পালকের চিহ্নগুলো

অলংকরণ:কামরুল

কিস্তি-২

পালকের চিহ্নগুলো

নাসরীন জাহান


আমি আগেই লিখেছি,আংটি পড়াতে এসে আশরাফের সাথে আমার কাবিন পরানোর কথা। কাবিনের চারমাস পরে আমার আয়োজন করে বিয়ে হয়।

কিন্তু কাবিনের কয়েকমাস আগে একটা ঘটনা ঘটে, যা এখানে না লিখলেই নয়। আমরা মিনাবাজার করে একেকজন একেকটা রেস্টুরেন্ট দিয়েছিলাম।

 
তখন আনন্দমোহনে পরা একজন ছেলে যে ভালো গান গাইতো এবং অভিনয় করত,সে রেস্টুরেন্টে চটপটি খেতে এসে আমার প্রেমে পড়ে যায়।  শর্টকাটে লিখতে গেলে তাই হয়েছিল।
প্রচুর মেয়ে  হ্যান্ডসাম  সেই ছেলের   পড়ত। যথারীতি আমাকে পাত্তা দিতে না দেখে  সহজ হিসেবে আমার প্রতি তার আকর্ষণ বেড়ে যায়।
সে আমার গতিবিধি লক্ষ করতে করতে একদিন আমাদের বাসায় চলে আসে। আমাকে নিজের ভালোলাগার কথা জানালে,আমি স্পষ্ট জানিয়ে দিই,আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি,জলদিই আমাদের বিয়ে হবে।  ছেলেটা প্রথম একটু ধাক্কা খায়,এরপর নিজেকে সামলে বলে, আমি আসলে আনন্দ মোহন কলেজের নতুন বরণ উৎসবের জন্য আপনার কাছ থেকে একটা স্ক্রিপ্ট চাইতে এসেছি। আমি প্রোগ্রামের সবকিছু আপনাকে দেব,প্লিজ আপনি একটা সুন্দর স্ক্রিপ্ট তৈরি করে দিলে খুব হেল্প হবে আমার।
আমি বলি,আমি যে সাহিত্য করি,আপনি কীভাবে জানেন?
সে তখন জানায় মিনা বাজারের আগেও দু তিনটা সাহিত্য অনুষ্ঠানে আমাকে দেখেছে,কিন্তু সামনে আসেনি।
আমি যত তাকে এড়াতে চাই,ততো তার অনুরোধ তীব্র হতে থাকে।  
একটা পর্যায়ে তাকে এড়ানোর জন্য আমি রাজি হয়ে যাই।

এরমধ্যে আমি নানাদিকে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। এই ধরনের কাজে আমার আগ্রহ নেই বলে আর এগোয় না কাজটা। এরমধ্যে এই স্ক্রিপ্টের জন্য দুদিন এসে ঘুরে যাওয়ার মুখে বলে, এতটা অহংকার ঠিক না,যে কাউকে কথা দিলেও সেটার গুরুত্ব যখন থাকে না। জীবনে কথা দিয়ে মোটামুটি ভালো কিছু বিপদে পড়েছিলাম,এরমধ্যে এটা উল্লেখযোগ্য।  
ছেলেটার কথা, সৌন্দর্য আমাকে যে যে টানেনি,তা নয়। কিন্তু এটা একটা তাতক্ষণিক বিষয়। আমি তো ঢাকায় আশরাফ আর আমার  সংসার করার জন্য 
ততোদিনে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছি।
ছেলেটার শহরে বিশাল বাড়ি।
দেখা,শিল্পগুণ সব মিলিয়ে নিজের প্রতি গভীর আস্থায় সে ভেবেছিল,আমি বিয়ের কথা তাকে এড়াতে বলেছি। মিন করিনি।

এরমধ্যেই আমার কাবিন হয়ে যায়।
সেই ছেলে নাকি আমার কাবিনের পরদিন কার কাছে শুনে রুবীর বাসায় এসে খুব কেঁদেছিল। আমার মন খারাপ হয়ে যায়। এই সব কথাই আমি চিঠিতে,সামনাসামনি আশরাফকে শেয়ার করতাম।  

ছেলেটা নিজেকে সামলে এক মাস পরে আসে।
আমি স্ক্রিপ্ট তৈরি রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম, রুবীর কাছে দিয়ে রাখব। যা হোক,সে  স্ক্রিপ্ট নিয়ে চুপচাপ চলে যায়।  আমার দিকে ঠিকঠাক তাকায় না পর্যন্ত।  

