যেমন ছিল দেড় শ বছর আগের হজযাত্রা

যেমন ছিল দেড় শ বছর আগের হজযাত্রা

আলেমা হাবিবা আক্তার

ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে হজযাত্রীরা প্রধানত জাহাজে চড়ে হজে যেতেন। এর ব্যবস্থাপনায় ছিলেন মোগল ও উসমানীয় শাসকরা। কিছু লোক স্থলপথে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরান হয়ে হজে যেতেন। সে সময় জল ও স্থল উভয় পথেই চোর-ডাকাতের প্রচণ্ড ভয় ছিল।

১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আলেকজান্ডার উগলুইকে জেদ্দায় কনসাল জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেয়। তাকে নিয়োগ দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল হিজাজ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করা এবং হাজিদের গমনাগমনের দেখভাল করা। ব্রিটিশ আমলে কেউ হজ করতে চাইলে তিনি করাচি বা বম্বে (আধুনিক মুম্বাই) যেতেন। এরপর জাহাজের টিকিট কিনে পবিত্র হিজাজ ভূমির উদ্দেশে রওনা হতেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত ভারতীয় হজযাত্রীদের পাসপোর্ট প্রয়োজন হতো না। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ১৯২০ সালে ব্রিটেন ভারতীয় হাজিদের জন্য পাসপোর্ট আবশ্যক ঘোষণা করলো। ১৯৩৯ সালে জাহাজ কোম্পানি মোগল লাইন লিমিটেড মুম্বাই থেকে হিজাজ পর্যন্ত ১৬৭ রুপি ভাড়া নিত।

খাজা গোলাম হুসাইন পানিপথি লেখেন, হজে যাওয়ার আগে তিনি পানিপথে কলেরা ও গুটিবসন্তের টিকা নেন এবং ডেপুটি কমিশনার কর্নেলের কাছ থেকে হজের ‘পাস’ গ্রহণ করেন।

১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় ঘটে যাওয়া মহামারীর পর হাজিদের জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষামূলক টিকার প্রবর্তন করেছিল ব্রিটিশ সরকার। সে বছর মক্কায় কলেরা মহামারি দেখা দেয় এবং ৯০ হাজার হাজির মধ্যে ১৫ হাজার হাজি মারা যান। হজের পর মিসর থেকে ব্রিটেন পর্যন্ত কলেরা ছড়িয়ে পড়ে এবং দুই লাখ মানুষ মারা যায়। ১৮৬৬ সালে একটি বৈশ্বিক সম্মেলনে এই সিদ্ধান্ত হয় যে কলেরার উদ্ভব ভারতে হয়েছিল এবং হাজিদের মাধ্যমে তা মিসরীয়দের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকে ইউরোপে বিস্তার লাভ করে।

তখন এই সিদ্ধান্তও হয়েছিল যে পৃথিবীর যে দেশ থেকেই হজযাত্রীরা আসুক না কেন, তারা লোহিত সাগরের পারে একটি কোয়ারেন্টিন সেন্টারে কিছুদিন অবস্থান করার পর পবিত্র হিজাজ ভূমিতে প্রবেশ করবেন।

হজযাত্রীরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ট্রেনে বম্বে আসতেন। তারা যেখান থেকে আসুক না কেন, তাদেরকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান হতো এবং সেখানে এসে কাফেলাবদ্ধ হতেন। অন্যান্য শহরেও হজযাত্রীদের কোনো পরিচিত জন থাকলে তারাও স্টেশনে এসে তাদেরকে বিদায় জানাত, দোয়া চাইত। ভারতের অভ্যন্তরে হজযাত্রীদের নিরাপত্তার কিছুটা অভাব ছিল। কখনো কখনো যাত্রাপথে তারা প্রতারক ও চোরদের কবলে পড়ত। কিন্তু হিজাজ ছিল পরিপূর্ণ নিরাপদ। হিজাজ থেকে নজদ পর্যন্ত একজন হজযাত্রী হাজার পাউন্ড নিয়ে একাকী চলাচল করতে পারতেন।

