নির্বাচনের ট্রেন থেমে থাকবে না

সংগৃহীত ছবি

নির্বাচনের ট্রেন থেমে থাকবে না

মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.)

অনলাইন ডেস্ক

সংবিধানকে বলা হয় রাষ্ট্রের প্রাণ। তাই সংবিধান ছাড়া রাষ্ট্র চলতে পারে না। সংবিধানের কোনো বিষয় নিয়ে কারো ভিন্নমত থাকতে পারে, কিন্তু সংবিধান অমান্য করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধ।

নির্বাচন কমিশনের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। সুতরাং সংবিধানে বেঁধে দেওয়া সময়ের বাধ্যবাধকতা অনুসারেই গত ১৫ নভেম্বর নির্বাচন কমিশন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। সংবিধান অনুসারে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের একটা ডেডলাইন বা শেষ সময় আছে। সেটা ঠিক রেখে দুয়েক সপ্তাহ এদিক-ওদিক নির্বাচন কমিশন করতে পারে, এর বেশি কিছু করার এখতিয়ার তাদের নেই।

সুতরাং সময়ে এসে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নির্বাচন কমিশনের হাতে নেই। যাঁরা এটা নিয়ে সমালোচনা করছেন তাঁরাও নির্বাচন কমিশনের জন্য বিকল্প কোনো প্রস্তাব দিতে পারেননি, সে সুযোগ নেই। সুতরাং কমিশন যথার্থ কাজটিই করেছে। তথাকথিত নিরপেক্ষ নামধারী কিছু সুধীজন নানা চতুরতায় নির্বাচন কমিশনকে সংবিধানের বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।

বিকল্প কোনো সাংবিধানিক পন্থার উল্লেখ না করে যাঁরা নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে কথা বলছেন, তাঁদের উদ্দেশ্য ভালো নয় তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। ঘোষিত তফসিল অনুসারে ভোটগ্রহণ হবে ৭ জানুয়ারি। তফসিল ঘোষণার পর আওয়ামী লীগসহ অনেকগুলো দল নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে এক উৎসবমুখর পরিবেশে আছে। অন্যদিকে বিএনপি ও তাদের বড় মিত্র স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে একের পর এক হরতাল-অবরোধের নামে জ্বালাও-পোড়াওসহ জাতীয় সম্পদের ধ্বংসযজ্ঞে নেমেছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালেও বিএনপি-জামায়াত একই রকম ইস্যুতে, একই জ্বালাও-পোড়াও পন্থায় নির্বাচন প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে।

কিন্তু তাতে তারা সফল হয়নি। বরং দেশে-বিদেশে আরো কোণঠাসা ও বিচ্ছিন্ন এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সন্ত্রাসী দল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ২০১৪ সালে বিএনপির সিদ্ধান্ত ও কৌশল যে ভুল ছিল তা কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় আরেকবার বোঝা গেছে। ২০১৪ সালে খোলেদা জিয়ার নেতৃত্বে যা পারেনি এবং যেটি ভুল কৌশল হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে, তার মাধ্যমে বিএনপি এখন ২০২৪ সালে নির্বাচন ঠেকাতে পারবে এমন কথা যুক্তিতে টিকে না। আর নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা? ২০১৪ সালের নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দেশে-বিদেশে কোথাও কোনো সমস্যা হয়নি। ২০১৪ সালে নির্বাচিত দুজন সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী ও শিরীন শারমিন চৌধুরী সদস্য দেশগুলোর ভোটাভুটির মাধ্যমে জয়ী হয়ে যথাক্রমে আন্তর্জাতিক পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশন ও কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্বাচিত হন।

তবে দশম জাতীয় সংসদে ১৫৩ জন সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন, যা মোটেই কাম্য ছিল না। কিন্তু এর জন্য দায়ী কারা বা কোন দল? তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগ বাড়িয়ে বিশাল ছাড় দেওয়ার প্রস্তাবসহ সমঝোতার জন্য সরাসরি টেলিফোন করেন খালেদা জিয়াকে। কিন্তু খালেদা জিয়া সরাসরি শুধু প্রত্যাখ্যান নয়, যে ধরনের অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন তা রাজনৈতিক শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে না। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড আক্রমণ, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা এবং জেলের অভ্যন্তরে চার জাতীয় নেতাসহ অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা হত্যার জন্য যে দল ও দলের প্রতিষ্ঠাতা সরাসরি দায়ী সেই দলের নেত্রীকে আগ বাড়িয়ে যখন সমঝোতার প্রস্তাব দেন তখন বোঝা যায় বঙ্গবন্ধুর মেয়ে সব রকম অপমান ও ক্ষমতার স্বার্থকে উপেক্ষা করে দেশ ও জনমানুষের নিরাপত্তা এবং কল্যাণকে অগ্রগণ্য দৃষ্টিতে দেখেন। ক্ষমতা নয়, দেশের মানুষ আগে। কিন্তু সব কিছুরই একটা সীমা থাকে। আওয়ামী লীগ দেশের সবচেয়ে বড় দল শুধু নয়, এই দলের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, আর শেখ হাসিনা জাতির পিতার মেয়ে। সব সময় জ্বালাও-পোড়াও চালাবে, জাতীয় সম্পদ ধ্বংস করবে, আর এই ভয়ে দেশের মানুষকে বিএনপির অন্যায্য দাবির কাছে মাথা নত করতে হবে, এটা তো কোনো যুক্তির কথা হতে পারে না। বরং রাষ্ট্রের আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে জাতীয় সম্পদ ধ্বংসকারী ও তাদের হুকুমদাতাদের কাছ থেকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ আদায় করা উচিত, সঙ্গে কঠোর শাস্তি প্রদানও জরুরি।