এরমধ্যে একজন আমাকে  জানায় আমাকে আনন্দ মোহন কলেজের বাংলার টিচার একবার যেতে বলেছেন।
আমি যাই। দেখি সেখানে ছেলেটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। সপ্তাহ পড়ে অনুষ্ঠান।  
টিচার বলেন,আমি নানা জায়গায় তোমাকে ছড়া,গল্প পড়তে শুনেছি,তোমার অসাধারণ স্ক্রিপ্ট উপস্থাপন করার মতো স্টুডেন্ট পাওয়া মুশকিল, আমি খুব খুশি হব,তুমি যদি উপস্থাপনা কর।
আমি যত এড়াতে চাই ততোই স্যার আমাকে নানাভাবে বোঝাতে থাকেন।  

পরে মনে হল,এক দু মাস পরে তো ময়মনসিংহ ছেড়ে চলেই যাব,করে যাই না হয় অভিজ্ঞতার বাইরের একটা কাজ।
পুরো অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিল সেই ছেলে। আমি আশরাফকে উস্কাতে কেবলই ছেলেটার রূপ,অভিনয়, গানের প্রশংসা করতাম।  আশরাফ কেমন যেন একটা প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে গিয়ে নার্ভাস হয়ে যেত।
আমি কল্পনাও করিনি,এইসবের জের এদ্দুর গিয়ে ঠেকবে।  

আশরাফ যথারীতি ছেলেটাকে নিয়ে জেলাস ছিল, বলেছিল যথাসম্ভব এড়িয়ে চল,

কিন্তু আমার কেবলই মনে হচ্ছিল,আমি ভুল কিছু করছি না।  
তখন চিঠির যুগ।
আমি আশরাফের একটা চিঠি কীভাবে যেন মিস করি,যেখানে লেখা ছিল, সে আগের মতোই সারাদিনের জন্য ময়মনসিংহ আসছে।  যেদিন আসার কথা লিখেছিল,সেদিনই আমার আনন্দ মোহনের অনুষ্ঠান।  আশরাফ পাশের বাসায় ফোন করে আমাকে ডেকেছিল,ওরা সবসময় ডেকে দেয়,সেবার ওদের বাডিতে কেউ ছিল না বলে তারা আমাকে জানিয়ে দেবে বলে আমাকে আস্বস্ত করে।  
তারাও হঠাৎ একটা বিপাকে পড়ে ভুলে যায়।
আমি যখন মঞ্চে অনুষ্ঠান করছি, আশরাফ আমাদের বাসায় আসে। বাসায় অত বিস্তারিত জানিয়ে যাইনি।   সাহিত্যের অনুষ্ঠানে যাচ্ছি,আমাদের বাসায় এটুকু জানানোই যথেষ্ট ছিল।  

টেলিফোনহীন,মোবাইলহীন অবস্থায় আশরাফ বাসায় বসে আমার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।  যখন বিকেল গড়াচ্ছে,আমার ছোটভাই জুয়েল আশরাফকে বলে,একটা সুন্দর ছেলে দুদিন এসেছিল,তারা কীসব কাগজ হাতে নিয়ে কথা বলেছে। আশরাফ তার নাম বললে জুয়েল বলে, হ্যাঁ, উনিই।

আশরাফ আর কোন কথা না বলে সবার অনুরোধ উপেক্ষা করে বেরিয়ে যায়।

আমি সন্ধ্যায় ফিরি।
আমাদের বাড়ির সবাই আমার তখন আমার ওপর মহা  ক্ষিপ্ত!

আমার বাসায় তোলপাড় শুরু হয়। তুই কী ওই ছেলের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছিস?তুই কী এই বিয়ে ভেঙে দিতে চাস? এরা এসব কী বলছে?মাথা খারাপ হয়ে গেছে এদের?
আমি অস্থির হয়ে বড়ভাই শিপনকে বলি,আমাকে জলদি ঢাকায় নিয়ে চল।

