সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে বন্ধু শব্দটাই একটা নামের মতো

সোমা দত্ত

সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে বন্ধু শব্দটাই একটা নামের মতো

সোমা দত্ত

একসময় মনে হতো, জীবনে একজন বন্ধুর খুব দরকার, এখন আর সেভাবে বিশেষ কিছু মনে হয় না। থাকলে ভালো, না থাকলেও আমি অভ্যস্ত। আবার সমষ্টিগতভাবে কিছু বন্ধুবৃত্তে থাকার জন্য খুব ব্যক্তিগত কোন পরিসরের ওই 'একজন বন্ধু' বিষয়টার জন্য খুব বেশি অবকাশও থাকে না।
তবে মাঝেমধ্যে পুরোনো বন্ধুদের কথা মনে পড়ে, স্মৃতি ঘেঁটে ওদের দেখি, একা একা হেসে ফেলি, এভাবে বেশ কিছুটা সময় নষ্ট হলেও ভালোই লাগে।

সময় নিয়ে আমি বিচলিত নই। যা গেছে তা যাওয়ার ছিল বলেই...
বন্ধুত্ব ব্যাপারটা আসলে ওভাবে ফুরানোর নয়। একসময়ের বন্ধুত্ব কী অন্যসময়ে এসে ফুরিয়ে যায়? মনে হয়না। বন্ধুত্ব আসে দাবি নিয়ে এই কথাটাই তো কত ছোটবেলায় এক বন্ধু মাথায় গেঁথে দিয়েছিল।
আজও ভুলিনি সেকথা। পুরোনো সময় যেখানে ছিল সেখানেই চিরকাল রয়ে যায়।  
নিরপেক্ষ ভাবে বলতে গেলে বন্ধু হিসেবে আমি ভালো নই। আমার উপসর্গ সমেত আমাকে সহ্য করা কঠিন। কোনো নিয়মিত যোগাযোগ, খোঁজখবর, ফোনপত্তর আমার নেই। হঠাৎ জেগে উঠলাম হয়তো আবার হঠাৎ নিভেও যাই। তাও কতজন আমাকে সহ্য করেছে কতসময় তাই ভাবি। দু একজন এখনও এসব মেনে নিয়েও আমার বন্ধু।
এখন তো ফেসবুকের জন্যে এই সোশ্যাল মিডিয়াতেও কত বন্ধু আমার, সকলেরই তাই। বন্ধু শব্দটাই একটা নামের মত হয়ে গেছে এখানে। নতুন পরিচয় হলে, নাম ধরে ডাকাটা অস্বস্তিজনক বলেও অনেকেই বন্ধু বলে সম্বোধন করে। সৎ উদ্দেশ্য কিন্তু আমার এটা পছন্দ নয়। বন্ধু শব্দকে যেন স্থূল লাগে এভাবে। বড্ড মোটা দাগের হয়ে যায়। 'বন্ধু তুমি ভাল থেকো' এত সুন্দর একটা কথা অথচ আমার মনে হয় এই বন্ধু যেন অচেনা রয়ে গেল। এই ডাক যেন দূরত্বের মঙ্গল আরতি। আমি জানি আমি অবশ্যই ভুল। এ আমার বিচিত্র মনের বিকার ছাড়া কিছু নয়। যেমন 'ভালো থেকো' শব্দটা আমার ভালো লাগে না কোনদিন। কেমন বিদায়ের গন্ধ পাই। যেন কেউ চলে গেল, বলে গেল আমার যা কিছু রেখে গেলাম সেইসব নিয়ে তুমি ভাল থেকো। যাক গে আমি অন্যদিকে সরে যাচ্ছি হয়ত... 
এখন মনে হয় একটা কমন ইন্টারেস্ট নিয়ে এক পথে চলা মানুষগুলোকে আমরা বন্ধু বলি, বন্ধুত্ব সম্পর্কে আমাদের আসলে কোনো ধারণা নেই ধারণা করতে চাই কিনা সেটাও একটা বিষয়। আমাদের আসলে সময় নেই। একটু মাথাটাকে ফাঁকা করে নিতে আমরা বন্ধু জুটিয়ে নিই। দেখি দুটো পরস্পর বিরোধী মানুষও একসাথে মদের গ্লাস হাতে বন্ধু হয়ে যায়। নেশা উতরে যাওয়া পর্যন্ত ওই বন্ধনের স্থায়িত্ব অটুট থাকে।  
আসলে জীবন বিপন্ন করে তুলেছে আমাদের। আমরা মুহূর্তের জন্য বাঁচতে শুরু করেছি। আমাদের কোনো ভবিষ্যত নেই। এই মুহূর্তের আনন্দ বা দুঃখের ভার যার সাথে ভাগ করতে পারছি সেই আমার পরম বন্ধু। আমার সচেতন মন আমাকে সিলেক্টিভ হতে শিখিয়েছে। এর কাছে এতটুকু লিমিট আর ওর কাছে কতটুকু। এসব শিখে গেছি আমরা সফিস্টিকেশন মেইনটেইন করতে গিয়ে। এখন আর না ডাকলেও রোজ বিকেলে বসুনগরের বন্ধুর বাড়িতে ক্যাবলার মত হাঁড়ি খুলে আড্ডা দিতে বসবো না।  
এখন শিখে গেছি ঘর আর বাইরের প্রভেদ। বন্ধু হলেও সবকথা সবাইকে বলা যাবে না সে তুমিও জানো আমিও জানি।
বন্ধুত্ব মানেই এখন স্থান কাল ভিত্তিক প্রবাবিলিটি।
এখন অপেক্ষা করতে বললে,আমি একঘন্টা রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবো না। এলো তো ভালো না এলো তো চললাম। এখন আর বন্ধুর ব্যবহারে কষ্ট পেয়ে বাথরুমে ঢুকে ঘন্টার পর ঘন্টা কাঁদবো না। বারো পাতা চিঠি লিখবো না বন্ধুকে।  
শুধু বন্ধুদের ছোটবেলাগুলো আমায় বেঁধে রাখে। ওদের ছেলেবেলা আমি ভুলতে পারিনা। বড়বেলার গোছানো চিনামাটির কাপ ডিশ, পরিশীলিত আলিঙ্গন, পরিমিতি বোধের ব্যবহার আমার বন্ধুর মতো লাগে না।  
সেই অবিচলিত পাগলামি কে মিস করি আমি। সেই মানসিক নির্ভরতা, বোকা হয়ে বেঁচে থাকবার উদাসীনতা, স্বপ্ন নির্ভর স্কুল পালানো গলি, লেকের ধার, সিগারেটের ধোঁয়া আর একে অপরের অসহ্য স্বভাবগুলোর প্রকাশ্য সমালোচনা করা, রাগ করে চারদিন কথা না বলার পর আবার ছুটে যাওয়া রিলগুলো আমি কাজের সময় নষ্ট করেও দেখি। ওটাই আমার ফ্যান্টাসি।  
যেখানে আর আমি ফিরবো না, ফিরে যাওয়ার পথে যেখানে এবসলিউট নো বোর্ড টাঙানো তার থেকে ভালো রিস্ক ফ্রি ফ্যান্টাসি আর কি হতে পারে।

লেখক : ভারতের কোলকাতায় বসবাসকারী সম্পাদক, কলমে কারুকৃতি পত্রিকা


news24bd.tv/Imran/ডিডি