবাক এবং হতাশ নয়নে আবিষ্কার করলো যে তাদের টেবিলের এইদিকে কেউই আসছে না খাবার দিতে। সে একটু আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে দেখলো যে তার টেবিলে কে কে বসেছে। খুবই হতাশ নয়নে আবিষ্কার করলো যে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত সবচেয়ে নিম্নবিত্ত এবং হতভাগ্য লোকদের সাথেই তার বসার ‘সৌভাগ্য’ হয়েছে। প্রথমে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল সে। তারপরেও যখন কিছুই পরিবর্তিত হচ্ছে না, তখন তার ভেতরের সামুদ্রিক ফেনা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করলো। সে জোরে চিৎকার করে ওয়েটারকে ডাকলো। ওয়েটার পাশের একটা টেবিলে, যেখানে ধনী এবং প্রভাবশালী আমন্ত্রিত অতিথিরা বসেছে, সেখানে খাবার দিতে ব্যস্ত ছিল। প্রথমে বিয়েবাড়ির নানা হট্টগোলের মধ্যে তার কন্ঠ কারও কানেই প্রবেশ করলো না। কিন্তু ধীরে ধীরে তাকে দেখে টেবিলের অন্যান্য সদস্যরাও প্রতিবাদ জানাতে লাগলো। তাড়াহুড়া করে পিয়াল, তার বাবা এবং শ্বশুর এসে সেখানে হাজির হলো। তাদের হইচইতে কিছুটা ভয়ই পেয়ে গেছেন পিয়ালের শ্বশুর। বাঙালি পরিবারে বিয়েতে অতিথি খাওয়ানোতে কোন প্রকার ত্রুটি ঘটলে তা মানুষ খুন অপেক্ষাও বড়সড় অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। তারা নাহিদের টেবিলে কাচ্চির সবচেয়ে বড় মাংসের টুকরো এবং রেজালার সবচেয়ে বেশি ভালো অংশগুলো তুলে দিতে লাগলেন। নাহিদ কোন আপত্তি জানাল না, বহুদিন পর সে আজ খেতে বসেছে। প্রতিদিন দুপুরে মায়ের বানিয়ে দেওয়া শুকনো দুইটা রুটি দোকানে বসে কোনমতে শেষ করে সে, আর রাতে নিজের ঘরে ঘৃণা মিশ্রিত হৃদয়ে অতি কষ্টে গিলে নেয় সাবু মিশ্রিত একটুখানি দুধ। এছাড়া সারাদিন চা আর সিগারেট ছাড়া তেমন কোন খাদ্য তার অন্ত্রে প্রবেশের সুযোগ পায় না। আজ অনেকদিন পর সে খেতে বসেছে, তাও আবার পিয়ালের বিয়েতে, কেন প্রতিবাদ করতে যাবে সে?

খানিকক্ষণ পর পিয়ালের সাথে দেখা হলো তার আহার পরবর্তী সিগারেট টানতে গিয়ে। পিয়াল আগেই সেখানে ছিল, দেখা গেলো তার চোখ লাল হয়ে আছে। একটু আগে নাহিদ নিজেই ফিসফাস কিছুটা শুনেছে যে খাবার নাকি কম পড়েছে। যদিও তার একার একটা টেবিলে বেশি খাবার দেওয়ার জন্য এই খাবার কম পড়েছে এটা সে বিশ্বাস করতে চাইছিল না। তবে এ কথাও সত্যি যে পিয়ালের শ্বশুর তাদের টেবিলে যেভাবে করে খাবার দিয়েছেন, খাবার কম পড়লে অবাক হওয়ার কিছু নেই। পিয়ালের লাল চোখ আর ক্রমাগত সিগারেট টানা দেখে একটু ভয়ই যেন করে উঠলো নাহিদের। পিয়াল তার অনেকদিনের বন্ধু, অনেক অম্ল মধুর সময় সে কাটিয়েছে তার সাথে। কিন্তু আজকে মনে হয় একটু বেশিই হয়ে গেছে, একটু অনুতাপও হলো যেন নাহিদের। পিয়াল কিন্তু তাকে দেখে একটুও রেগে গেলো না, সে হাসিমুখে নাহিদকে কাছে ডাকলো। “আয় দোস্ত এদিকে আয়। ভয় পাচ্ছিস নাকি? ধূর পাগল। আমি কি ওরকম নাকি? ভয় পাস না। আচ্ছা শোন না, তুই এখন কি করে সংসার চালাস? শুনলাম তোদের নাকি অনেক অভাব এখন? খারাপই লাগে রে তোদের জন্য আহারে। চাচীর কথা আমার খুব মনে পড়ে জানিস? চাচী আমাকে যে আদর করতো আমার এখনও মনে আছে। যাই হোক আমি ভাবছিলাম তোকে একটা প্রস্তাব দেব। শুনতে চাস কিনা বল। “

