চিত্র-১
শাহবাগে ফুটপাতের বিক্রেতাকে এক গ্লাস ঠাণ্ডা লেবু শরবত অর্ডার করলেন আশিক সাহেব। গরমে হাঁসফাঁস আশিক সাহেবের মুখমণ্ডল বেয়ে টপ টপ করে ঝরছিল ঘাম। বলছি, ২০১২ সালের গ্রীষ্মের এক বিকেলের কথা। মিরপুর ১১ থেকে এসেছেন আশিক সাহেব।
চিত্র-২
২০২৩ সালের এক বিকেলে কথা। দুই বন্ধু শ্যাওড়াপাড়ার একটি স্টলে চা খেতে গেছেন। হঠাৎ মনে হলো, তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসটিতে গিয়ে চা খাবেন। শ্যাওড়াপাড়া স্টেশন থেকে উঠে পড়লেন মেট্রোরেলে। ২০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলেন টিএসসিতে। চা খেলেন, বন্ধুদের সঙ্গে জমজমাট আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যার আগেই আবার ফিরে এলেন বাসায়। একসময় এমনটা ছিল যেন রূপ কথার গল্প। সময় বদলেছে। এখন আর আশিক সাহেবের মতো মুখমণ্ডল বেয়ে ঘাম ঝরে না। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মেট্রোরেলে ২ ঘণ্টার পথ ২০ মিনিটে শান্তিতে পাড়ি দেন রাজধানীবাসী।
যেভাবে শুরু
ঢাকার মতো একটি জনবহুল শহরে মেট্রোরেল নির্মাণ ছিল বেশ চ্যালেঞ্জের। তবে সেই চ্যালেঞ্জ দৃঢ়টার সঙ্গে গ্রহণ করে শেখ হাসিনা সরকার। নানা সমালোচনা আর প্রতিবন্ধকতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে মহানগরীর ক্রমবর্ধমান যানবাহন সমস্যা এবং পথের দুঃসহ যানজট ও ভোগান্তি কমাতে বঙ্গবন্ধু কন্যা মেট্রোরেল নির্মাণের উদ্যোগ নেন।
২০০৫ সালে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ঢাকায় স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান (এসটিপি) তৈরি করে মেট্রোরেল নির্মাণের প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু হয়। ওই এসটিপি প্রণয়ন, অনুমোদন এবং শহরের পরিবহন নেটওয়ার্কের জন্য কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এ পরিকল্পনায় ৩টি এমআরটি ও ৩টি বিআরটি লাইন নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়। পরে ২০১৩ সালে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনার অধীনে ঢাকায় মেট্রোরেল স্থাপনের চূড়ান্ত কাজ শুরু হয়। মেট্রোরেলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড। ২০১৬ সালে সংশোধিত ‘কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা অনুসারে ঢাকায় মেট্রোরেলের লাইনের সংখ্যা ৩টি থেকে বাড়িয়ে ৫টি করা হয়। প্রথম পর্যায়ে নির্মাণের জন্য উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২১.২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এমআরটি লাইন ৬-। ২০১৬ সালের ২৬ জুন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এমআরটি লাইন-৬ এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২৮ ডিসেম্বর, ২০২২ সালে এমআরটি লাইন ৬-এর উত্তরা উত্তর থেকে আগারগাঁও অংশ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি মেট্রোরেলের প্রথম আনুষ্ঠানিক যাত্রার অংশ। পরদিন ২৯ ডিসেম্বর এটি জন সাধারণের চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। ৫ নভেম্বর, ২০২৩ এমআরটি লাইন-৬ এর আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশে যাত্রী চলাচল শুরু হয়। এর মাধ্যমে ৬০তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশে মেট্রোরেলে যুক্ত হয়। (তথ্যসূত্র: DMTCL'র বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২২-২৩,পৃষ্ঠা ১০ ও ৮২)।
মেট্রোরেলের স্টেশন
মেট্রোরেলের (এমআরটি লাইন ৬) এই রুটে ১৭টি স্টেশন রয়েছে। এগুলো হলো উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর ১১, মিরপুর ১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কাওরান বাজার, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সচিবালয়, মতিঝিল ও কমলাপুর। কমলাপুর স্টেশনটি নির্মাণাধীন রয়েছে।
দৈর্ঘ্য ও যাতায়াতের সময়
ঢাকার প্রথম মেট্রোরেল এমআরটি-৬ এর মোট দৈর্ঘ্য ২১.২৬ কিলোমিটার। ট্রেনের সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার। উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মোট ১৬টি স্টেশনে থেমে এই ২১.২৬ কিলোমিটার পথ ভ্রমণ করতে মেট্রোরেলের মোট সময় লাগবে ৪০ মিনিট।
নির্মাণ ব্যয়
সরকারের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কাউন্সিল, একনেক ২০১২ সালের ডিসেম্বরে ঢাকার প্রথম মেট্রোরেল প্রকল্প এমআরটি-৬ এর অনুমোদন করে। এরপর ২০১৬ সালের জুন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, এই প্রকল্পের এক চতুর্থাংশ অর্থায়ন করেছে বাংলাদেশ সরকার এবং বাকি টাকার যোগান দিয়েছে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা, জাইকা। শুরুতে মেট্রোরেলের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। কিন্তু পরে নির্মাণের ব্যয় প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার রেলপথ তৈরির লক্ষ্য থাকলেও পরে মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত আরও দেড় কিলোমিটারের বেশি দৈর্ঘ্য বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। ফলে এর খরচ বাড়ে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, এমআরটি-৬ লাইনের সংশোধিত প্রাক্কলিত ব্যয় ৩৩ হাজার ৪৭১ দশমিক ৯৯ কোটি টাকা।
কত যাত্রী ভ্রমণ করছে?
ডিসেম্বর ০৮, ২০২৩ ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিক জানান, উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেলে (এমআরটি লাইন-৬) বর্তমানে প্রতিদিন এক লাখের বেশি যাত্রী ভ্রমণ করছে। ৫ নভেম্বর মতিঝিল পর্যন্ত ট্রেন চলাচল শুরুর পর থেকে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে যাত্রীর সংখ্যা। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বাণিজ্যিকভাবে চলাচল শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত মেট্রোরেলে ভ্রমণ করেছে ১ কোটি ৫১ লাখ যাত্রী।
কোন স্টেশন থেকে কত ভাড়া?