কথায় আছে চোরে শোনে না ধর্মের কাহিনি। আইনি শাস্তিই তাদের প্রাপ্য। বাংলাদেশের মানুষ জ্বালাও-পোড়াওকে ভয় পায় না। একাত্তরে পাকিস্তানিরা জ্বালাও-পোড়াওয়ে ছারখার করেও বাঙালিকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। ইতিহাস থেকে যারা শিক্ষা না নেয়, সময় ও স্রোত তাদের পক্ষে থাকে না। বৃহৎ বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর কেউ কেউ নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা বলছেন, যা বাংলাদেশের মানুষের পছন্দ না হলেও সেটাই বাস্তবতা। আজকের বৈশ্বিক বাস্তবতা এমনই যে প্রতিটি রাষ্ট্রই পারস্পরিক স্বার্থে একে অন্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির দুর্বলতার সুযোগে বন্ধু রাষ্ট্রগুলো নিজ নিজ স্বার্থের জায়গা থেকে কথা বলবে সেটাই স্বাভাবিক। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মৌলিক কথা হলো, প্রতিটি রাষ্ট্রই নিজ নিজ স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে, অন্য দেশের স্বার্থে নয়। নিজ দেশের স্বার্থ সর্বাগ্রে, বাকি যা বলা অথবা করা হয় তা শুধুই অজুহাত মাত্র। আর কূটনীতিতে প্রকাশ্যে যতটুকু যা বলা হয়, তার থেকে অনেক বেশি কাজ হয় অপ্রকাশ্যে। সুতরাং আমরা বাইরে থেকে যা শুনছি ও দেখছি, তার সব কিছুকে বেদবাক্য হিসেবে ধরা যাবে না। সবাই সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়।

সব বিষয়ে প্রত্যেকের ন্যারেটিভ বা ব্যাখ্যা নিজ নিজ স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক যে স্বার্থ রয়েছে তার অংশ হিসেবেই গুরুত্ব পাচ্ছে বাংলাদেশ, বিচ্ছিন্নভাবে নয়। সুতরাং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চূড়ান্ত নির্বাচনের ট্রেন থেমে থাকবে নালক্ষ্য অর্জনের পন্থা মাত্র। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, End justify the means, অর্থাৎ চূড়ান্ত লক্ষ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন পন্থা কেউ অবলম্বন করে না।

এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভারত অপরিহার্য অংশীদার। সুতরাং ভারতের জন্য বড় ধরনের নিরাপত্তার হুমকি সৃষ্টি হয় এমন কোনো অবস্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যাবে, তা যৌক্তিক মনে হয় না। অন্য সব রাষ্ট্রের মতো ভারতও নিজ স্বার্থ বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই স্বাভাবিক। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে জামায়াত-বিএনপির শাসনামলে বাংলাদেশ পাকিস্তানের প্রক্সি হয়ে ভারতের বিরুদ্ধে যে ব্যাপকভাবে আন্ত সীমান্ত সন্ত্রাসে জড়িয়েছিল, সেটি কারো অজানা নয়। ২০০৪ সালের এপ্রিলে চট্টগ্রামে দশ ট্রাক অস্ত্রের চোরাচালান ধরা পড়ার পর বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মানুষ তার চাক্ষুষ প্রমাণ পায়। এটা অন রেকর্ড যে বিএনপির সিনিয়র নেতারা সংসদে বলেছেন, ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোতে যারা সশস্ত্র যুদ্ধ করছে তারা স্বাধীনতাকামী এবং বাংলাদেশের উচিত তাদের সমর্থন দেওয়া। তবে ভারত একাধিকবার স্পষ্ট করে বলেছে, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তারা কোনো কথা বলবে না, এটা সম্পূর্ণ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এখানে অন্য কোনো রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করুক, এটাও ভারত চায় না। সুতরাং বিএনপি যদি নির্বাচনের বিষয়ে কোনো বিদেশি পক্ষের ওপর নির্ভর করে কৌশল নির্ধারণ করে থাকে, তাহলে সেটা বুমেরাং হতে বাধ্য। যেমনটি হয়েছিল ২০১৪ সালে।

