ভ্রমণপ্রেমীর জন্য রাসুল (সা.)-এর উপদেশ

ভ্রমণপ্রেমীর জন্য রাসুল (সা.)-এর উপদেশ

 মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ

মানুষ কেন সফরে যায়, এ প্রশ্নের জবাব খুবই সহজ। মানুষের হাজারও কাজ। হাজারও সমস্যার সমাধানে তারা ছুটে যায় এক দেশ থেকে অন্য দেশে, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। প্রধানত মানুষ রিজিকের অন্বেষণে ঘুরে বেড়ায়।

দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রীয় তথা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধানে এবং ধর্মীয় ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমনাগমন করে থাকে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! তোমরা পৃথিবীর হালাল খাদ্যদ্রব্য থেকে ভক্ষণ করো, আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। ’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৬৮)

আল্লাহ তাআলা বৈধ, সিদ্ধ বা হালাল খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে ‘ফিল আরদি’ শব্দ ব্যবহার করে বুঝিয়েছেন যে সমগ্র পৃথিবী তোমাদের রোজগার বা খাবারের স্থান।

এখান থেকে তোমাকে শ্রম দিয়ে খাবার গ্রহণ করতে হবে। তবে সঙ্গে সঙ্গে শয়তান থেকে সতর্ক থাকতেও সাবধান করে দিয়েছেন। পৃথিবীর সব সুবিধা মহান রাব্বুল আলামিন মানুষের জন্য অবারিত করে দিয়েছেন। এ জন্য প্রথম মানব-মানবীকে দিয়েই পৃথিবীর আবাদ ও সফরের অভিজ্ঞতা জগদ্বাসীর সম্মুখে উদ্ভাসিত করে দিয়েছেন।

সুলাইমান (আ.)-কে আল্লাহ তাআলা সমগ্র পৃথিবী ভ্রমণের সুযোগ করে দিয়েছেন। তিনি দ্রুতগামী বাহনের সাহায্যে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ভ্রমণ করতেন। নুহ (আ.)-এর জীবনে কিস্তির সাহায্যে পৃথিবীর জলভাগে সফরের শিক্ষা রয়েছে। এভাবে পূর্ববর্তী নবী-রাসুলের জীবনে ভ্রমণ, সফর ও হিজরতের অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষা আমাদের সম্মুখে। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) যেমনিভাবে এক দেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমণ করেছেন, তেমনি পৃথিবী ছেড়ে গিয়ে ঊর্ধ্বাকাশে মহাপরিভ্রমণ করে মহান রাব্বুল আলামিনের দিদার বা মোলাকাত লাভে ধন্য হয়ে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসেন।

পৃথিবীর ইতিহাসে এরূপ সফরের দ্বিতীয় কোনো নজির নেই। কারণ তিনি তো মহাবিশ্বের মহান নেতা, সর্বশ্রেষ্ঠ। তাই তাঁর সঙ্গে কারো কোনো তুলনা নেই এখানে। হালাল রিজিক অন্বেষণ করা ফরজ। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘হালাল রোজগার করা অন্যান্য ফরজের মতোই একটি ফরজ। ’
নবী-রাসুলরা নিজ নিজ হাতে রোজগার করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) বাণিজ্য-ভ্রমণ করেছেন।

নিরাপদ ভ্রমণের শিক্ষা

সমগ্র পৃথিবীকে আল্লাহ তাআলা মানুষের জন্য আবাদযোগ্য করে সৃষ্টি করেছেন। মহান আল্লাহ তাআলার বাণীর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে দেখি তিনি বলেছেন, ‘সমগ্র পৃথিবীর বক্ষে বিচরণের সুবিধার্থে তিনি পৃথিবীকে তোমাদের জন্য সুগম করে দিয়েছেন। অতএব, তোমরা বিচরণ করো ও তাঁর দেয়া রিজিক আহার করো। ’ (সুরা : মুলক, আয়াত : ১৫)

এখানে দুটি বিষয় লক্ষণীয়—প্রথমত, পৃথিবীকে ভ্রমণোপযোগী করে দেওয়া। দ্বিতীয়ত, সমগ্র পৃথিবীতে বিচরণ করে আল্লাহর দেওয়া নিয়ামত তথা রিজিক অন্বেষণ করা। ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের বিচিত্র দ্রব্যের উৎপাদন হয়। স্থলে, জলে, মাটির গর্ভে ও পাহাড়ে বহু মূল্যবান বস্তু রয়েছে, সেগুলো আহরণ করে আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী বাজারজাত করার ইঙ্গিত আয়াতে রয়েছে। যেমন—সুরা জুমআর ১০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘যখন তোমরা সালাত শেষ করো, তখন জমিনে ছড়িয়ে পড়ো এবং নিজ কর্মস্থলে উপস্থিত হয়ে আল্লাহর দেওয়া রিজিক অন্বেষণ করো। ’