প্রথম পর্যায়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে উদ্বোধন হওয়া উত্তরা নর্থ স্টেশন (দিয়াবাড়ি) থেকে আগারগাঁও স্টেশনের ভাড়া নির্ধারণ করা হয় ৬০ টাকা। মাঝে সাতটি স্টেশনের উত্তরা নর্থ স্টেশন থেকে উত্তরা সেন্টার ও উত্তরা সাউথ স্টেশনের ভাড়া একই, ২০ টাকা। এ ছাড়া প্রথম স্টেশন (উত্তরা নর্থ) থেকে পল্লবী ও মিরপুর-১১ স্টেশনের ভাড়া ৩০ টাকা, মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনের ভাড়া ৪০ টাকা এবং শেওড়াপাড়া স্টেশনের ভাড়া ৫০ টাকা।
এ ছাড়া পল্লবী স্টেশন থেকে মিরপুর-১১, মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনের ভাড়া ২০ টাকা। পল্লবী থেকে শেওড়াপাড়া ও আগারগাঁও স্টেশনের ভাড়া ৩০ টাকা।
মিরপুর-১০ নম্বর থেকে ফার্মগেট ৩০ টাকা ও কাওরানবাজার স্টেশনের ভাড়া ৪০ টাকা। মিরপুর–১০ স্টেশন থেকে শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাড়া ৫০ টাকা। মিরপুর-১০ থেকে সচিবালয় ও মতিঝিল স্টেশনের ভাড়া ৬০ টাকা। আর কমলাপুর স্টেশনে যেতে বাড়তি ১০ টাকা অর্থাৎ ৭০ টাকা ভাড়া দিতে হবে।
ফার্মগেট স্টেশন থেকে উঠে কাওরান বাজারে নামলেও সর্বনিম্ন ২০ টাকা ভাড়া। তবে একই ভাড়া দিয়ে যাওয়া যাবে শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন পর্যন্ত। আর ফার্মগেট থেকে সচিবালয় ও মতিঝিল স্টেশনের ভাড়া ৩০ এবং কমলাপুরের ৪০ টাকা।
অন্যদিকে কমলাপুর স্টেশন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন পর্যন্ত ভাড়া ২০ টাকা। মাঝখানে দুটি স্টেশন মতিঝিল ও সচিবালয়ের ভাড়াও একই। আর কমলাপুর স্টেশন থেকে শাহবাগ ও কাওরান বাজারের ভাড়া ৩০ টাকা, ফার্মগেট ৪০ টাকা, বিজয় সরণি ও আগারগাঁও ৫০ টাকা, শেওড়াপাড়া ৬০ টাকা, কাজীপাড়া ও মিরপুর-১০ স্টেশন ৭০ টাকা, মিরপুর-১১ ও পল্লবী ৮০ টাকা এবং উত্তরা সাউথ স্টেশনের ভাড়া ৯০ টাকা।
মেট্রোরেলে প্রতি কিলোমিটার যেতে যাত্রীদের ৫ টাকা ভাড়া দিতে হচ্ছে। তবে যাত্রীপ্রতি সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা। উত্তরা থেকে মতিঝিল স্টেশন পর্যন্ত ভ্রমণে সর্বোচ্চ ১০০ টাকা ভাড়া দিতে হচ্ছে।
আয়
৪ মার্চ, ২০২৪ জাতীয় সংসদের অধিবেশনে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, ২০২২-২৩ অর্থবছরের চূড়ান্ত হিসাব অনুযায়ী, চালুর ৬ মাসে অর্থাৎ গত জুন মাস পর্যন্ত মেটোরেল থেকে মোট আয় হয়েছে ১৮ কোটি ২৮ লাখ ৬ হাজার ৫১৪ টাকা। এর আগে ৭ জুলাই, ২০২৩ এক অনুষ্ঠানে ওবায়দুল কাদের জানান, বদৈনিক গড়ে ৭০ হাজার যাত্রী মেট্রোরেলে যাতায়াত করছে। ধারাবাহিকভাবে যাত্রী সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মেট্রোরেল থেকে দৈনিক ২৬ লাখ টাকা আয় হচ্ছে।
মেট্রোরেলে প্রযুক্তি