নাহিদ ঠিক আশ্বস্ত হতে পারছে না। এটি কখনোই সম্ভব নয় যে পিয়াল এই কাহিনীর পর তাকে চাকরি বা টাকা উপার্জন নিয়ে কোন ভালো প্রস্তাব দিতে আসবে। মানুষতো আর ফেরেশতা না, আর পিয়াল তো আরও না। যার মুখমণ্ডলে দুঃখ বা রাগের ছাপ খুব  প্রস্ফুটিত ভাবে স্থান পায় না, তার হৃদয়ে সেই ছাপ এত গভীরভাবে খনন করা থাকে যে পরবর্তী কার্যক্রমে সেই প্রভাব খুবই দাহ্যতার সাথে চারপাশের সবকিছুকে দগ্ধ করে ফেলে। সে কিছুটা ভয়ে ভয়েই জিজ্ঞেস করলো “হ্যাঁ, বল কি প্রস্তাব?” পিয়াল খুবই সহৃদয়ভাবে তার কাঁধে হাত দিয়ে বললো, “শোন, তোর বোনটা তোর বাসায় থাকে, কি নাম যেন বললি, রুবি, তাই না?” 
“হ্যাঁ”
“তোর বোনটাকে মাঝে মাঝে আমার বাসায় পাঠিয়ে দিতে পারিস তো। “ 
“কেন?”
“শোন, বিয়ে তো করলাম। কিন্তু বুঝিস তো, এক বউ আর কয়দিন ভালো লাগে? আর এই বউ তো এর মধ্যেই খাওয়া শেষ আমার। মেয়ে রাজি ছিলো না, কিন্তু আমার খুব ভালো লেগেছিলো ওকে। একবার ভেবেছিলাম বিয়ে করবো না, কিন্তু ব্যাটার টাকা দেখে টাকার লোভটা আর ছাড়তে পারলাম না। আর বউ খাওয়া হলেও মেয়েটা ভালো, সহজ সরল আছে। নাহলে কি আর আমার মত লোককে বিয়ে করে? তুই বল, করে? হা হা। তো সেটাই বলছিলাম, এই বউ বেশিদিন ভালো লাগবে না আমার। মাঝে মাঝে পুরুষ মানুষের রিফ্রেশমেন্ট এর জন্য লাগে তো একটু অন্য জিনিস, বুঝতেই তো পারিস। তোর বোনটাকে দিস আমাকে। তোর তো চেহারা সুন্দর, তোর আপন চাচাতো বোন, ওইটাও দেখতে ভালই হবে, কি বলিস??”, চোখ টিপে বলল পিয়াল।
নাহিদ প্রথমে কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেলো। একটু সময় লাগলো তার পিয়াল কি বললো সেটা বুঝতে, বোঝার পর তার মাথায় যেন রক্ত উঠে গেলো। তার ভেতরে অনেকদিন ধরে জমিয়ে রাখা সামুদ্রিক ফেনার বর্ণিল স্রোত, যেন দুর্নিবার গতিতে পৃথিবীর মাটিকে আকর্ষণ করতে লাগলো। পিয়ালকে চরমভাবে আঘাত করার একটা প্রবল তৃষ্ণা সে অতি কষ্টে দমন করে, তারপর সেখান থেকে এক দৌড়ে বিয়েবাড়ি ত্যাগ করে। কিন্তু সেই ফেনিল স্রোত পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়তে লাগলো, প্রবল গতিতে। এই স্রোত অনেকদিন ধরে শক্তি সঞ্চয় করে চলছে, তার অম্লান গতি এখন ঘূর্ণিঝড়ের ন্যায় বিধ্বংসী, অনেকদিনের চাপা ক্ষোভ আজ তাতে পুঞ্জীভূত।

নাহিদ অনেক দূর চলে এসেছে বিয়ে বাড়ি থেকে। হটাৎ করে সে বুঝতে পারলো যে সে আর রাস্তার নিশানা ঠিক করতে পারছে না, অনেক বেশি রাত হয়ে গেছে। তার মোবাইলে চার্জ   প্রায়   শেষের  দিকে ছিল যখন সে ঘর থেকে বেরিয়েছে,  তাড়াহুড়ায়  সে আর ফোনে চার্জ  দিতে  পারেনি,  ফোন বের করে দেখল সেটা  বন্ধ  হয়ে  গেছে। আকাশের তারা দেখে রাত কয়টা বেজেছে এটা জানার একটা উপায় সে বাবার কাছে থেকে ছোটবেলায় শিখেছিল। কিন্তু অনভ্যাসের দাসও একইভাবে মানুষ, ঠিক যেমন অভ্যাসের। সে ঠিক ঠাহর করতে পারলো না রাত কয়টা বেজেছে। তার মনে পড়ে গেলো বহু পুরান এক সন্ধ্যার কথা। বুকের মধ্যে ক্রুদ্ধ গর্জনে বিষবাষ্পে শাণিত রক্ত হিম হয়ে আসলো তার। সে আর পিয়াল সেই ক্লাস সিক্স থেকে বন্ধু। পিয়াল তার থেকে দুই বছরের বড় ছিল কিন্তু সে বরাবরই পড়াশোনায় একটু কাঁচা ছিল, তাই শিক্ষকেরা তাকে বড় ক্লাসে ওঠানোর ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ পোষণ করতেন না। পিয়ালের সাথে নাহিদের বন্ধুত্বটা খুব অস্বাভাবিক কারণ দুইজন ঠিক দুই মেরুর বাসিন্দা। কিন্তু বরাবরই এমন হয়ে এসেছে, বহু পুরাতন নিয়ম এটি, তাই এই ব্যাপারে অধিকতর বর্ণনা নিষ্প্রয়োজন। তখন নাহিদের সবেমাত্র কৈশোর শুরু হয়েছে, লুকিয়ে লুকিয়ে কেবল পাশের বাসার রিতা চাচীর সুডৌল বক্ষ আর মাঝে মাঝে স্কুলের মেয়েদের একটুখানি বের হয়ে থাকা বুকের ভাঁজে চোখ ডুবিয়ে রেখেই তার   প্রস্ফুটিত   যৌবন সেসময় সন্তুষ্ট। তখনও পর্ণ বা এধরণের বস্তুর আমদানি ঘটেনি তাদের সেই ছোট শহরে। কিন্তু পিয়ালের কারসাজিতে একদিন নাহিদের উপনয়ন ঘটে গেলো এই ব্যাপারে। পিয়ালের বাবার কারখানার ব্যাবসা ছিল শহর থেকে কিছুটা দূরে। যখন তিনি থাকতেন না বাসায়, তার মা যেতেন এক পীর সাহেবের কাছে। পিয়ালের বড় বোন প্রতিবন্ধী ছিলেন, তাকে দরজা আটকিয়েই রাখা হতো অধিকাংশ সময়।  পুরা বাসা হয়ে যেত তখন পিয়ালের স্বাধীন রাজ্য। সে ইচ্ছামত বন্ধুদের নিয়ে এসে মদ গাঁজা এসব খেত এবং মাঝে মাঝে শোনা যায়, এটা অবশ্য আরও পরের কথা যে নষ্ট মেয়েমানুষও সে মাঝে মাঝে আনতো। হঠাৎ করেই একদিন নাহিদকে পিয়াল জোর করে তার বাসায় নিয়ে এসেছিল একটা মজার জিনিস দেখাবে বলে। তারপরই নাহিদের অভিষেক ঘটলো যৌবনের দূর্বার  আন্দোলনের মহাজাগতিক  প্রারম্ভে। কিন্তু তারপরেই এসেছিল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, যে ক্ষণ বদলে দিয়েছিল নাহিদের গোটা অস্তিত্বের মনুষ্য অংশটুকু, আর এখন যা জেগে আছে, সেটুকু শুধুই শ্বাপদ অংশ।  