ইতিহাস কথা বলে। ইতিহাসই বলে দেয়, নির্বাচন বয়কটের মাধ্যমে কোনো অর্জন বিএনপির হবে না, বরং ক্রমান্বয়ে তারা দেশের জনগণ ও বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছ থেকে দূরে সরে যাবে। তারপর জেলা-উপজেলা পর্যায়ে যাঁরা রাজনীতি করেন তাঁদের জন্য রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে নির্বাচনে অংশগ্রহণ অপরিহার্য। জনগণের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন ও নিজের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধিতে নির্বাচনের বিকল্প আর কিছু নেই। নিজ নিজ চাওয়া-পাওয়ার প্রত্যাশা পূরণে কেউ অলীক কল্পনা নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষা করবে না। বাস্তবতার সঙ্গেই বেশির ভাগ মানুষ থাকবে। সুতরাং দলীয়ভাবে বিএনপি নির্বাচন বয়কট করলেও জেলা-উপজেলা পর্যায়ের অনেক নেতা নিজ দায়িত্বে নির্বাচনে অংশ নেবেন নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্বের স্বার্থে। সুতরাং শেষমেশ নিজ দলের নেতাকর্মীরাও বিএনপির সঙ্গে থাকবে না। আর বিদেশি বন্ধুদের কথা একটু আগেই উল্লেখ করেছি। গত ১৫ বছরে দারিদ্র্য বিমোচন, সন্ত্রাস-জঙ্গি দমন, আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠা, অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের ধারার সঙ্গে বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির সমীকরণ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতা আজ এমন একটি উচ্চতায় পৌঁছেছে যে জনগণের অংশগ্রহণে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হওয়ার পর নতুন সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গে গণভবনে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের লাইন পড়ে যাবে কে কার আগে নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানাবেন। বিএনপির সঙ্গে এখনো যারা ঘুরঘুর করছে তারাও নিজ স্বার্থ রক্ষায় কেটে পড়বে। দুনিয়ার নিয়মই এই, ট্রেন ছাড়ার সময় হওয়ার আগ পর্যন্ত অন্য সহযাত্রীর জন্য প্ল্যাটফরমে অপেক্ষা করলেও সময় হলে আর কারো জন্য অপেক্ষা করে না। ট্রেনে উঠে নিজ আসন দখল করে নেয়। ট্রেনও কে উঠল আর কে উঠল না সেটি দেখে না, সময় হলেই ছেড়ে যাবে।

প্রসঙ্গক্রমে নিজের স্মৃতিতে থাকা ছোট একটা গল্প বলে লেখাটি শেষ করছি। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর সত্তরের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র ছিলাম। সাবসিডিয়ারি ছিল গণিত। গণিতের শিক্ষক অধ্যাপক রমজান আলী সরদার আমাদের ক্যালকুলাসের ক্লাস নিতেন। স্যার ডান হাতে চক আর বাঁ হাতে ডাস্টার নিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে এত দ্রুত লিখতেন আর মুছতেন যে আমরা না পারতাম নোট নিতে, না কিছু বুঝতাম। এভাবে আর কত দিন চলে। একদিন এক ছাত্র সাহস করে দাঁড়িয়ে গেল। স্যার কারণ জিজ্ঞাসা করায় ছাত্রটি বলল যে স্যারকে আমরা অনুসরণ করতে পারছি না এবং কিছু বুঝতেও পারছি না। স্যার একটু থমকে গেলেন। তারপর বললেন, ‘তোমরা অনার্সের ছাত্র, কমপক্ষে একটা মান, অর্থাৎ স্ট্যান্ডার্ড থাকতে হবে। চামচ দিয়ে সব কিছু কেউ মুখে তুলে দেবে না। তারপর স্যার করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে নিজের স্মৃতি থেকে প্রায় একই রকম একটি গল্প শোনালেন। বললেন, ক্লাসে শিক্ষকের বক্তৃতা অনুসরণ করতে না পারায় এক শিক্ষার্থী শিক্ষকের উদ্দেশে বলেছিল, ‘We can not follow punjab mail.’ শিক্ষক তাঁর উত্তরে বলেছিলেন, ‘Punjab mail do not wait for third class passengers.’

নির্বাচনের ট্রেনও কারো জন্য অপেক্ষা করে না।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

এই রকম আরও টপিক