সারারাত জার্নি করে শংকরে আশরাফের দোতলা সুন্দর ফ্ল্যাটে এসে দেখি,ঘড়িতে সকাল এগারোটা বেজে গেছে।  নিশ্চিত আশরাফ অফিসে চলে গেছে ভেবেও দরজার সামনে দাঁড়াই।
ভেতর থেকে বন্ধ।
আশ্চর্য! 
সবচেয়ে তাজ্জব আমরা নক করে করে দরজা ভেঙে ফেলার উপক্রম করছি,দরজা খোলার নাম নেই। ভয়ে সারা শরীর যেন অজগর প্যাচিয়ে ধরে।  
প্রচন্ড শব্দে দরজা খুলে যায়।   সামনে একেবারে অচেনা আশরাফ দাঁড়ানো।  চোখ ডুমুরের মতো লাল,সারা মুখ ফুলে আছে, হাতে রংবাজের মতো হুইস্কির বোতল,সে টলছে। শিপন ভাই অপ্রস্তুত হয়ে বলে আমি একটু ঘুরে আসছি।
আমি তাকে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকি। আশরাফ আমাকে ঘোলা চোখে দেখে বলে, আপনি কে?
কান্ড!
আমি জানি আশরাফের ছোটবেলার বন্ধু মোহাম্মদ সাদিক এখানে থেকেই বিসিএসের  পড়াশোনা করছে। বেশ ক'বার দেখা হয়েছে।  সে তো সাহিত্য পাড়ায় ঘুরতে পারলে বাঁচে। ( অবশ্য সে একদিকে কবি অন্যদিকে সচিব হয়। বর্তমানে সে এম পি, আশরাফের তার পেছনে লেগে থাকার প্রচেষ্টা সফল হয়) এজন্য আশরাফ অফিস যাওয়ার পথে তাকে তালা দিয়ে যায়। আশরাফের এই অবস্থায় সাদিক কোথায়? 
এ এক অদ্ভুত গল্প! সারা ঘরে বোতল ছড়ানো। আশরাফ সারারাত পান করে আমাকে তার প্রেমিকা নাসরীনের গল্প শোনাতে থাকে।  যে একটা হ্যান্ডসাম ছেলের সাথে চলে গেছে। আমি তাকে যত বোঝাই,নাসরীন যেতে পারে না,ততো ক্ষুব্ধ হয়ে বলে,তুমি জানো না,এর আগে এমন হয়নি,আমার চিঠি পেয়ে,ফোনে খবর পেয়েও সে ওই ছেলের সাথে চলে যাওয়ার জন্য আমার যাওয়ার ব্যাপারে বাসায় কিচ্ছু জানায়নি। এটা আমার এক তরফা ভালোবাসা,আমি বুঝতে পারতাম,আরও আরও অনেক  কথায় আমি যখন অসহ্য হয়ে উঠেছি,খাবার দাবার নিয়ে সাদিক আসে। আমাকে দেখে সে হতভম্ব, তুই যাস নাই?
কই যাব?
আরে!শালা রাইত থাইকা আমার মাথা খাইয়া ফালাইছে,তুই কার সাথে জানি চইলা গেছস! উফ!বাঁচলাম।
আমি উলটো ক্ষেপে যাই,তুইও এমন কথা বিশ্বাস করলি?
আশরাফ একটা তিলকে কেমন তাল করে এমন কান্ড করছে, সত্যটা যদি শুনিস,
সাদিক বলে, তুই ওর সাথে টালবাহানা করিস না? ও আংটি পরাতে গিয়ে কেন কাবিন করল?তুই তো ওকে ভরসাই দিসনি।
এসব কাবিনের আগের কথা। আমি উল্টো চিল্লাই,ভরসা না দিয়ে কোন বুদ্ধিমান মেয়েভ কিন্তু কাবিন করে না।

সন্ধ্যে নাগাদ তাকে বমি করিয়ে মাথায় পানি ঢেলে ধাতস্থ করা হলে, আশরাফের সিনিয়র বন্ধু মাহবুব সাহেব ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নিয়ে বলেন,তোমার অনুষ্ঠান তো একমাস পরে,এই একমাস তুমি এখানেই থাকো। কাবিন তো হয়েই গেছে।  
আমি বলি,আমার শ্বশুর বাড়ির মানুষ কী ভাববে? শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার আগেই আমি তাদের ছেলের সাথে সংসার শুরু করেছি?
আশরাফ আমার হাত জোরে চেপে বলে,সে আমি দেখব,
বলি,দু সপ্তাহ পরে মুমিনুন্নেসায় ইন্টারমিডিয়েট ফার্টইয়ার পরীক্ষা আমার।  
দিতে হবে না। এক বছর গ্যাপ গেলে কিচ্ছু হবে না।  
তুমি আমাকে বিশ্বাস কর না?
করি। কিন্তু আমি চাই না,তুমি ওর ছায়ার কাছেও থাকো। ঠিক ভুল যাই বুঝেই হোক,আমি একেবারে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম,ওই ছেলে কোন না কোন ছুতো ধরে তোমার পাশে চক্কর খাবে,প্লিজ।  