বম্বেতে হজযাত্রীদের জন্য পৃথক অতিথিশালা ছিল। তারা সেখানে জাহাজের জন্য অপেক্ষা করতেন। জাহাজে প্রত্যেকের জন্য ১৬ বর্গফুট জায়গা বরাদ্দ ছিল। হজের সফরে জিকির-আজকারের বিশেষ আয়োজন ছিল। সেখানে উপস্থিত আলেমরা দ্বিনি আলোচনা করতেন। যেহেতু হজযাত্রীরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান থেকে কাফেলায় অংশ নিতেন, তাই প্রত্যেকে নিজ নিজ এলাকার ঘটনাসমূহ শোনাতেন। এতে যাত্রাপথের ক্লান্তি লাঘব হতো। বোম্বাই থেকে ছেড়ে যাওয়া জাহাজ দুই দিন চলার পর করাচি পৌঁছাত, সেখান থেকে আরো হজযাত্রী ও পাথেয় সংগ্রহ করা হতো। জাহাজ করাচিতে দুই দিন অবস্থান করত। এ সময়ে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির যাত্রীরা নিচে নামার সুযোগ পেতেন। তৃতীয় শ্রেণির যাত্রীরা কোনো কিছু কিনতে চাইলে জাহাজে থেকে বন্দরের ডকের ব্যবসায়ীদের থেকে কিনতে হতো। তারা রশিতে রুপি ছাড়লে নিচ থেকে পণ্য বেঁধে দেওয়া হতো। যাত্রাপথে সমুদ্র উত্তাল হয়ে উঠলে অনেক হজযাত্রী অসুস্থ হয়ে যেতেন, কোনো হাজি ইন্তেকাল করলে জাহাজেই তার জানাজা পড়া হতো এবং কফিনে ভরে লাশ ফেলে দেওয়া হতো।

বম্বে থেকে যাত্রা শুরু করার পর হিজাজে পৌঁছাতে দুই সপ্তাহ বা কয়েক দিন বেশি সময় প্রয়োজন হতো। জেদ্দা যাওয়ার আগে ব্রিটিশ শাসিত কামরানে জাহাজ থামিয়ে হজযাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হতো। জেদ্দায় পৌঁছানোর পর তারা এক দিন বিশ্রাম গ্রহণের পর মোটর গাড়িতে মদিনায় যেতেন। অবশ্য মোটর গাড়ি আসার আগে হজযাত্রীরা উটের পিঠে চড়ে মদিনায় যেতেন। তখন জেদ্দা থেকে মদিনার পথ ছিল উঁচু-নিচু ও মরুময়। কখনো কখনো গাড়ি মরুভূমির বালুতে আটকে গেলে হজযাত্রীরা তা ঠেলে ওঠাতেন। মদিনা থেকে মক্কায়ও যেতে হতো মরুভূমির ওপর দিয়ে। গাড়ি বারবার বালুতে ফেঁসে যেত। ভারতবর্ষের তুলনায় মক্কা-মদিনায় খাবারের মূল্য বেশি ছিল।

খাজা গোলাম হুসাইন পানিপথি লেখেন, মিনায় অনেক বাড়ি ও দোকান হয়েছে। বাড়িগুলো যৌক্তিক মূল্যে ভাড়া পাওয়া যায়। ধনী লোকেরা বাড়ি ভাড়া করে থাকেন, মধ্যবিত্তরা তাঁবু টানিয়ে থাকেন এবং দরিদ্র্যরা খোলা মাঠে থাকেন। তারা ১০ জন মাথাপিছু ৬০ রুপি দিয়ে তিন দিনের জন্য লোক ঠিক করেছিলেন। বিনিময়ে তারা খাবার, পানীয়, আলো ও বাহন হিসেবে উট পেয়েছিলেন। মুজদালিফা, মিনা ও আরাফায় তারা এই উট দিয়ে গমন করেন।

ব্রিটিশ আমলেই হাজিরা সমুদ্রবন্দর থেকে বাড়িতে টেলিগ্রাম বা তার বার্তা পাঠানোর সুযোগ পান। তাই জাহাজে ওঠার আগেই তারা কাপ্তানদের জিজ্ঞাসা করতেন জেদ্দা থেকে জাহাজ বোম্বে কত দিনে পৌঁছাবে। কিন্তু কাপ্তানরা সাধারণত এ বিষয়ে মুখতে চাইতেন না। কেননা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জ্বালানিসংক্রান্ত সমস্যার জন্য কখনো কখনো যথাসময়ে পৌঁছানো সম্ভব হতো না। জাহাজ থেকেও বন্দরগুলোতে জরুরি বার্তা পৌঁছানোর সুযোগ ছিল।

উল্লেখ্য, খাজা গোলাম হুসাইন পানিপথি ১৯৩৫ সালে জলপথে হজ করেন। ফেরার পর তিনি হজের সফরনামা লেখেন। যার মূলকথা এখানে তুলে ধরা হলো।

ইনডিপেনডেন্ট উর্দু ডটকম অবলম্বনে

news24bd.tv/SHS

এই রকম আরও টপিক