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মেট্রোরেলের নান্দনিক স্টেশনগুলোতে রয়েছে যাত্রীদের অত্যাধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা। ট্রেন অটোমেটিক স্টপ কন্ট্রোলের মাধ্যমে থামছে ও ছেড়ে যাচ্ছে। নানা প্রযুক্তি সুবিধা থাকায় চালকের বেশি কিছু করার নেই। ট্রেন চলছে সফটওয়্যারে। অপারেশন কন্ট্রোল সেন্টারের (ওসিসি) মাধ্যমে পুরো সিস্টেম পরিচালিত হচ্ছে। প্রোগ্রাম রুট কন্ট্রোলার সিস্টেমের মাধ্যমে ট্রেনের রুটগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।
অটোমেশন সিস্টেম: বাংলাদেশের প্রথম উড়াল মেট্রোরেলের নিয়ন্ত্রণ ও যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কমিউনিকেশন বেজড ট্রেন কন্ট্রোল সিস্টেম (সিবিটিসি) যুক্ত করা হয়েছে। অটোমেটিক ট্রেন অপারেশন (এটিও), অটোমেটিক ট্রেন প্রটেকশন (এটিপি), অটোমেটিক ট্রেন সুপারভিশন (এটিএস) ও মুভিং ব্লক সিস্টেম (এমবিএস) রয়েছে। যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য স্ট্ক্রিন ডোর সিস্টেম রয়েছে।
নয়েজ ব্যারিয়ার ওয়াল: চলার সময় মেট্রোরেলের শব্দ ও কম্পন কমাতে লাইনজুড়ে রয়েছে বিশ্বের বিরল ও ব্যয়বহুল আধুনিক প্রযুক্তি ‘নয়েজ ব্যারিয়ার ওয়াল’। নয়েজ ব্যারিয়ার ওয়ালের টেকনোলজি শব্দ কমাতে সহায়তা করায় মেট্রোরেল আশপাশের এলাকার বাসিন্দা, অফিস ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মানুষের কাছে বিরক্তির হবে না।
রেডিও অ্যান্টেনা: মেট্রো রেললাইনের প্রতি ২০০ থেকে ৩০০ মিটার পরপর রেডিও অ্যান্টেনা রয়েছে। প্রতিটি ট্রেনে আছে চারটি করে অ্যান্টেনা। প্রতিটি অ্যান্টেনা ট্রেন ও কন্ট্রোল সেন্টারের (নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র) সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। এর ফলে ট্রেনের দরজা ও প্ল্যাটফর্মের দরজা বরাবর হয় না। উত্তরার দিয়াবাড়ীতে ডিপোয় একটি অপারেশন কন্ট্রোল সেন্টার (ওসিসি) স্থাপন করা হয়েছে। ট্রেন কোথায় কোথায় থামবে, কত সময় থামবে, কত গতিতে চলবে- এর সবই সেখান থেকে আগেই নির্ধারণ করা হয়।
প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ ও বের হতে চিপযুক্ত কার্ড: মেট্রোরেলের টিকিট পুরোপুরিই কম্পিউটারাইজড। প্ল্যাটফর্মে প্রবেশের সময় যাত্রীদের চিপযুক্ত কার্ড পাঞ্চ করতে হবে, তা না হলে দরজা খুলবে না। এরপর নেমে যাওয়ার সময় আবার কার্ড পাঞ্চ করতে হয়, তা না হলে যাত্রী বেরও হতে পারে না। আরেকটি কার্ড সাময়িক, যা প্রতি যাত্রায় দেওয়া হয়। এটাকে সিঙ্গেল জার্নি টিকিটও বলা হয়। স্টেশন থেকে নির্দিষ্ট গন্তব্যের ভাড়া দিয়ে এ কার্ড সংগ্রহ করে হয়। এটিও স্মার্ট কার্ডের মতো।
টিকিট ও ভাড়ার জন্য কার্ড রিচার্জের ব্যবস্থা: স্টেশনে যাত্রীদের তাৎক্ষণিক টিকিট কাটার ব্যবস্থার পাশাপাশি সাপ্তাহিক ও মাসিক টিকিটও কাটা যায় বিশেষ মেশিনে। যাকে বলা হয় রেপিড পাস। এই পাস প্রবেশের মুখে স্পর্শ করালে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দরজা খুলে যায়। এই প্রযুক্তি তৈরি করেছে সনি কোম্পানি। মেট্রোরেলের প্রতিটি স্টেশনে থাকা যন্ত্রে কার্ডে টাকা রিচার্জ করা যায়।
ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরায় সার্বক্ষণিক মনিটরিং: স্টেশনে ও ট্রেনের ভেতরে আধুনিক প্রযুক্তির ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার মাধ্যমে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হয়। শুধু কোচের ভেতর নয়, প্ল্যাটফর্ম ও স্টেশনের ওপরও নজর রাখা হয়।
স্বয়ংক্রিয় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা: মেট্রো স্টেশন, রুট অ্যালাইনমেন্ট এবং ট্রেনে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা হিসেবে স্বয়ংক্রিয় স্প্রিঙ্কলার ও ওয়াটার হাইড্র্যান্ট সংযোজনের ব্যবস্থাও রয়েছে। স্টেশন ও ট্রেনে স্বয়ংক্রিয় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার ফলে নিশ্চিন্তে ও স্বচ্ছন্দে ভ্রমণ করা যাবে।
গ্রিড বিপর্যয় হলেও ট্রেন বন্ধ হবে না: মেট্রোরেলের প্রতিটি সাব স্টেশনে দুটি ট্রান্সফরমার রয়েছে। একটি বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে এবং অন্যটি জরুরি প্রয়োজনে চালু হবে। অর্থাৎ কোথাও বিদ্যুৎ–বিভ্রাট হলেও ট্রেন চলাচল বন্ধ হবে না। জাতীয় গ্রিড বিপর্যয় হলেও ব্যাটারির মাধ্যমে চলমান ট্রেনগুলো নিকটবর্তী স্টেশনে পৌঁছাতে পারবে।
অন্য পরিবহন ছেড়ে মেট্রোরেলে
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ‘মডেলিং প্রিরিসিভড সার্ভিস কোয়ালিটি অব মেট্রোরেল অব ঢাকা সিটি ইউজিং স্ট্রাকচারাল ইকুয়েশন অ্যাপ্রোচ’ শীর্ষক গবেষণার উঠে এসেছে, মেট্রোরেল চালুর পর বাস ছেড়ে মেট্রোরেলে এসেছে এমন যাত্রী ৫৯ দশমিক ৪১ শতাংশ। বাসের পর মেট্রোরেলে সবচেয়ে বেশি যাত্রী আসছে সিএনজি চালিত অটোরিকশা থেকে। জরিপে অংশ নেওয়া ১৪ দশমিক ৯৬ শতাংশ যাত্রী জানিয়েছেন, মেট্রোরেল চালুর আগে তারা যাতায়াতের জন্য সিএনজি চালিত অটোরিকশা ব্যবহার করতেন। একইভাবে মোটরসাইকেল বাদ দিয়ে মেট্রোরেল ব্যবহার করছে এমন যাত্রী ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। আগে রিকশা ব্যবহার করত, বর্তমানে রিকশার বদলে এখন মেট্রোরেল ব্যবহার করছে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ যাত্রী। প্রাইভেট কার ব্যবহার বাদ দিয়ে মেট্রোরেলে চলাচল করছে ৪ দশমিক ৫১ শতাংশ যাত্রী। আর ৬ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ মেট্রোরেল যাত্রী যাতায়াতের জন্য আগে রাইডশেয়ারিং সেবার মাধ্যমে প্রাইভেট কার বা মোটরসাইকেলের মতো বাহন ব্যবহার করত। এর বাইরে অন্যান্য যানবাহন ব্যবহার করত আরও ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ যাত্রী।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব
মেট্রোরেল হওয়ার আগে উত্তরা থেকে মতিঝিল বাসে যেতে সময় লাগতো ৩ থেকে ৪ ঘণ্টার বেশি। এ পথ যেতে এখন সময় লাগে মাত্র ৪০ মিনিট। এর ফলে মানুষের জীবনধারা পরিবর্তনের সঙ্গে উৎপাদনশীল সময়ের বৃদ্ধি ঘটেছে। যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