পৃথিবীর পুরোটাই মুসলমানদের কর্মস্থল। সুতরাং কোথাও অসুবিধা দেখা দিলে অন্যত্র গিয়ে তারা আল্লাহর দাসত্ব করবে অর্থাৎ আল্লাহর বিধান মতো চলবে ও চলার ব্যবস্থা করবে। মহান রাব্বুল আলামিন জ্ঞান অর্জনের জন্য পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে সফরের প্রতি গুরুত্বারোপ করে ইরশাদ করেছেন, ‘তারা এই উদ্দেশ্যে কেন দেশ ভ্রমণ করেনি যে তারা জ্ঞানসমৃদ্ধ হৃদয় ও শ্রবণশক্তিসম্পন্ন কর্ণের অধিকারী হতে পারে। ’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৪৬)

অর্থাৎ জ্ঞানসমৃদ্ধ হৃদয় ও শ্রবণশক্তির অধিকারী হওয়ার জন্য বিশ্বভ্রমণ করার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।

সফরে গমনাগমনের ক্ষেত্রে রাসুল (সা.)-এর উপদেশ

রাসুল (সা.) দিনের প্রথমাংশে সফরে যাওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করতেন। তিনি উম্মতকে দিনের প্রথমাংশে বরকত দান করার জন্য দোয়া করতেন। ছোট কিংবা বড় কোনো সেনাদল কোথাও পাঠালে তিনি দিনের প্রথম ভাগে পাঠাতেন। প্রিয় নবী (সা.) সফরের ক্ষেত্রে উত্তম সঙ্গী নির্বাচনের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি সফরে সঙ্গী-সাথির সংখ্যা সম্পর্কে বলেছেন যে একজন কিংবা দুজন সঙ্গীর চেয়ে তিনজন সঙ্গী অধিক উত্তম। তিনজনের সফরকে কাফেলা বলা হয়। এক কিংবা দুজনের ওপর শয়তান প্রভাব বিস্তার করতে পারে, কিন্তু তিনজনের ওপর সম্ভব হয় না। রাসুল (সা.) তিনজনের সফরে একজনকে দলনেতা নির্বাচন করতে বলেছেন। মহানবী (সা.) সফরের সময় সওয়ারি উট বা পশুর ওপর নির্যাতন করতে নিষেধ করেছেন। সফরে রাত্রি যাপনের সময় ঐক্যবদ্ধভাবে থাকার কথা বলেছেন।

সফরে সঙ্গী-সাথিদের সাহায্য করা

হিজরতের পর আনসার ও মুহাজিরদের পরস্পরের মধ্যে যে সৌভ্রাতৃত্বের দৃষ্টান্ত, যা মানব ইতিহাসে এক মহান শিক্ষা হয়ে আছে। এমনিভাবে রাসুল (সা.)-এর সফর বা হিজরতে অধ্যায় থেকে আমরা শিক্ষা পেয়ে থাকি তা হলো, নারী, শিশু ও দুর্বলদের কোনো ক্ষতি না করা, এমনকি গাছপালা বা কোনো সৃষ্ট জীবেরও সামান্যতম কষ্ট না দেওয়ার শিক্ষা। মহানবী (সা.)-এর জীবনে সফরে আদ্যোপান্ত অর্থাৎ বাড়ি ফেরা পর্যন্ত শিশু, নারী, পুরুষ, সফরসঙ্গী ও সওয়ারির অধিকারের প্রতি তিনি সজাগ দৃষ্টি রাখতেন। এ ছাড়া সফরের মধ্যে চেলাফেরা, ইবাদত-বন্দেগি, সতর্ক থাকা ইত্যাদি বিষয়ে বিশাল অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা উম্মতের জন্য তিনি রেখে গেছেন, যা অনুসরণ করলে আমাদের ভ্রমণ কিংবা সফর বা হিজরত নিরাপদ হবে। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

হালাল রোজগারের জন্য জমিনে ছড়িয়ে পড়তে মহান রাব্বুল আলামিন নির্দেশ দিয়েছেন। সফর করার মাধ্যমে হালাল উপার্জন, জ্ঞান অর্জনসহ সব ধরনের কল্যাণের কথা কোরআন ও হাদিসে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। কোরআন ও সুন্নাহর নির্দেশিত পন্থায় আমরা দেশ-বিদেশে নিরাপদ সফর করে যেন কল্যাণ অর্জন করতে পারি, মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের সেই তাওফিক দিন। আমিন!