সেদিন প্রথম হস্তমৈথুনের স্বাদ পায় নাহিদ, তারপরেই পিয়ালের কিছু বন্ধু এসে সেখানে হাজির হয়। তারা অবশ্যই পিয়ালের থেকেও ভয়ংকর, সূর্যের চেয়ে বালি তো সর্বদাই গরম হয়। তারা এসে নাহিদকে ওই অবস্থায় দেখে ফেলে।  দরজাটা ভালোমত আটকানো   পর্যন্ত  নাহিদ   আর সবুর   করতে  চায়নি কারণ পিয়ালের  তার  বন্ধুদের জন্য দরজা খুলতে যাওয়ার অবসরটুকু কাজে লাগিয়েই সে এই আচানক যন্ত্রণাটা শেষ করে দিতে চেয়েছিল। অনভ্যস্ত  হাতে   সে ঠাহর   করতে  পারেনি ঠিক কতটুকু  সময়   তার   প্রয়োজন  হবে এই উত্থিত  জোয়ারকে ভাটিতে  আনয়নের জন্য, নাহলে কি আর দরজাটা সে ভালো করে আটকাত না? অসতর্ক সেই  অবস্থাতেই পিয়ালের বন্ধুরা নাহিদের   ঘরে ঢুকে পড়ে এবং সমস্ত ব্যপারটা এত বেশি অতর্কিতে ঘটে যে সে কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি। সে হতচকিত হয়ে তাকিয়ে থাকে পিয়াল ও তার বন্ধুদের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই খুবই আয়েসের সঙ্গে তাদের মধ্যে যে সবচেয়ে মাস্তান গোছের, সে এগিয়ে আসতে থাকে নাহিদের দিকে, তারপরই নাহিদ তার পুরুষত্বের এক নির্মম পরিণতি দেখে। তারা   নাহিদের  কাছে  এসে বুঝতে পারে যে সে খুবই   অরক্ষিত  অবস্থায়  আছে। ভীতু  ও  দুর্বল  এই   ছেলেটিকে  দেখে তাদের খুব হাসি পায়, তার অপুষ্ট শরীরে  বারবার তারা  হাত বোলাতে  থাকে। যদিও  নাহিদের  বেআব্রু শরীর তাদের কামনাকে  জাগাতে পারে নি, কিন্তু তাদের  ভেতরে গভীরভাবে  প্রোথিত  পশুত্বকে জাগাতে পেরেছিল।  পরিশেষে  যা  পরিণতি  পায় তাদের দ্বারা নাহিদের ধর্ষণের শিকার হওয়ার  মাধ্যমে। এই অতি লজ্জিত অমানবিক জীবনকে খুব ঘৃণ্য মনে হয়েছিল সেদিন তার, বড্ড ঘৃণ্য। পিয়াল পুরো ঘটনায় একটুও বাধা দেয়নি, একবার দুইবার অবশ্য সে ওদের একটু নিষেধ করেছিল, কিন্তু তাদের দোর্দণ্ড প্রতাপে সেই সামান্য বালির আস্তরণের উপর যেন খুব সহজেই ঢেউয়ের ভাসমানতা মাথাচাড়া দিয়েছিল। সে   থেকেই ধীরে ধীরে সূচনা ঘটে নাহিদের বেপরোয়া উশৃঙ্খল জীবনের, সে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত প্রদীপের নিচের অন্ধকারের মতই কালো, কোথাও তার আর এতটুকু   আলো অবশিষ্ট নেই। সে জীবন হলো চাটুকারিতা, ভন্ডামি আর মোসাহেবি করে, মেরুদন্ডহীনতার সাথে জীবনকে শুধুই অতিবাহিত করার  চেষ্টা করে যাওয়া।