ঠিক আছে। আর বলতে হবে না।
অবশ্য আমাকে এডভেঞ্চারের মজাও পেয়ে বসেছিল। একেবারেই প্রস্তুতিহীন একটা সংসার করব দুজন।  যথাসম্ভব গোপনে।  
সন্ধ্যার পর বেড়াতে বেরোব। পড়াশোনার টেনশন নেই!

আমি দেড় মাসের জন্য থেকে যাই।
কারণ সপ্তাহ পরে ময়মনসিংহ থেকে আয়োজন করে সুনামগঞ্জ থেকে শ্বশুরবাড়ির মানুষ আসবে আমাকে নিয়ে যেতে। কিন্তু আমি অলরেডি এখানে সংসার করছি,এটা লিক হয়ে গেলে   যথারীতি তারা মহা আপসেট। আমি এত বছর দাম্পত্যের মধ্যে আশরাফের তেমন  রূপ আর দেখিনি।

ময়মনসিংহ থাকতে বাড়িতে ইলেক্ট্রিসিটি ছিল না। মাথায় ফ্যান ঘুরত না,কিন্তু তারপরও আমরা হয়তো বা অভ্যাসেই গরমে ছটফট করে ঘুমাইনি এমন মনে পড়ে না। এখনকার মতো এত ঋতু সচেতনতা কারো ছিল না। ফলে জুন মাসের আগুন গরমের মধ্যে জড়োয়ায়, কাতানে সাজিয়ে আমাকে মাইক্রোবাসে তুলে প্রথম ঢাকায় গিয়ে নানীশ্বাশুড়ির বাড়ি রাত কাটালাম।  

আশরাফ যে সুন্দরী মেয়ের প্রেমে পড়ে দিশেহারা হয়েছিল একদা,সেই মেয়েও তার বর কন্যাসহ হুবহু আমাদের ছাদের ওপরের ফ্ল্যাটে ছিল।  আমাকে আর পায় কে?সারারাত আশরাফকে এ নিয়ে খোঁচাখুঁচি করতে করতে একটা দীর্ঘ যাত্রার আগের যে জরুরি ঘুম,সেটা আর আমাদের হয়নি।

পরদিন ভোরে  সরাসরি সুনামগঞ্জ যাত্রা শুরু হল। ঢাকা অব্দি গিয়েই আমার খবর হয়ে যায়। রাতে সম্পর্কে নানা শ্বশুরের বাড়িতে ছিলাম। বিস্ময় নিয়ে আশরাফকে বলি এত তীব্র গরমে এমন জড়ির কাপড় চোপড় পরে কীভাবে সুনামগঞ্জ যাব?আশরাফ অসহায়। বলে আমরা বরযাত্রী এসে বউ নিয়ে দেশের বাড়ি যাচ্ছি,আর কীভাবে সম্ভব? 
তখন অন্য কোন সম্ভবের কথা কেউ কল্পনাও করত না।
এ ছাড়া ঢাকা থেকে সিলেট সুনামগঞ্জ দূরত্ব সম্পর্কে আমি কতটা কী জানি?
বেরিয়ে পড়লাম। আমার পেছনে আমার শ্বশুর, আমার ননদের শ্বশুরসহ আরও মুরুব্বিজন বসা।
ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা আসা অব্দি আবহাওয়া মোটামুটি ছিল।  কিন্তু সুনামগঞ্জ যাওয়ার পথে রাক্ষুসি রোদ যেই তেতে উঠতে থাকল,আমার মনে হতে থাকল,আমার ঘাড়ে শরীরের জড়ির কাপড় নয়,গাদা গাদা লাল পিঁপড়ে ছেড়ে দিয়েছে কেউ। আমার জীবনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্যেই সেই যাত্রা ছিল অন্যতম একটা। আমি কী পরিমাণ সহ্য করে কদ্দুর চুপ থাকতে পারি,সেই পরীক্ষা।