২০১৮ সালে পরিচালিত বুয়েটের একটি সমীক্ষা অনুসারে, ঢাকা শহরের যানজটের জন্য বার্ষিক ৪.৪ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়, যা জাতীয় বাজেটের ১০ শতাংশের বেশি। ২০১৭ সালের বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকায় যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩.৮ মিলিয়ন কর্ম ঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। নষ্ট কর্ম ঘণ্টার মূল্য বিবেচনায় নিলে ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক আকার ধারণ করে, যা জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে। গবেষকদের মতে, ঢাকার যানজট ৬০ শতাংশ কমাতে পারলে বাংলাদেশ ২.৬ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করতে পারে।
২০২২ সালে ডেইলি স্টারের প্রতিবেদন বলা হয়, মেট্রো রেল প্রকল্পটি প্রতি বছর ২.৪ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করবে, যা জাতীয় জিডিপির ১.৫ শতাংশের সমান। তা ছাড়া মেট্রো রেল ঢাকার ১৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের জন্য যাতায়াত সহজ করবে এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে গতিশীল করবে, যা অর্থনীতিতে একটি বড় ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করবে। হ্যাঁ এরই মেট্রোরেল ব্যবস্থা অর্থনীতিতে দারুণ চাঞ্চল্য এনেছে। ঢাকার যানজট দেশের অর্থনীতির গতি অনেকটাই আটকে রাখে। রাস্তা যত সচল হয়, অর্থনীতিও তত গতিশীল হয়। মেট্রোরেল (এমআরটি লাইন-৬) চালুর পর ঢাকার কিছু এলাকার যানজট অনেকটা কমে গেছে। মিরপুর, রোকেয়া সরণি, ফার্মগেট, কাওরানবাজার, প্রেসক্লাব, পল্টন, মতিঝিলের ব্যস্ত এলাকার অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রাণ পেয়েছে মেট্রোরেলের কারণে। ব্যবসায়ীরা আশার আলো দেখছেন। মেট্রোরেল ঘিরে এসব এলাকার ব্যবসায়ীরা কয়েক বছরে ক্ষতি পুষিয়ে নেবেন বলে আশা করছেন। শুধু পুরোনো ব্যবসায়ীরাই নয়, মেট্রোরেলের পথ ধরে, মিরপুর এলাকায় নতুন নতুন উদ্যোক্তা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছেন। নামি রেস্টুরেন্ট, শপিং মল, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শোরুম সাজাচ্ছেন। মেট্রোরেলের জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় যেন জেগে উঠেছে চারপাশ।
চিরাচরিত ধারণা বদলে দিয়েছে মেট্রোরেল
সাংবাদিক ও লেখক কামরান রেজা চৌধুরী মেট্রোরেলের নিয়মিত যাত্রী। ২৩ জানুয়ারি, ২০২৪ গণমাধ্যমে তিনি লেখেন, ‘বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছ থেকে নেতিবাচক কথা শুনতে শুনতে আমি নিজেও বাংলাদেশের মানুষ সম্পর্কে কখনো কখনো হতাশ হয়ে যেতাম। মনে করতাম, বাংলাদেশের মানুষ কি মেট্রোরেলের মতো সুন্দর ব্যবস্থা রক্ষা করতে পারবে! নাকি বাংলাদেশ রেলওয়ের ট্রেনের মতো মেট্রোরেলের সিট ছিঁড়বে, বিভিন্ন ময়লা টেবিলের নিচে মুছবে, কলম দিয়ে বিভিন্ন অশ্লীল কথা লিখবে, পানের পিক ফেলবে!’
