বেনজীর ক্রিমিনাল নন শুধু, তারচেয়ে বেশি কেন বিকারগ্রস্ত?

মাহবুব কামাল 

বেনজীর ক্রিমিনাল নন শুধু, তারচেয়ে বেশি কেন বিকারগ্রস্ত?

মাহবুব কামাল

আজকাল অনেক কিছুই চট করে মনে আসে না। মাথার হার্ডডিস্ক থেকে কসরত করে বের করতে হয়। কথাটা কার মনে পড়ছে না: তুমি যদি দু'চার দিন কারও সঙ্গে মিশে বলে দাও লোকটা খুব ভালো, তাহলে জীবনে একের পর এক ভুল করতেই থাকবে। এই মুহূর্তে এত প্র্যাকটিকাল কোটেবল কোট আর পাচ্ছি না।

 
বেনজীরকে টেলিভিশনে ৩-৪ বার দেখেছি। কথাবার্তায় নিপাট ভদ্রলোক মনে হয়েছে তাকে। মাঝে মাঝে ইংরেজিও বলতেন। কার কাছে কী মনে হয়েছে জানি না, আমার কাছে টেলিভিশনে দেখা তার ভাবমূর্তিটি ছিল: পুলিশও তাহলে রবীন্দ্র সঙ্গীত গায়! কিন্তু এ কী! আচ্ছা বুঝলাম, তিনি যে একজন চরম খারাপ লোক বুঝতে পারিনি; কিন্তু তিনি যে বিকারগ্রস্ত, সেটা বুঝলাম না কেন? তবে যে জেলে বসে ফ্রয়েড, উইলিয়াম জেমস, আলবার্ট বান্ডুরাদের মনোবিজ্ঞান পড়লাম, নানা মামলার আসামীদের বিচিত্র মনের বিচিত্র কথার সঙ্গে ইনটারেকশন হলো, রেজাল্ট কী? এসবের কোনোকিছুই মানুষের বিকারগ্রস্ততা শেখাতে পারলো না! 
হ্যাঁ, বেনজীর ক্রিমিনাল শুধু নন, ততোধিক বিকারগ্রস্ত।
তিনি যদি পেনশনের টাকার সঙ্গে দুর্নীতিলব্ধ টাকা যোগ করে মোটামুটি ভালো একটা ফ্ল্যাট কিনে বাকি ৩-৪ কোটি টাকা ফিক্সড ডিপোজিট অথবা সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে অবসর জীবন কাটিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতেন, তাহলে আমরা তাকে সাধারণ দুর্নীতিবাজ বলতে পারতাম। তাকে একজন সাধারণ কুবুদ্ধির লোক ধরে নিয়ে বলা যায়, এটা তিনি মনে করতেই পারেন, বর্তমান সরকারকে যে সার্ভিস দিয়েছেন তিনি, তার একটা পারিশ্রমিক থাকা চাই। কিন্তু বিকারগ্রস্ত না হলে দেশে-বিদেশে অন্যান্য কিং সাইজের অর্থ-সম্পদের কথা না-ই বা বললাম, এত জমি কেনে মানুষ? আরেব্বাবা! তার কথাবার্তায় এটা মনে হয়েছিলো যে, তিনি পড়াশোনা করা লোক; কিন্তু কই, তিনি তো টলস্টয়ের সেই বিখ্যাত ছোটগল্প 'How much land does a man need' পড়েননি! এত জমি ও অর্থ-সম্পদ ভোগ করারই বা সময় কোথায়? বাকি ২০-৩০ বছর কি এতসব ভোগ করার জন্য যথেষ্ট? ঠিক আছে, তার তো স্ত্রী-সন্তান আছে, তাদের জন্যও তো কিছু করা দরকার। আমাদের এখনকার স্ত্রীদের মতো লাজুক আর হয় না, স্বামীর উপার্জনের উৎস জানতে চেয়ে তাকে লজ্জা দিতে চায় না। আর সন্তান? একটু ভূমিকা দেই। বস্তুবাদীরা বলেন, বস্তু থেকেই চিন্তার উৎপত্তি, অবশ্য আমি একথায় বিশ্বাসী নই। পৃথিবীতে অনেক চিন্তাই এসেছে শূন্য থেকে, বস্তুর দরকার হয়নি। আমরা যখন supposing শব্দটি দিয়ে বাক্য শুরু করি, তখন এর পরের কথাগুলোয় বস্তু থাকলেও তা কল্পনার বস্তু। যাহোক, এটা অনেক বড় আলোচনা। সন্তান আইফোন আর পার্সোনাল গাড়ি, নিদেনপক্ষে একটা মোটর সাইকেল পেয়ে যে জীবন চালায়, সেটা ঘোরের জীবন। এই ঘোর গার্লফ্রেন্ড তার অগোচরে কয়টা বয়ফ্রেন্ড মেনটেইন করে, সেই চিন্তায় আবর্তিত। আর বাবা? বাবার যে ভালো কী খারাপ, একটা পেশাগত চরিত্র আছে, সেটা ভাবার সময় কই তার? আসলে টাকা চাওয়ার সময় ছাড়া বাবার অস্তিত্বই নেই! বস্তুবাদীরা নিশ্চয়ই বলবেন: বাবাই নেই, তাকে নিয়ে আবার চিন্তা কী!
হ্যাঁ, একটা নতুন জ্ঞান তো হলোই। মানুষ যতই স্বাভাবিক আচরণ করুক না কেন, হলফ করে বলা যাবে না তিনি বিকারগ্রস্ত নন। অবশ্য আমি এটুকু জানতাম যে, lie detector (মিথ্যা শনাক্তকরণ যন্ত্র) মিথ্যা কথা ধরতে না-ও পারে। অনেকেই এত steady যে, মিথ্যা কথা সত্যের মতো করে বলে যাবে, ডিটেক্টরের বাবার ক্ষমতা নেই ধরার। এজন্যই কী এক প্রসঙ্গে lie detectorকে নাকচ করে দিয়ে truth searcher (সত্য খোঁজার যন্ত্র)-এর প্রস্তাব করেছিলাম এক লেখায়।  
মানুষের ছোট্ট একটি মাথা, অথচ কতো রহস্য! মহাবিশ্বের রহস্য মাথার রহস্যের হাঁটুর নিচে পড়ে থাকে। যাহোক, দুর্নীতি তো আর নির্মূল করা যাবে না। মানুষ যতোদিন থাকবে, দুর্নীতিও ততোদিন বহমান থাকবে। তবে আমি যদি সাধুসন্ত হতাম এবং আমার কাছে কেউ পরামর্শ চাইতে আসতো, তাকে বলতাম: দুর্নীতি করতে চাও করো; কিন্তু এটা করতে গিয়ে বিকারগ্রস্ত হয়ো না।  
পুনশ্চ: ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ লর্ড অ্যাক্টন জনৈক বিশপকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিটিতে ক্ষমতা ও দুর্নীতির আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে একটা কথা ছিলো: Power tends to corrupt, and absolute power corrupts absolutely. ব্রিটেনে যাজকতন্ত্রের ক্ষমতার দাপটের ক্ষয়ে যাওয়ার সেটাই শুরু। পশ্চিমা সমাজে কেউই এখন, তা তিনি সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা রাজা-রানী, absolute power ভোগ করেন না। বেনজীর মিয়া absolute power চর্চা করেছেন। তিনি তো আর লর্ড অ্যাক্টনের সেই মহার্ঘ বাণীটি মিথ্যা প্রমাণ করতে পারেন না!

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক

news24bd.tv/ডিডি