এদিকে বাড়ির জন্য বুক হুহু করছে। অন্যদিকে আমি গরমের ভাপে জ্বলতে জ্বলতে একমাত্র আশরাফের ওপর রাগ ঝাড়ি,এভাবে কেউ শাস্তি দেয়,নিজের বউকে? তুমি জানতে না,কী অবস্থা হতে পারে আমার?
আশরাফ ফিসফিস করে বলে,ঘাড়ের কাপড়টা সরিয়ে নাও।
কীভাবে সরাব?পেছনে শ্বশুর মুরুব্বিরা আছে।  
আমাদের সাথে ছোটবোন ঝর্না আর ভাই জুয়েলও ছিল। ঝর্না তখন অনেক ইমম্যাচুর ছিল।  আরও পোলাপান ছিল ওদের পক্ষের। গাড়ি চলতে থাকলে তাও একটু রক্ষা হয়,যেই গাড়ি থেমে যায়,মনে হয় শরীরে শত শত বিচ্ছু ঝাঁপিয়ে পড়েছে।  
আমি দাঁতে দাঁত চেপে চিতকার আটকাই। কান্না আটকাই।
ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ যেতে তখন সাতটা ফেরি।  
  সুনামগঞ্জ থেকে ১ম আহসানমারা, পানি আসে হাওর থেকে। ২য় ডাবর, নদী মহাসিং। ৩য় লামা কাজী,সুরমা নদী। সিলেটের পর ৪র্থ সাদীপুর, ৫ম শেরপুর নদী কুশিয়ারা সম্ভবত। ভৈরবের নদী মেঘনা, পরেরটা সম্ভবত  ব্রম্মপুত্র।
প্রত্যেক ফেরির সামনে লাইন,প্রত্যেক ফেরির সামনে দাঁড়িয়ে গাড়ির দাঁড়িয়ে থাকা আর প্রার্থনা করা,খুল যা সিম সিম,,।

তখনো জীবনে এমন ভয়ানক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হইনি। মনে হচ্ছিল ছুটে ফিরে বাড়ি চলে যায়।

এরমধ্যে ফেরির পরে ফেরি পেরোচ্ছি।
যখনই গাড়ি চলতে শুরু করে, বাতাস আসে,তখন একটু শান্তি।  
কিন্তু টি গার্ডেনের এলাকায়, আরও অনেক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে পোলাপান যখন নিয়ে আসা ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলার জন্য গাড়ি থামাচ্ছিল,মনে হচ্ছিল একেকটার কান 
মলে দিই।
সিরিয়াসলি, শেষ ফেরি
আসনমারায় এসে আমি পুরোপুরি নেতিয়ে পড়ি,এভাবে কোন একজন বউ কিন্তু মরেও যেতে পারে। অজ্ঞান হওয়া তো ডালভাত। এই জীবনে কোনদিন আমি অজ্ঞান হইনি। এখন বুঝি,কী কারণে সেদিন মরিয়া হয়েও অনড় ছিলাম! 

 আমার সহ্যক্ষমতা কত ছিল, সেদিন পরীক্ষা হয়ে যায়। পুরো শরীর মুখ ঘামচিতে একেবারে গোটা গোটা হয়ে  গিয়েছিল।
আসনময়ারা থেকে কারা যেন আমাকে উড়িয়ে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি নিয়ে ফেলে। তখন মধ্যেরাত। সবাই বাড়ির বড় বউ আসার জন্য অপেক্ষা করছে।  আমার ওপর থেকে ল্যাপ্টে থাকা পেঁয়াজেএ খোসার মতো ঘোমটা সরিয়ে প্রতিবেশি হই হই করে ওঠে, সুন্দর ডাক্তার বউ বাদ দিয়া এলা কিতা বউ আনল ভাইসাব?নাকমুখ বুজা যায় না?
ঠেলে কান্না উঠছিল। আমার শ্বাশুড়ি এসে সবাইকে তীরস্কার করে সরান সরিয়ে জানান,অনেকদূর জার্নি করে এসেছে। আজ ওরা গোসল করে ঘুমাক।
তা হয় নাকি?নতুন বউ এলে শ্বশুর বাড়ির ফর্মালিটি আছে না?
আমি গোসল করে ঘুমানোর জন্য যখন ভেতর ভেতর মরিয়া,ওরা রঙ তামাশা করছে, তখন শুনি অন্য হুলোড়ল। আমার আব্বা আর আম্মা নাকি আমাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আর থাকতে না পেরে নদী পথে নেত্রকোনা দিয়ে আমাদের আগেই আমার শ্বশুর বাড়ি চলে এসেছেন।