শেষ পর্যন্ত পথের নিশানা খুঁজে পেয়েছে নাহিদ, সে এসেছে বীণার কাছে। হ্যা বীণা তার প্রিয় নারী, বলা ভালো নারী শরীর। গত ছয় মাস ধরে সে নিয়মিত ভাবে বীণার কাছেই আসছে। বীণা বেশ ভালো, লক্ষ্মী মেয়ে। বাজারের মেয়ে না হলে সে হয়তো তাকে বিয়ে করে নিত।  মানুষের জীবন যতোই বিচিত্র হোক না কেন, কিছু নির্দিষ্ট শৃঙ্খলেই সে বাধা থাকতে চায়,  খুব   বেশি অপরিচিত বা  অদ্ভুত  জীবন  অধিকাংশ মানুষেরই কাম্য   হয়  না। নাহিদেরও উশৃঙ্খল জীবনের  ধার  ঘেঁষে তাই  বয়ে  চলে   মনে মনে একটি   শান্ত,  নিস্তরঙ্গ   জীবনের   আকাঙ্ক্ষা।  তবে  আজকে হটাৎ নিয়তির কোন  নির্মম পরিহাস নাহিদকে   এখানেই টেনে   এনেছে , তা সে বুঝতে  পারলো না। আজ তার হাতে পর্যাপ্ত পয়সা নেই। যেহেতু পয়সার   সংকট, সেহেতু সে এটা আশা করতে পারে না যে বাজারের মেয়ে তাকে যৌনসংগম করতে দেবে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে বীণা আজকে তাকে দেখে খুব খুশি হয়ে গেলো, মিষ্টি একটি হাসি ফুটে উঠল   তার মুখে।  সে নাহিদকে নিজে থেকেই আমন্ত্রণ জানালো।

সঙ্গমের  প্রতিটি   বাঁকে নাহিদ   যেন প্রতিশোধ নিচ্ছিল আজ থেকে বিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া একটি অযাচিত যৌন সঙ্গমের।  সেই ঘৃণ্য  অধ্যায়  কি  মহাকালের আলেখ্য পথে একটি কালো বিন্দুও রেখে যায়নি? হয়তো গিয়েছে, সেটুকু ভেবেই নাহিদ খুশি হয়।  এর   বেশি কিছু আশা করার সাহস তার  হয়না,  সে নিরীহ,  ভীতু  প্রকৃতির ।  শুধু   মনের  মধ্যে উত্থিত  হওয়া সামুদ্রিক ফেনিল স্রোত  তার  হৃদয়কে  প্রায়শই কলুষিত করে। অবশ্য  তখন নাহিদ   নিজেকে সান্ত্বনা  দেয় এই বলে যে হয়তো কালের গর্ভ   থেকে  জাগ্রত  হওয়া প্রতিটি ভ্রূণ একবার হলেও সেই গেঁথে যাওয়া কালো বিন্দুর স্বাদ তাদের   জীবদ্দশায়  আস্বাদন করে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এভাবেই  সে  নিজেকে বুঝিয়ে  সুঝিয়ে  জীবনের  ভঙ্গুর পথে  নিজের আত্মাকে  বয়ে  নিয়ে যায়।

“আপনি আজকে আমারে এমন করে লাগাইছেন ক্যান? আমার কষ্ট হইছে, ব্যাথা হইছে। কেন আমারে এমনে ব্যাথা দিলেন, আপনি তো অন্য কাস্টমারগো মতন এমুন করেন না কখনো?,” বীণা ব্লাউজ  পরতে পরতে দুঃখমিশ্রিত গলায় বললো। নাহিদের বেশ খারাপ লাগলো। সে আসলে তখন এই বেশ্যাপল্লীর মাটিতেই অবস্থান করছিল না, সে তখন বিচরণ করছিলো অন্য এক ভুবনে, যেখানে সবাই তাদের অন্যায়ের প্রকৃত বিচার পায়, সকলে তাদের অধিকার ঠিকমত উপভোগ করতে পারে। সে  বীণার   মাথায়  আদর করে হাত বুলিয়ে   দিল। নাহিদের মাথায় আজকে খুব ভালো একটি পরিকল্পনা এসেছে, যা দিয়ে সে পিয়ালকে শায়েস্তা করার একটা চেষ্টা অন্তত করে দেখতে পারে। যদিও সে জানে না এটাতে কতটুকু সফল হবে, কিন্তু ঝুঁকি   সত্ত্বেও চেষ্টা  না করলে মানবসভ্যতাই কি গড়ে উঠত আদৌ? 

