আমি কেন অর্থনীতি নিয়ে এখন আশাবাদী

আবু আহমেদ

আমি কেন অর্থনীতি নিয়ে এখন আশাবাদী

আবু আহমেদ

৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত আমি অর্থনীতির ক্ষেত্রে নিরাশায় নিমজ্জিত হচ্ছিলাম। আমার অর্থনীতির জ্ঞান বারবার আমাকে পীড়া দিচ্ছিল। আমাদের অর্থনীতি এক ঘোর অমাবস্যার বলয়ে প্রবেশ করছিল। যেদিকেই তাকাই আমি শুধু অন্ধকার দেখছিলাম।

রপ্তানির অর্ডারগুলো বাতিল হচ্ছিল, বাংলাদেশি প্রবাসীরা রেমিট্যান্স প্রেরণ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ দ্রুত তলানির দিকে যাচ্ছিল। বাংলাদেশের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে মূল্য হারাচ্ছিল। খোলাবাজারে ডলার বেচাকেনা হচ্ছিল ১২৫-১২৬ টাকায়।

সবার মধ্যে প্রাইস শঙ্কা ছড়িয়ে পড়ল যে ডলারের বিনিময় হার আরো বাড়তে থাকবে। অর্থনীতির মূল্যস্ফীতি কমার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছিল না। বরং আশঙ্কা হচ্ছিল মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। বিনিয়োগ তলানিতে পৌঁছে গেছে।

বিদেশি বিনিয়োগ শূন্যের কোঠায় চলে এসেছিল। শেয়ারবাজারে বেচাকেনা এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমে এসেছিল। হতাশা-ক্ষোভে হাজার হাজার বিনিয়োগকারী তাঁদের বিনিয়োগ হিসাবগুলো বন্ধ করে দিচ্ছিলেন। বাজার সুদের হার বেড়ে ১৭-১৮ শতাংশে পৌঁছে গেছে। দাতারা তাঁদের সাহায্য কমিয়ে দিচ্ছিলেন।

ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে নানা রকমের ঘাটতির দিকে অর্থনীতি অগ্রসর হচ্ছিল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশ বছরখানেকের মধ্যে তার বৈদেশিক দেনা পরিশোধে ব্যর্থ হবে।

অর্থনীতির অধোগতি অবস্থায় রাজস্ব আহরণও কমে যাবে। ফলে সরকারের ঘাটতি বাজেটের আকার বাড়তে থাকবে। সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ করে সেই ঘাটতি পূরণ করবে। ব্যাংকগুলোতে অর্থের অভাব হবে। সরকার বড় রকমের একটা ঋণের ফাঁদে আটকা পড়তে যাচ্ছিল, যার পরিণতি হতো এক ঋণ করে অন্য ঋণ পরিশোধ করা। এর অন্যদিক হলো টাকা ছাপিয়ে ঋণ পরিশোধের দিকে যাওয়া। সমস্ত ম্যাক্রো ইকোনমিক স্থিতিশীলতা ভেঙে পড়ার উপক্রম হতো। অর্থনীতিতে সরবরাহ কমে যেত। বাজারে পণ্যের ঊর্ধ্বমূল্য ভোক্তাদের কম ব্যয়-ভোগ করতে বাধ্য করত। অনেক বেশি লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে প্রবেশ করত। বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে অনেক পণ্য আমদানি হ্রাস পেত। বাংলাদেশ অতিদ্রুত একটা ব্যর্থ অর্থনীতির দিকে ধাবিত হচ্ছিল। সুড়ঙ্গের শেষে অন্ধকারই শুধু দেখা যাচ্ছিল, যে অন্ধকারের রং গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছিল। সেই দিনগুলো ছিল ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত, যখন ছাত্র-জনতার যৌক্তিক আন্দোলন তুঙ্গে উঠতে শুরু করেছিল। তখনকার প্রধানমন্ত্রী যখন চীন থেকে খালি হাতে ফেরত এলেন, অর্থনীতিতে ভোক্তা সমাজের কপালে ভাঁজ পড়াটা আরো গভীর হতে লাগল।