তিনি বলেন, ‘২০২২ সালের ডিসেম্বরে উত্তরা উত্তর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল আংশিক চালু হওয়ার পর থেকে আমি মেট্রোরেলের নিয়মিত যাত্রী। তবে প্রথম দিন যেদিন উঠলাম, দেখলাম সবার মধ্যে উচ্ছ্বাস যেন ঈদের চাঁদ হাতে পেয়েছে। পুরো স্টেশন ঝকঝকে। কম্পার্টমেন্টগুলো তকতকে। কোথাও বিন্দু পরিমাণ ময়লা নেই। নেই চিপসের ঠোঙা, খালি পানির বোতল। মনে হয় আমি ছাড়া কেউ সেলফি অথবা ছবি তুলতে বাদ ছিলেন না। অনেকেই ভিডিও কল করে স্বজনদের দেখাচ্ছিলেন যে মেট্রোরেল কীভাবে চলে। ’
অনেকেই বলছিলেন, ‘প্রথম তো। দেখেন কিছুদিন, কী অবস্থা দাঁড়ায়। ’ ‘তবে মেট্রোরেল সেই ধারণা ভুল প্রমাণ করেছে। প্রতিদিন স্টেশনে উপস্থিত হয়ে দেখতাম কোথাও কোনও ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধ আছে কি না। কম্পার্টমেন্টে কোনও ময়লা রয়েছে কি না। আবার অমুক যোগ তমুক লেখা আছে কি না। কিন্তু না। আমি মেট্রোরেলের নিয়মিত যাত্রী হয়ে দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, পুরো ট্রেনের ছয়টি কম্পার্টমেন্ট তন্ন তন্ন করে খুঁজেও একটি পেনসিলের দাগ পর্যন্ত পাবেন না। ট্রেনে প্রবেশ করলে কোনও দুর্গন্ধ পাবেন না। পিক আওয়ারে গায়ে গায়ে নারী-পুরুষ দাঁড়ালেও পাবেন না কোনও ইতরামির অভিযোগ। কোনও বিদেশিকে সরাসরি মেট্রোরেলের উঠিয়ে দিলে তাঁরা সেটিকে কমপক্ষে সিঙ্গাপুরের মেট্রো বলতে দ্বিধা করবেন না। ’
‘মেট্রোরেলের সঙ্গে বাংলাদেশের গণ পরিবহন ব্যবস্থার তুলনা করতে গিয়ে মিরপুর-১২ থেকে সদরঘাট রুটে চলাচলকারী বিহঙ্গ পরিবহনের এক কন্ডাক্টর একদিন আমাকে যা বললেন, “শোনেন ভাই, মেট্রোরেলে কোনও চুদুরবুদুর (এটি কোনও অশ্লীল শব্দ নয় বলে স্পিকার সংসদে বলেছেন) নাই। তুমি মন্ত্রী হও, আর যা-ই হও না কেন, টিকিট কাটতে হবে। এক পয়সাও কম নাই। তারপর স্টেশনে ঢুকতে পারবে। না হলে যাও। এখানে কোনও ভিআইপি নাই। আর রাস্তায়-বাসে-ট্রেনে মন্ত্রী ও ভিআইপির শেষ নাই। তারপর আছে ছাত্র, আতি নেতা, পাতি নেতা, আরও কত কি। ”’ এ দেশের মানুষের প্রতি চিরাচরিত যে ধরনা, সেটাই যেন বদলে দিয়েছে মেট্রোরেল। একটা সুন্দর সিস্টেম যে মানুষকেও বদলে দিতে পারে মেট্রোরেল তার উদাহরণ।
আরও যেসব মেট্রোরেল হচ্ছে
জাইকা ও ডিএমটিসিএল ২০৩০ নাগাদ আরও ৫টি মেট্রোরেল নির্মাণ করবে। এর মধ্যে রয়েছে- এমআরটি লাইন ১ (বিমানবন্দর যাত্রাপথ): ২০১৯ সালের ১৫ অক্টোবর এমআরটি-১ নামক লাইনটির নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদিত হয়। এমআরটি-১ প্রকল্পের আওতায় বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর ও নতুনবাজার থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত মোট ৩১.২৪ কিলোমিটার পথে মেট্রোরেল নির্মিত হবে। এ প্রকল্পের মোট খরচ ধরা হয়েছে ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাপান সরকার দেবে ৩৯ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা, বাকি ১৩ হাজার ১১১ কোটি টাকা আসবে সরকারি তহবিল থেকে। এমআরটি-১ প্রকল্পে বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১৬ দশমিক ২১ কিলোমিটার হবে পাতাল পথে এবং কুড়িল থেকে পূর্বাচল ডিপো পর্যন্ত ১১.