একদিকে আব্বা আম্মা এসেছেন এই আনন্দ, অন্যদিকে তাঁদের এমন মেয়ের সাথে চলে আসা নিয়ে চারপাশে ফিসফাস গুঞ্জনে আমি দিশেহারা বোধ করতে থাকি।
ক্লান্তি অবসাদে ঢলে পড়তে চাইছি,কিন্তু কারও ধারণা পর্যন্ত নেই কতটা সাগর পারি দিয়ে আমি কীভাবে এসেছি?
তাদের উৎসব শেষ হয় না।
বাড়ি ভর্তি গিজগিজ করছে মানুষ।  
সবাই থাকবে রাতে।
আশরাফ বলেছিল,তাদের ছ্যাপরামতো ছোট টিনের  বাড়ি। এইসব আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।

কিন্তু  সেখানে গিয়ে দেখি ইয়া বড় বড় পাকা দালানের একেকটা ঘর!
তার মানে আশরাফ আমাকে পরীক্ষা করেছিল!
বরং কয়েক মাইল দূরে আশরাফদের গ্রামের বাড়ির মধ্যেও বড় রুমের বিল্ডিং আছে।  যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা এসে থাকত। এসব পড়ে শুনেছি।

যেহেতু আমি ঢাকায় কাবিনের পরে এসে উঠেছি,ফলে সেদিন মাঝরাতে সবার সাথে আমার ঘুমের ব্যাবস্থা হয়।
ভাগ্যিস আমার আব্বা আম্মার ব্যাপারটা সুন্দরভাবে আমার শ্বশুর শাশুড়ী সামলেছিলেন।

আব্বা আম্মা পরদিন থেকে চলে গেলে অচেনা রাজ্যে একা হয়ে গিয়ে প্রচন্ড কান্না পেতে থাকে। ঝর্না ভরসা ছিল। কিন্তু এত মানুষের বিচরণের মধ্যে ওর সাথেও একান্তে একটা কথা বলার অবস্থা ছিল না।  

আশরাফ বাড়ির বড় ছেলে , চাইলেই সবাইকে ডিঙিয়ে আমার সামনে আসতে পারছে না।
আত্মীয় স্বজন কমতে থাকলে রাস্তার পাশের ছিমছাম ফটিক ঘরে আমার আর আশরাফের ঘুমোনোর ব্যবস্থা হয়।
আমি একেবারে শিশুর মতো আকুলভাবে তাকে জড়িয়ে ধরি।
রাত বাড়তে থাকলে সাঁই সাঁই সমুদ্রের শব্দে বিস্মিত হয়ে যাই।

আশরাফ জানালা খুলে দেয়।
আমি স্তম্ভিত হয়ে দেখি, মাঝখানে রাস্তা,তার ওপারেই দীর্ঘ কূল কিনারাহীন হাওর। আসা অব্দি দমবন্ধকর অবস্থা যা অবলোকন করার সূযোগই হয়নি। মূল শহরের পাশের রোডের পাশে এ যে সমুদ্র!   ঝকঝকে আলোয় সেই হাওরের মস্ত ঢেউগুলোর শব্দে,বাতাসে  পুরো রাত আচ্ছন্ন হয়ে রইলাম।

( চলবে) 

নাসরীন জাহান : কথাসাহিত্যিক। কবিতাও লিখছেন কয়েকবছর থেকে। পুরস্কার পেয়েছেন ফিলিপ্স সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৪) (উড়ুক্কু উপন্যাসের জন্য)। আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৫) (পাগলাটে এক গাছ বুড়ো গল্পের জন্য),বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ আরও অনেক পুরস্কার পেয়েছেন।   নাসরীন জাহান ১৯৬৪ সালে ৫ মার্চ বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাটে জন্মগ্রহণ করেন।  ব্যক্তিগত জীবনে নাসরীন জাহান কবি আশরাফ আহমেদের স্ত্রী। লেখালেখির সূত্রেই তার সাথে পরিচয় এবং সে থেকে প্রণয়। ১৯৮৩ সালে তারা বিয়ে করেন। তাদের এক মেয়ে। নাম অর্চি অতন্দ্রিলা।

news24bd.tv/ডিডি