তার মনে সুপ্তাবস্থা থেকে জেগে উঠলো আজ থেকে বহু আগের এক রাতের কথা। নাহিদ তখনও জানত না যে পিয়াল সেদিনের সেই মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী ছিল। সে বরং  জানতো যে পিয়াল তাকে সেদিন সুস্থ করে তুলেছিল কারণ জ্ঞান ফিরে সে প্রথম পিয়ালকেই দেখেছিল তার পাশে বসে থাকতে। তারপর থেকে সে সারাজীবন পিয়ালের পাশে থাকবে, তাকে প্রিয় বন্ধু ভাববে এভাবেই চিন্তা করতো। প্রকৃত ঘটনা সে জেনেছিল আরো অনেক পরে, সত্যি বলতে বর্তমানের  যে ঘটনা বর্ণিত হচ্ছে তার মাত্র দুই তিন বছর আগে। কিন্তু তারপরেও সে পিয়ালের সাথে যোগাযোগ রেখেছে শুধুমাত্র “স্বার্থ উদ্ধার” এর স্বার্থেই। সেই অনেককাল আগে নাহিদ আর পিয়াল যখন সদ্য কৈশোর পেরোনো যুবক, একদিন রাতের  বেলায়  ছাদের  ওপর  মদ খেতে খেতে পিয়াল তার  একটা গোপন  কথা নাহিদকে বলেছিল।
 
“জানিস, আমার না একটা খুব বাজে ভয়ের জিনিস আছে। শিক্ষিত লোক একে বলে ফোবিয়া। পরে আমি প্রফেসর সাহেবকে জিজ্ঞেস করে জেনেছি এটার নাম। প্রফেসর সাহেব তো বুঝেছিস? আমাদের এই শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ের যে প্রফেসর আমাদের এই শহরে অবসরের পর থাকেন। ঐযে সবাই কোন তথ্যের প্রয়োজন হলেই তার কাছে যায়?“
“হ্যাঁ, চিনেছি। তুই কাহিনী বল। “
“উনাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম জিনিসটা সম্বন্ধে। আমার এই ফোবিয়াটা হলো গর্তের প্রতি ভয়। যেকোন ছোটো ছোটো গুচ্ছ গুচ্ছ অনেকগুলো গর্তের সমাহার থাকলে সেটা দেখলে আমার প্রচন্ড ভয় হয়। সারা শরীর শিহরিত হয়ে প্রচণ্ড বমি পায় আর খুব খারাপ লাগে শরীরের মধ্যে। প্রফেসর সাহেব বলেছিলেন এটার নাম ‘ট্রাইপোফোবিয়া‘। আমার এই জিনিসটা কোথেকে এসেছে সেটা জানিনা, তবে আম্মারও নাকি ছিল কিছুটা। সাধারণত  মেয়েদের  এটা   বেশি থাকে, কিন্তু আমার মধ্যে  কিভাবে  যেন এটা এসেছে। এটা আমি কাউকে সাধারণত বলি না যদি কেউ এটা দেখিয়ে আমার ক্ষতি করতে চায় সেই ভয়ে, কিন্তু তোকে আজকে বললাম। তুই তো দেখি আজকাল আমার জন্য অনেক করিস। “
“তোকে তাহলে আজকে আমার একটা কথা বলি। আমার জীবনের একটা ইচ্ছা আছে জানিস? আমি একবার একটা বিশেষ নেশার জিনিস চেখে দেখব। আমি একবার বান্দরবান গিয়ে একটা বিশেষ ধরণের ছত্রাক দেখেছিলাম। স্থানীয় লোকের কাছে শুনেছিলাম যে ওই জিনিস খেলে মানুষ নাকি ঈশ্বরের কাছে চলে যায়। আমি জানি এগুলো সত্যি না, ভুংভাং কথা। কিন্তু আমার খুব ইচ্ছা চেখে দেখার। তবে শুনেছি যে ওই জিনিস নাকি অনেকে সহ্য করতে পারে না। বেশি খেলে ওই জিনিস নাকি মানুষ ভুলভাল দেখে, এমন জিনিস দেখে যার কোন অস্তিত্ব নেই। কিন্তু একবার চেখে দেখলে দোষ কি বল?”
“ওরে বাবারে, আমি ওই জিনিস খেতে যাবো না। আমার যে মাথায় সমস্যা, এমনও হতে পারে যে ওই জিনিস খেলে আমি সারাদিন দেখব রাস্তাঘাটে ঘরে বাইরে সবখানে শুধু ছোটো ছোটো গর্ত ভরে আছে, হা হা। “
“ধূর কি যে বলিস তুই,”
তারপর দুই বন্ধু মিলে বোতলের শেষ সুধাবিন্দুর চুমুক গ্রহণ করে পরম তৃপ্তিতে শয্যা নিয়েছিল ছাদের ওপর পূর্ণিমা চাঁদের সুনীল শতরঞ্জিতে।