আমি কেন অর্থনীতি নিয়ে এখন আশাবাদীঅনেকেই ভাবা শুরু করেছিল, বছরখানেকের মধ্যে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে দেউলিয়া তকমা পেতে পারে। ওই অবস্থায় দেশ থেকে পুঁজি ও অর্থ পাচার বেড়ে গেল। একটা হতাশার আবহ সবাইকে ঘিরে ধরল। ঘরে ঘরে মানুষ দুশ্চিন্তায় ডুবতে লাগল। সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মা-বাবারা যেন মুষড়ে পড়ছিলেন। ছাত্র-জনতার যৌক্তিক দাবি দমানোর জন্য সরকারি বাহিনী ও পুলিশকে ব্যবহার করা হলো। পৃথিবীর সর্বত্র সরকার সাধারণ চাকরি প্রদানের ক্ষেত্রে মেধার পক্ষে অবস্থান নেয়। বাংলাদেশ হাঁটল উল্টা দিকে। এমনকি সরকার চাকরি প্রদানের ক্ষেত্রে মেধাকে অগ্রাহ্য করে বিভিন্ন কোটার নামে এক বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করল। আর সেই বৈষম্য হটাতে গিয়ে ছাত্রদের জীবন দিতে হবে—এটা কোনো সুস্থ মানুষ চিন্তাও করতে পারে না।

২০১৮ সালে আন্দোলনের মুখে চাকরিতে কোটা সংস্কৃতির অবসান হলো সত্য, সেই মেধাবিরোধী কোটা কোর্টের রায়ের মাধ্যমে আবার ফেরত এলো। সবাই মনে করল এই ফেরত আসাটাও সরকারের ইচ্ছায় হয়েছে। ছাত্ররা তাদের প্রাপ্ত অধিকারের জন্য রাস্তায় নেমেছে। তাদের ওপর গুলি করা হলো। সমাজ থেকে কথা বলার অধিকার বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করে আগেই ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ১৮ কোটি মানুষ তাদের অধিকারগুলো হারাতে বসেছিল। ছাত্র-জনতার আন্দোলন শেষ পর্যন্ত এক দফা সরকার হটানোর আন্দোলনে রূপ নিল। দেশের মানুষের ভাগ্য ভালো যে এই ছাত্র আন্দোলন জনতার আস্থা অর্জনে সফল হলো, তবে অনেক প্রাণের বিনিময়ে।

ছাত্ররা নোবেলজয়ী অধ্যাপক ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দেখতে চাইল। তিনিও সানন্দে রাজি হলেন। অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হলো। দেশ বেঁচে গেছে গেল, সেই সঙ্গে অর্থনীতিও। সবাই এখন আশাবাদের এক উজ্জ্বল আলো দিগন্তে দেখতে পাচ্ছে। অধ্যাপক ইউনূস চাইলে দেশে আবার বিদেশি বিনিয়োগ আসবে। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, আইএমএফ হাত খুলে বাংলাদেশকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে।

একটা আশাবাদের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। হতাশার স্থলে আশাবাদের উত্থান অর্থনীতির ক্ষেত্রেও বড় বিজয় এনে দেবে। অর্থনীতি ক্রনিজম (Cronysm)  থেকে মুক্ত হবে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়তে থাকবে। না বাড়লেও স্থিতিশীল থাকবে। টাকা ডলারের বিপরীতে আর মূল্য হারাবে না। বেশির ভাগ লোক মনে করে, ড. ইউনূসের নেতৃত্বে যে টিম গঠিত হয়েছে, এরা পারবে। এরা না পারলে অন্যরাও পারবে না। ড. ইউনূসকে সময় দিতে হবে। রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি প্রবেশ করেছে, এই দুর্নীতিকে উচ্ছেদ করতে হবে।

ব্যাংকব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। এই ব্যবস্থাকে শক্ত হাতে মেরামত করতে হবে। শেয়ারবাজারে মূল্যসূচকের সাম্প্রতিক যে উত্থান ঘটেছে, সেটাও আস্থার প্রতিফলনের কারণে ঘটেছে। মানুষ ভাবছে তারা মন খুলে কথা বলতে পারবে, মনের ভাব প্রকাশ করতে পারবে। সত্যিকার অর্থে তারা স্বাধীন হয়েছে। সামনে যেকোনো বিষয়ে তাদের মতামতকে মূল্য দেওয়া হবে। আশাবাদ হলো অর্থনীতির ক্ষেত্রে বড় চালিকাশক্তি। মানুষ যদি মনে করে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো হয়ে যাবে, তাহলে এটা ভালো হয়ে যাবে। মানুষের ভাবনাও মানুষকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনুপ্রাণিত করে।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

news24bd.tv/আইএএম