আজ পয়লা আষাঢ়, শহর জুড়ে বৃষ্টি নামুক

সংগৃহীত ছবি

আজ পয়লা আষাঢ়, শহর জুড়ে বৃষ্টি নামুক

দেলোয়ার হোসেন লিটু

নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে। ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে। রবীন্দ্রনাথের এই কবিতা যেন স্মরণ করে দেয় বর্ষার আগমণ।

আজ পয়লা আষাঢ়, বর্ষা ঋতুর প্রথম দিন।

সকাল থেকে গুমোট মেঘ বার বার জানান দিচ্ছে বর্ষা এসে গেছে। ‘বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে’ দুয়ারে উপস্থিত সজল শ্যামল বর্ষা। প্রকৃতির অপার প্রতীক্ষায় জেগে ওঠা বৃষ্টির ফোঁটায় বর্ষা ঝরে। বর্ষায় জেগে ওঠে প্রাণ।
দূর হয় জঞ্জাল। বর্ষার শুরুতেই করা হয় আবাহন। বর্ষার গানে বর্ষাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। যেন এক রাজকীয় ব্যাপার।

বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। গ্রীষ্মের পরই আসে বর্ষাকাল। ঋতুচক্রে আষাঢ়-শ্রাবণ দু মাস মিলিয়ে বর্ষাকাল। নির্মল প্রকৃতির জীর্ণতা ধুয়ে দিতে আকাশ থেকে নেমে আসে আবিরাম বৃষ্টি। প্রকৃতি সেজে উঠে নতুন সাজে। বর্ষাকাল আসলেই চারদিকে পানি থৈ থৈ করে বর্ষাকালে প্রকৃতি তার অপরূপ সৌন্দর্যে সেজে ওঠে। বর্ষাকালে সারাদিন বৃষ্টি নেমে থাকে বর্ষাকালে আকাশে ভেসে বেড়ায় কালো মেঘ যে মেঘগুলো দেখলে দুই নয়ন ভরে উঠে আনন্দে।

বর্ষা নিয়ে কবি-সাহিত্যিকরা লিখেছেন অসংখ্য গান ও কবিতা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বর্ষার প্রতি ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে লিখেছেন, আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে; জানি নে, জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না। বর্ষায় প্রকৃতির সাথে মনেও চলে দোলাচল। বৃষ্টি ভিজে, নরম কাদায় পা নাচিয়ে মন যেন নবরূপে জেগে উঠে। কবি বর্ষার প্রতি পক্ষপাত ঘোষণা করে লিখেছেন, ‘ঋতুর মধ্যে বর্ষাই কেবল একা একমাত্র।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা ‘সোনার তরী’। এ কবিতায় বর্ষারই অপরূপ ছবি এঁকেছেন কবি। তিনি লিখেছেন, ‘গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা। কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা। রাশি রাশি ভারা ভারা ধান–কাটা হল সারা, ভরা নদী ক্ষুরধারা খরপরশা— কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা। ’

বর্ষা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়াও আরো অনেকেই গুণগাণ করেছেন। পল্লী কবি জসিমউদ্দিনও তার কবিতায় বর্ষার রূপ বৈচিত্র বর্ণনা করেছেন। কবি তার পল্লী-বর্ষা নামক কবিতায় লিখেছেন- আজিকার রোদ ঘুমায়ে পড়েছে ঘোলাটে মেঘের আড়ে, কেয়া-বন পথে স্বপন বুনিছে ছল ছল জলধারে। কাহার ঝিয়ারী কদম্ব-শাখে নিঝঝুম নিরালায়, ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে অস্ফুট কলিকায়।

কবিতার সম্পূর্ণ অংশেই তিনি টেনেছেন বাংলার পল্লী গায়ে বর্ষার সময়ে প্রকৃতির বর্ণনা। কদম ফুল বর্ষার সময়ের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বর্ষা এলেই মানুষ এক অজানা ভালোবাসায় সাড়া দেয়। তাই তো ঋতুরাজ বসন্তের চেয়ে অনেকেই বর্ষাকে ভালোবাসার সমার্থক মনে করেন।

বর্ষায় দেখা মেলে চিরচেনা কদম ফুলের। কিন্তু এবার কদমের তেমন একটা দেখা নেই বললেই চলে। বর্ষার স্মারক বলা হয় কদম ফুলকে। বর্ষার আগমনী বার্তা নিয়ে আদিকাল থেকে কদম আমাদের প্রকৃতির শোভা বর্ধন করে আসছে। শুধু সৌন্দর্য্য নয়, ভেষজ গুণের পাশাপাশি কদমের রয়েছে অর্থনৈতিক গুরুত্বও। কদমের সাদা-হলুদ, পাতার সবুজ কোটি ডাল আন্দোলিত করে প্রকৃতিতে আসত বর্ষাকাল। কদম ছাড়া বর্ষা যেন বেমানান।

এক পশলা বৃষ্টি যে নতুন মাত্রা নিয়ে আসে জীবনে, তা অন্য কিছুতেই পাওয়া যায় না। বর্ষায় বাংলার নদনদী পূর্ণযৌবনা হয়ে ওঠে। নদীর ফেঁপে ওঠা জোয়ারের পানি প্রচুর পলি জমায় মাটিতে, যা নিয়ে আসে শস্যেও প্রাচুর্য। এ সময় বিলে-ঝিলে ফোটে শাপলা-শালুক। হিজল আর কেয়াফুলের অরূপ দৃশ্য মোহিত করে মনকে। বর্ষাকাল গ্রামের মানুষকে অনেক বেশি ঘরমুখো করে তোলে। রমণীরা ঘরে বসে নকশি কাঁথায় ফুল তোলে। অনেকটা আলস্যে কেটে যায় দিন।

বর্ষাকালে জলীয় বাষ্পবাহী দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। চারপাশের পরিবেশে দেখা যায় সবুজের আধিক্য। এসময় দেখা যায় কদম, বেলি, বকুল, জুঁই, দোলনচাঁপা, গন্ধরাজ, হাসনাহেনাসহ অনেক ফুল, যার ঘ্রাণে ভরে ওঠে চারপাশ। বর্ষা শুধু মানুষ না, প্রভাব ফেলে ‘মানবেতর’ প্রাণীর ওপরও। মেঘের গর্জন ছাড়া ময়ূর পেখম মেলে ধরতে চায় না। অনেক প্রাণীর মিলনঋতু বর্ষা। বর্ষার ঘনঘটার জন্য তাদের নিশ্চয়ই আর তর সইছে না।

আষাঢ়ের প্রথম দিন হলেও গত কিছুদিন থেকেই প্রকৃতিতে দেখা গেছে বৃষ্টির। থেমে থেমে দেশের বিভিন্ন স্থানে বজ্রসহ বৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে সিলেটসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষ তা ভালো করেই টের পাচ্ছে। প্লাবিত হয়েছে অনেক এলাকা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে বাংলাদেশে এখন আর ছয় ঋতুর সবগুলো আর আগের মতো আলাদাভাবে বোঝা যায় না। তবে শীত, গ্রীষ্ম আর বর্ষা এখনও আমাদের দেশে ভালোভাবেই আছে।

বৃষ্টির এই সময়ে গরমের তাপদাহ কিছুটা কমে আসে। ফলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সবাই। তবে বর্ষার ভোগান্তিও কম নয়, যখন শহরে রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে যায়। চলাচলের সমস্য প্রকট আকার ধারণ করে। এসময় নদ-নদীতেও পানি বাড়তে শুরু করে। এতেও আতঙ্কে থাকে নদী পাড়ের মানুষেরা।

news24bd.tv/DHL