৩৬ কিলোমিটার হবে উড়ালপথে। নতুন বাজার থেকে কুড়িল পর্যন্ত ৩.৬৫ কিলোমিটার আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রানজিশন লাইনসহ ৩১.২৪ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করা হবে। এই মেট্রোরেলের ১২টি স্টেশন থাকবে মাটির নিচে এবং ৭টি থাকবে উড়াল সেতুর ওপর। এমআরটি লাইন-১ হবে দেশের প্রথম পাতাল মেট্রোরেল।
এমআরটি লাইন ১ (পূর্বাচল যাত্রাপথ): নতুন বাজার থেকে পিতলগঞ্জ ডিপো পর্যন্ত ১১.৩৭ কিলোমিটার রেল হবে উড়ালপথে। যার কাজ ২০২৮ সাল নাগাদ শেষ হতে পারে। এর ফলে খুব দ্রুত সময়ে প্রায় ২০ মিনিটে নতুন বাজার থেকে পিতলগঞ্জ যাওয়া যাবে।
এমআরটি লাইন ২: ২০৩০ সালের মধ্যে গাবতলী থেকে চট্টগ্রাম রোড পর্যন্ত উড়াল ও পাতাল সমন্বয়ে প্রায় ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ জি২জি ভিত্তিতে পিপিপি পদ্ধতিতে এমআরটি লাইন ২ নির্মাণ করা হবে। এরই মধ্যে জাপান ও বাংলাদেশ সরকার সহযোগিতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে।
এমআরটি লাইন ৪: পিপিপি পদ্ধতিতে কমলাপুর-নারায়ণগঞ্জ রেলওয়ে ট্রাকের পাশ দিয়ে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়াল মেট্রোরেল হিসেবে এমআরটি লাইন ৪ নির্মাণের উদ্যোগ প্রক্রিয়াধীন, যা শেষ করা হবে ২০৩০ সালের মধ্যে।
এমআরটি লাইন ৫ (উত্তর): এমআরটি লাইন ৫ নির্মাণ প্রকল্পে হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার লাইন নির্মাণ করা হবে। এই প্রকল্পের ৪১ হাজার ২৩৮ কোটি টাকার মধ্যে ২৯ হাজার ১১৭ কোটি টাকা দেবে জাপান আর বাকি ১২ হাজার ১২১ কোটি টাকা দেবে বাংলাদেশ সরকার। প্রকল্পের মোট ২০ কিলোমিটারের মধ্যে সাড়ে ১৩ কিলোমিটার হবে পাতাল পথে আর বাকি সাড়ে ৬ কিলোমিটার হবে উড়াল পথে। এ রুটে মোট ১৪টি স্টেশন হবে, যার মধ্যে ৯টি হবে পাতাল আর ৫টি হবে উড়ালপথে।
এমআরটি লাইন ৫ (দক্ষিণ): ২০৩০ সালের মধ্যে গাবতলী থেকে দাশেরকান্দি পর্যন্ত ১৭.৪০ কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণ করা হবে। তার মধ্যে পাতাল ১২ দশমিক ৮০ কিলোমিটার এবং উড়াল ৪ দশমিক ৬০ কিলোমিটার।
শেষ কথা
বিশ্বের ৬০টিরও বেশি দেশে শহরের ভেতরে গণ পরিবহন হিসাবে মেট্রোরেলের মতো সেবা চালু রয়েছে। এলাকা ভেদে এগুলো মেট্রোরেল, সাবওয়ে, ইউ-বানসহ বিভিন্ন নামে পরিচিত। এশিয়ার মধ্যে ২২তম দেশ হিসেবে মেট্রোরেল সিস্টেম চালু হয়েছে বাংলাদেশে। এমআরটি ৬ লাইনে রেল চালুর মধ্য দিয়ে আজ মেট্রোরেলের বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশ। এ সাফল্যের সুবিধা পাচ্ছেন ঢাকাবাসী। ২০৩০ সালের মধ্যে এমআরটি লাইন ১ থেকে এমআরটি লাইন ৫ পর্যন্ত সবকটি মেট্রোরেল নির্মাণ সম্পন্ন হলে রাজধানীর চিরাচরিত যানজট নির্বাসনে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে; যা ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের অগ্রযাত্রাকে আরও সহজ করবে।
news24bd.tv/আইএএম/কেআই