আজ এতদিন পর নাহিদের সেই কথা মনে পড়লো এবং সে অবাক হয়ে ভাবলো এই বৃদ্ধি  তার  মাথায় আগে আসেনি কেন? এই তথ্যটি  তার জন্য অনেক মূল্যবান একটি রত্ন। আসলেই পৃথিবীতে জ্ঞানের চেয়ে বড় সম্পদ আজ পর্যন্ত মানবজাতি অর্জন করতে পারেনি। সে কালকেই যাবে, যাবে সেই গহীন বনের অন্তরালে। সে কিছুদিন আগেই খবরে দেখেছে, বান্দরবানে পুলিশ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে। সে যাবে, বনের অনেক গহীনে গিয়ে  সেই ছত্রাক সে নিয়ে আসবে। কৈশোরে এমনকি যৌবনের প্রারম্ভেও বনজঙ্গল ঘুরে বিভিন্ন অজানা উদ্ভিদ সম্বন্ধে জানা  এবং উদ্ভিদ সংগ্রহের একদমই অকাজের শখকে আজকে সে কাজে লাগাবে।   সেই  দুর্বিষহ  সম্ভোগের  শিকার  হওয়ার পর থেকে মানবজাতি থেকে উদ্ভিদকেই তার  বেশি আপন মনে হয়,  তাই  সে বিভিন্ন  বনজঙ্গলে  পাগলের মতন ঘুরে বেড়ায়,  আর  এই তুচ্ছ, ন্যক্কারজনক  জীবনের   পথে   একটু  আলো খুঁজে  চলে ।  সে  সেই জাদুর  ছত্রাক  নিয়ে  আসবে, তারপর নেশার অতল গহবরে অবগাহন করবে।  প্রথমে অস্তিত্বের সেই অতন্দ্র প্রহরীকে স্পর্শ করবে, যে প্রহরী মানুষের অবচেতনকে তন্দ্রাচ্ছন্ন করে রেখে নিজে অতন্দ্রভাবে জেগে থাকে। সেই প্রহরীকে জাগিয়ে তুলে প্রথমে  সে নিজের অস্তিত্বের সীমারেখা অনুভব করবে। সে তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া বন্ধুর কাছে শুনেছে, এই ছত্রাক নাকি এক প্রকার সাইকাডেলিক ড্রাগ না কি যেন বলে একে। তাতে কি? তার এত জ্ঞান নিয়ে কি হবে? সে খুঁজবে নিজেকে, আর সেই ড্রাগ দিয়ে সে পিয়ালকেও নিজেকে খোঁজার একটা সুযোগ করে দেবে। খুব বিপর্যস্ত একটি সময় পিয়ালের জন্য অপেক্ষা করছে। অবশ্য পিয়াল নিজেই এত হীন একটি সত্তা, বিপর্যস্ত একটি সময়ই তার নিজেকে চেনার প্রকৃত পরিচায়ক। হায়রে নাহিদ, তুমি নিজেও কতটা নিকৃষ্ট সত্তা হয়ে জড়িয়ে রয়েছ এই পৃথিবীর পথ, সে যদি তুমি জানতে। সবাই নিজেকেই সবচেয়ে অবহেলিত, বঞ্চিত আর ভালমানুষ হিসাবে ভাবতে  ভালোবাসে, আর   এভাবেই তুচ্ছ মানবজীবনকে   মহিমান্বিত  করে তারা  আশ্বস্ত থাকে।

নাহিদের বাসার একদম কোনার  দিকে  তার নিজের  ছোটো  একটা ঘর   আছে। সারাদিনের   কষ্ট  এবং ক্লান্তির   অক্লান্ত   প্রলেপ  মোছার  জন্য একটি আলাদা  ঘর  তার খুব প্রয়োজন  হয়। এই  ঘরটি   জানে নাহিদের সকল অব্যক্ত কান্নার লহরী, যা  জগতের  কাছে অপাংক্তেয়।  পিয়াল নাহিদের   সেই ঘরে বিছানার   ওপর  জবুথবু ভাবে শুয়ে আছে। বেশ অনেকদিন পর নাহিদের সাথে মদ খেতে বসেছিল সে, নাহিদই তাকে নিজের বাসায়  আমন্ত্রণ করেছিল। পিয়াল সেদিনের পর একটু ভয় পেয়েছিলো এটা ভেবে যে নাহিদকে কিভাবে মোকাবেলা করবে, কিন্তু নাহিদ বিষয়টা এত সহজভাবে নিয়েছে দেখে সে অবাকই হয়েছিল। অবশ্য খুব   বেশিও  হয়নি,  ছোটলোক টাইপের ছেলে তো, তার উপর মাইজ্ঞা স্বভাবের, এমনই তো হবে। প্রকৃত পুরুষমানুষ হলে কি আর একটু প্রতিবাদ করতো না? সারাজীবন নাহিদকে ভেবে এসেছে তার ‘বিচি‘ নেই, সেই নাহিদ নাকি নিয়মিত বেশ্যাপল্লী যায়, এই কথা শুনে আজকে সে অবাকই হয়েছে। কিন্তু সে যাই হোক, মদ খাওয়ার পর এতটা বিরিয়ানি খাওয়া তার ঠিক হয়নি, অনুরোধে ঢেঁকি   গিলতে   হয়েছে তার। নাহিদ   মদ  খাওয়াবে  শুনে সে আনন্দের সাথে রাজি হয়েছিল তার বাসায়   আসার  জন্য,  কিন্তু প্রায়   অর্ধেক বোতল  মদ   খাওয়ার  পর নাহিদ তাকে এত জোর   করলো বিরিয়ানি  খেতে, বারবার বলতে লাগলো যে  তার মা নাকি অনেক কষ্ট করে রান্না করেছেন। কি  যেন এক বিশেষ মশলা দিয়েছেন নাকি তিনি বিরিয়ানিতে, কি যেন কুচি  কুচি করে মেশানো হয়েছিল,  যদিও  তার তেমন  কোন স্বাদ   পিয়াল  বুঝতে  পারেনি। বরং জিনিসটা  একটু   তেতো   লাগছিলো ।  কিন্তু পিয়ালের  মা  কষ্ট করে রান্না করেছেন তাই পিয়াল  খেয়েছে  পুরোটা।  কিন্তু মদ খাওয়ার পর এতোটা বিরিয়ানি খেতে একদমই পিয়ালের মন সায় দিচ্ছিলো না, কিন্তু তাও জোর করে খেয়েছে। আর সেটা  খাওয়ার  পর থেকেই কেমন যেন তার শরীরটা খারাপ লাগছে। সে এখন তাই  নাহিদের বাসায়   তার   ঘরেই   শুয়ে আছে। মদ খেয়ে তার উপর আবার এতটা বিরিয়ানি খেয়ে বাসায় যাওয়ার রুচি বা সাহস কোনোটিই তার হয়নি। নাহিদের  ঘরটিও এত  জীর্ণ  এবং দুস্থ  অবস্থায়  আছে,  খুবই বিরক্তিকর   লাগছে পিয়ালের,  আজকাল তো এসি  ছাড়া ঘুম আসতেই চায় না তার। যদিও কিছুদিন ধরে বাসায়ও খুব সমস্যা যাচ্ছে। বউয়ের সাথে বনিবনা হচ্ছে না তার, বিয়ের আগে যে বউকে মনে হয়েছিল খুব সহজ সরল, বিয়ের পর সেই বউই তার মায়ের সাথে এত খারাপ ব্যবহার শুরু করেছে যে বলার বাইরে। তার ওপর আবার  বউয়ের বাচ্চাও নাকি হবে। পিয়ালের তো এখন এমন সন্দেহও হচ্ছে যে বাচ্চা কি আসলেই তার কিনা। তাছাড়া কাজের ক্ষেত্রেও কর্মচারীরা এত টাকা এদিক সেদিক করছে, একা পিয়াল আর তাল রাখতে পারছে না। সব মিলিয়ে পিয়াল আজ ইচ্ছা করেই একটু বেশি মদ খেয়েছে যাতে সবকিছু একটু ভুলে থাকতে পারে কিছুক্ষনের জন্য। কিন্তু এখন বিরিয়ানী খেয়ে তার মন ও শরীর  দুইই  বেশ খারাপ লাগছে। কিছু একটা মিশিয়েছে নাহিদ এর মধ্যে, নিষ্চই মিশিয়েছে। কিন্তু ও কি?? হটাৎ করে পিয়াল সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠলো।

