শত কোটি টাকার মালিক মন্ত্রীর বাড়ির কেয়ারটেকার 

শত কোটি টাকার মালিক মন্ত্রীর বাড়ির কেয়ারটেকার 

অনলাইন ডেস্ক

‘দেখে দিব, ফেলে দিব, চলতে পারবি না, বাঁচিয়ে রাখব না’ বলে মানুষকে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে ভয় দেখাতেন সাবেক রেলপথমন্ত্রী জিল্লুল হাকিমের বাড়ির কেয়ারটেকার মিজানুর রহমান মজনু।

তিনি মন্ত্রীর বাড়ির কেয়ারটেকার থেকে হয়ে যান রাজবাড়ী জেলা পরিষদ সদস্য। সেখান থেকে কালুখালী উপজেলার মদাপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান হন। তারপর থেকে আরও বেপরোয়া জীবনযাপন শুরু হয় তার।

গত ৪ আগস্ট পর্যন্ত রাজবাড়ীতে প্রচণ্ড দাপটের সঙ্গে চলতেন মজনু। কিন্তু ৫ আগস্ট দুপুর থেকে এমন দাপুটে ইউপি চেয়ারম্যানের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ কোথায় গেল কেউ জানে না। কেউ কিছু বলতে পারেন না।

কোথাও তাকে দেখা গেছে, এমন কোনো প্রত্যক্ষদর্শীও খুঁজে পাওয়া যায় না।

মজনুর হয়রানির শিকার হতে হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতা, বিএনপি নেতা, সাংবাদিক, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের। এক গৃহবধূকে শ্লীলতাহানির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলাও হয়। তার নেতৃত্বে ‘হাতুড়ি বাহিনী’র দাপটে এলাকা ছাড়াসহ পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে অনেককে। দুই হাতে অর্থ কামিয়ে এখন তিনি শত কোটি টাকার মালিক।

নিজের ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে জেলা পরিষদের যাত্রীছাউনি রাতের অন্ধকারে গুড়িয়ে দেওয়ার মতো অভিযোগ আছে মজনুর বিরুদ্ধে। এ ছাড়া জেলা পরিষদের জায়গায় নিজস্ব অফিসও নির্মাণ করেন তিনি। তার এতটাই ক্ষমতা ছিল যে, কেউ তার অপকর্মের প্রতিবাদ করতে সাহস পায়নি। তার হাতে নারী নির্যাতন, মদাপুরের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ, নারী সদস্য বিউটি বেগম, সাংবাদিক আবুল কালাম আজাদ, ফাতেমা বেগমসহ অনেকেই চরম হয়রানি ও মারধরের শিকার হন।

যাত্রীছাউনি ভাঙার বিষয়টি তদন্ত করে রাজবাড়ীর তৎকালীন জেলা প্রশাসক শওকত আলী ২০১৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন। সেই প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের জায়গায় থাকা যাত্রীছাউনি জেলা পরিষদ সদস্য মিজানুর রহমান মজনু ভেঙে ফেলেন।

মজনুর বিরুদ্ধে উপস্থিত থেকে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের নির্মাণাধীন রাজবাড়ী শহরে ৪ লেনের জায়গা আংশিক দখল করে বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণের অভিযোগ রয়েছে। প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধির ছত্রছায়ায় তিনি এতটাই বেপরোয়া ও ধ্বংসাত্বক মনোভাবের হয়ে ওঠেন যে, কেউ তার কাজের প্রতিবাদ করতে সাহস পায়নি। অনৈতিকভাবে বিঘ্ন সৃষ্টি করলেও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কিছু বলতে পারেননি তাকে। এসব বিষয়ে কালুখালী থানায় মামলা করা হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন তিনি।

কালুখালীর চাঁদপুর বাসস্ট্যান্ডে যাত্রীছাউনি ভাঙার ঘটনায় ইউপি চেয়ারম্যান মজনুর শাস্তি, গ্রেপ্তার ও নতুন যাত্রীছাউনি নির্মাণের দাবিতে এলাকাবাসী মানববন্ধন করলেও তার কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি।

কালুখালীর স্থানীয় বাসিন্দা হাজী শহিদ বলেন, ‘মিজানুর রহমান মজনুর বাবার তেমন কোনো সম্পদ ছিল না। সামান্য মেম্বার ছিলেন। সাবেক রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিমের বাড়ির কাজের লোকের মতো থাকতেন মজনু। মন্ত্রীপুত্র মিতুল হাকিমের ক্যাডার বাহিনীর মাধ্যমে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। পরে তাকে জেলা পরিষদ সদস্য ও মদাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বানানো হয়। চাঁদপুর বাসস্ট্যান্ডের যাত্রীছাউনি ভেঙে পেছনে থাকা আমার জমি দখল করেন। প্রতিবাদ করায় পুলিশের মাধ্যমে আমাকে ধরে নিয়ে আটকে রাখেন এবং ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়ে ১০ লাখ টাকা আদায় করাসহ জমি দখল করে আলিশান মার্কেট নির্মাণ করেছেন। ’

তিনি বলেন, ‘আমার মতো অনেককে তিনি ধরে নিয়ে চাঁদা আদায় করেছেন। লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তিনি এখন শত কোটি টাকার মালিক। এতো টাকা তার কিভাবে হলো! মার্কেট নির্মাণের স্বার্থেই ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতের অন্ধকারে দৌলতদিয়া-কুষ্টিয়া মহাসড়কের চাঁদপুরে যাত্রীছাউনি ভাঙা হয়। এ ঘটনায় মামলা হলেও ক্ষমতার দাপটে মজনু বেঁচে যান। আমরা দ্রুত যাত্রীছাউনি নির্মাণসহ মজনুর শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। ’

হাজী শহিদ বলেন, ‘সাবেক মন্ত্রীপুত্র মিতুল হাকিমের হাতুড়ি বাহিনীর মাধ্যমে মজনু এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। তার কথার অবাধ্য হলেই হাতুড়ি বাহিনী দিয়ে তার ওপর হামলে পড়তেন। তাকে চাঁদা দেওয়া ছাড়া এলাকায় থাকা অসম্ভব ছিল। ’

ব্যবসায়ী রেজা মন্ডল আলম বলেন, ‘আমার বৈধ লিজ নেওয়া দোকান গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে নিজে দখল করে মার্কেট নির্মাণ করেছেন। তিনি কি আলাদিনের চেরাগ পেয়েছিলেন নাকি। অল্প দিনে এতো টাকার উৎস কোথায়! দুর্নীতি দমন কমিশনকে বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি। ’

পাংশার বাসিন্দা, সাংবাদিক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘টোকাই মজনুর অনিয়মের সংবাদ প্রকাশ করায় আমার দুই হাত, দুই পা ভেঙে দেওয়াসহ আমাকে হত্যাচেষ্টা করেন। সেই যন্ত্রণা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছি। আমি সঠিক বিচার দাবি করছি। ’

মদাপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) প্যানেল চেয়ারম্যান মদন কুমার প্রামানিক বলেন, ‘মিজানুর রহমান মজনু পলাতক থাকায় প্যানেল চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। ইতোমধ্যে গত ৫ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসক আবু কায়সার খান প্রশাসনিক ক্ষমতা অর্পণ করেছেন। ’

news24bd.tv/SC