নাহিদ পিয়ালের মাথার পাশেই বসে আছে। সে পিয়ালের যাত্রাটা নিজের চোখে দেখতে চায়। সে নিজেও দুইদিন আগেই এই জিনিস খেয়েছে। সেও বিরিয়ানির সাথে মিশিয়ে খেয়েছে, পিয়ালকেও তাই খাইয়েছে কারণ সে নিশ্চিত হয়ে নিতে চেয়েছিল খাবারের সাথে মিশিয়ে জিনিসটা খেলে কি একইরকম ফলপ্রসূ হয় কিনা। সে যদিও পিয়ালের মত এত ভয়ংকর অবস্থায় পতিত হয়নি কারণ সে সতর্ক ছিল। কিন্তু একটু আগে সে পিয়ালকে ইচ্ছা করেই কিছু প্রকাণ্ড গর্তগুচ্ছ যুক্ত  প্রবালের ছবি দেখিয়েছে, আরো কিছু ভয়ংকর গল্পও করেছে। তার খালার বাসায় সেইদিন কিভাবে গরু কাটা হয়েছিল এবং গরুর সারা শরীরে অনেক বেশি ছোট ছোট গর্ত হয়ে গিয়েছিল, গরুর নাড়িভুঁড়িগুলো ঠিক কিভাবে একটা আরেকটাকে জড়িয়ে ধরে রেখে প্রবল বিক্রমে গরুটিকে মৃত্যুযন্ত্রণা থেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছিল, তাছাড়াও কিভাবে সেদিন তার চাচাতো ভাইয়ের মাথায় অনেকগুলো ছিদ্র করে একটা লোহার ডান্ডা ঢুকে গেছে এবং সেইদিন হাসপাতালের সামনে কিভাবে এক লোকের হাতের তালুতে অনেক গুলো ছিদ্র ডাক্তার আপা সারিয়ে তুলছিলেন। এইসব গল্প শুনতে পিয়ালের একদমই ভালো লাগছিলো না কিন্তু মদ তারপর আবার বিরিয়ানি  খেয়ে  সে বেহুঁশ এর মত পড়ে ছিল, তাই তেমন কোন প্রতিবাদও করতে পারছিল না। একটু   আধটু   প্রতিবাদ   করলেও নাহিদ জোর   করে এসব গল্প   শুনিয়েই   যাচ্ছিল তাকে। তাই যখন পিয়ালের চিৎকার নাহিদ শুনলো, সে একটুও অবাক না হয়ে পিয়ালকে জিজ্ঞেস করলো যে সে কি দেখতে পাচ্ছে।  

“নাহিদ ঐটা সরা ঐখান থেকে। ওইটা কি রে? দেয়ালের মধ্যে অনেক গুলো ফুটা করে কে রেখেছে? তাছাড়াও দেখ দেখ ফুটা গুলো থেকে অনেকগুলো পোকা বের হচ্ছে। “
“কি বলছিস অবাস্তব কথা। দেয়াল সরাবো কিভাবে? দেয়াল তো ঐখানেই থাকবে। পোকাই বা কিভাবে সরাবো?”
“আরে কি বলিস? পোকা তো দেখি আমার দিকে আগাচ্ছে। কিরে তোর চেহারা হটাত করে এমন লাগছে কেন? তোর সারা মুখে ওসব কি? সারা মুখে গর্ত কেন তোর? আমি এসব কি দেখছি রে? আমি এগুলো কেন দেখছি?“
নাহিদ মাথা নাড়তে লাগলো। তার একটু ভয় করছে। বেশী হয়ে গেলো নাকি বিষয়টা? দেয়াল ঠিক আছে কিন্তু তার মুখেও  এখন ফুটা দেখছে, ভয় করছে তার।  
“এই নাহিদ কিরে। আমার হাতেও তো ফুটা। সারা শরীরে ফুটা, ছোটো ছোটো অসংখ্য ফুটা আমার সারা শরীরে। কিরে? আমি কি করব রে? আমার হাত শরীর সব কেটে ফেলব? এই নাহিদ এই। “
নাহিদ ভয় পাচ্ছে, খুব ভয় পাচ্ছে সে। পিয়াল পশুর মত গোঙাচ্ছে।  

বেশ কিছুদিন পর। পিয়ালের সেই অসুখ আর সারেনি। সে তার মা এবং স্ত্রী দুইজনকেই দেখেই ঘৃণায় বমি করে দিয়েছে এমনকি তার মায়ের শরীর দেখেই সে চিৎকার করেছে যে সেখানে নাকি অনেক ছোট গর্ত। ছোটবেলায় তার মা তার প্রতি যে অত্যন্ত নির্মম আচরণ করেছিলেন তার প্রত্যেকটা ছোট ছোট মুহূর্তগুলো একেকটা গর্তের রূপ নিয়ে তার মায়ের সারা শরীরে ফুটে উঠেছে  যেন। মায়ের স্নেহবঞ্চিত এবং অপরের ওপর কর্তৃত্ব করে চালিয়ে নেওয়া অকিঞ্চিৎকর জীবনের সারিবদ্ধ যাতনাকে একগুচ্ছ গর্তের মাধ্যমে তার মায়ের এবং নিজের শরীরে প্রকাশিত হতে দেখতে শুরু করেছে সে। এমনকি স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে সে তাকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য পাগলের মত চিৎকার করে উঠেছে, আয়না দেখলেও প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছে। তার স্ত্রীর শরীরের প্রতিটা বাঁক, যে বাঁকগুলোকে ভালোবেসে সে তাকে নিয়ে ঘর, বলা ভালো একটি শয্যা সাজানোর উদ্দেশ্যে বিয়ে করেছিল, সেই শরীরের প্রত্যেকটা ইঞ্চিতে সে দেখতে পাচ্ছে অসংখ্য ছিদ্র, প্রত্যেকটা ছিদ্র থেকে একেকটা কুৎসিত দর্শন পোকা কিলবিল করে বেরিয়ে আসছে। তার নিজের শরীর, শত পাপে যে শরীর আজ নরকের কীট এর মত অসংখ্য পোকার আস্তানা, যাদের সে দেখতে পাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে নিজেদের গর্তস্বরুপ আস্তানা থেকে কিলবিল করে বেরিয়ে আসতে। সহ্য করতে না পেরে  সে তার হাত কব্জি থেকে কেটে নেওয়ার চেষ্টা করেছে বেশ কয়বার, ফলস্বরূপ তাকে ঢাকা মেডিক্যালের মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগে ভর্তি রাখা হয়েছে।  

নাহিদ কিছুদিন পর পিয়ালকে দেখতে এসেছে। একদিন সে পা দিয়ে চেপে একটি তেলাপোকার নাড়িভুঁড়ি বের করে ফেলেছিল। বহুদিন পর্যন্ত সে তার পায়ের নিচে পিচ্ছিল কি যেন অনুভব করত, বহুবার পা সাবান দিয়ে ধোয়ার পরেও। তেলাপোকাটা চিৎ হয়ে পড়ে অনেকক্ষণ পা কিলবিল করে নাড়িয়ে একটু বাঁচার চেষ্টা করেছিল। পিয়ালকে দেখে সেই তেলাপোকার কথা তার মনে পড়ে যায়। পিয়াল সম্পূর্ন সুস্থ একজন মানুষ, কিন্তু শুধুমাত্র তার চিন্তন প্রক্রিয়ার সজ্জিত সারির কিছু নির্দিষ্ট সজ্জা স্থানচ্যুত হয়ে যাওয়ার জন্য আজ সে সেই চিৎ হয়ে যাওয়া তেলাপোকার মতই বাঁচার চেষ্টা করছে। তাকে একটু চিৎ অবস্থা থেকে সোজা করে দিলেই সে স্বাভাবিক ভাবে জীবন যাপন করতে পারবে। কিন্তু কিছু জিনিস আছে যা একবার স্থানচ্যুত করলে নির্দিষ্ট অবস্থানে আর ফিরিয়ে আনা যায় না। হয়তো সমস্ত  জীবনই  পিয়াল  এভাবেই ভয়ংকর একটি কাল্পনিক বাস্তবতায়  বেঁচে  থাকবে।  কিন্তু সে নিজেও কি অসুস্থ হয়নি? নাহলে প্রতি রাতে সে পিয়ালের ফুটা দেয়ালকে নিজের ঘরে প্রতিস্থাপিত হতে দেখে কেন? কেন দেখে বীণার  শরীরে  হরেক ছিদ্রের  বর্ণিল সমাবেশ, যে বর্নিলতা  মুগ্ধ করে না, বরং প্রচন্ড রকম পীড়া দেয়?

news24bd.tv/ ডিডি
 

এই রকম আরও টপিক