জুলুমের শেষ পরিণাম

জুলুমের শেষ পরিণাম

 মুফতি ইবরাহীম আল খলীল

জুলুম করা মহাপাপ। একটি মারাত্মক কবিরা গুনাহ। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের গণ্ডি ছাড়িয়ে পৃথিবীজুড়ে চলছে জুলুমের ভয়ংকর প্রতিযোগিতা। চারদিকে প্রকাশ পাচ্ছে দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার।

অথচ পরিণতি খুবই ভয়াবহ। অন্যের ওপর অন্যায়-অবিচার করে নিজের পতন ও ধ্বংস ডেকে আনে জালিমরা।

যার যা প্রাপ্য তাকে সেই প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার নাম জুলুম। কারো অধিকার হরণ, বিনা অপরাধে নির্যাতন, আর্থিক, দৈহিক ও মর্যাদার ক্ষতিসাধন, মানহানিকর অপবাদ দেওয়া, দুর্বলের ওপর নৃশংসতা চালানো, নির্যাতন করা, অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ হরণ, উৎপীড়ন বা যন্ত্রণা ইত্যাদি কাজ জুলুমের অন্তর্ভুক্ত।

মানুষের সঙ্গে কারণে হোক আর অকারণে, কোনোভাবেই অন্যায় আচরণ আর জুলুম করা যাবে না। মানুষের প্রতি জুলুম সবচেয়ে মারাত্মক অপরাধ। এ কারণেই অত্যাচারিত ব্যক্তির আবেদন-নিবেদন আল্লাহ তাআলার দরবারে সরাসরি পৌঁছে যায়।

আল্লাহ জালিমদের ব্যাপারে উদাসীন নন

জুলুম এক অমার্জনীয় অপরাধ। এর শাস্তি অনিবার্য ও ভয়াবহ। জালিমদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা উদাসীন নন, বরং সার্বক্ষণিক তিনি সব কিছু দেখছেন। জালিম যত কৌশলীই হোক না কেন, আল্লাহর চোখকে ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তুমি কখনো মনে কোরো না যে জালিমরা যা করছে সে বিষয়ে মহান আল্লাহ উদাসীন। আসলে তিনি সেদিন পর্যন্ত তাদের অবকাশ দেন, যেদিন সব চক্ষু স্থির হয়ে যাবে।

ভীত-বিহ্বল চিত্তে আকাশের দিকে চেয়ে তারা ছোটাছুটি করবে, আতঙ্কে তাদের নিজেদের দিকেও ফিরবে না এবং তাদের অন্তর হবে (ভয়ানক) উদাস...। ’ (সুরা : ইবরাহিম, আয়াত : ৪২-৪৪)
আল্লাহ জালিমকে ছাড় দেন। কিন্তু ছেড়ে দেন না। জালিমকে তার জুলুমের শাস্তি অবশ্যই ভোগ করতে হবে। মজলুমের কাছে মাফ চেয়ে মাফ করানো ছাড়া এ শাস্তি থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই। কারণ তা বান্দার হকের অন্তর্ভুক্ত।  

মজলুমের অভিশাপে জালিমের পতন হয়

মজলুমের অশ্রুফোঁটা ও অন্তরের অভিশাপ জালিমের পতনের অন্যতম কারণ। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তিন ব্যক্তির দোয়া আল্লাহর কাছ থেকে ফেরত আসে না। এক. ইফতারের সময় রোজাদারের দোয়া। দুই. ন্যায়পরায়ণ শাসকের দোয়া। তিন. মজলুমের দোয়া। আল্লাহ তাআলা তাদের দোয়া মেঘমালার ওপর তুলে নেন এবং তার জন্য আসমানের দরজাগুলো খুলে দেন। মহান রব বলেন, আমার সম্মানের শপথ, কিছুটা বিলম্ব হলেও আমি তোমাকে অবশ্যই সাহায্য করব। ’ (জামে তিরমিজি, হাদিস : ৩৫৯৮)

অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) আরো বলেছেন, ‘মজলুমের বদদোয়ার ভয় কোরো। কেননা মজলুমের বদদোয়া ও আল্লাহর মধ্যে কোনো অন্তরাল নেই। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২২৮৬)

অর্থাৎ মজলুমের দোয়া সরাসরি আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায়। মজলুম বা নিপীড়িতের দোয়া কখনো ব্যর্থ হয় না। মজলুমের আর্তনাদের ফলে আল্লাহর পক্ষ থেকে জালিমদের ওপর নেমে আসে কঠিন আজাব। তাদের অধঃপতন ত্বরান্বিত হয়।

জালিম রেহাই পাবে না
মানুষকে তার প্রতিটি কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। এটি সুনিশ্চিত। পরকালীন জীবনে কোনো আদম সন্তানই জবাবদিহি ছাড়া এক কদমও নড়তে পারবে না। ইসলামে সব ধরনের জুলুম বা অত্যাচার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ও হারাম। শুধু জুলুম নয়, জুলুমে সহযোগিতা করা এবং জালিমদের সঙ্গে সুসম্পর্ক ও ঘনিষ্ঠতা রক্ষা করাও হারাম। আর এ বিধান শুধু মুসলমান নয়, কোনো অমুসলিমের ওপর জুলুম করলেও তার জন্য এ হুকুম। ইসলাম মতে, মানুষের ওপর জুলুম এক ভয়াবহ গুনাহ। এ কারণে পরকালে দোজখে প্রবেশ করতে হবে।

আমাদের মনে রাখা দরকার, জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়ন এমন এক অপরাধ, যা সাধারণত আল্লাহ মাফ করেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত ওই মজলুম ব্যক্তি (যার প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে) জালিমকে (অত্যাচারী ব্যক্তিকে) মাফ না করে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমরা জালিমদের প্রতি ঝুঁকে পড়বে না, জালিমদের সহযোগী হবে না, তাহলে আগুন (জাহান্নামের) তোমাদেরও স্পর্শ করবে। ’ (সুরা : হুদ, আয়াত : ১১৩)

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা জালিমকে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত অবকাশ দিয়ে থাকেন। অবশেষে যখন পাকড়াও করেন তখন তাকে আর রেহাই দেন না। অতঃপর তিনি এই আয়াত পাঠ করেন, তোমার প্রভুর পাকড়াও এ রকমই হয়ে থাকে, যখন তিনি জুলুমরত জনপদগুলোকে পাকড়াও করেন। তার পাকড়াও অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক, অপ্রতিরোধ্য। ’ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম) 

মানুষের অধিকার হরণ করা ও তাদের ধনসম্পদ আত্মসাত্ করা অনেক বড় জুলুম। এই ধরনের জুলুমের কারণে পুরো পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। শান্তি ও সম্প্রীতি বিনষ্ট হচ্ছে। বিত্তবানরা দারিদ্র্য শ্রেণিকে ও ক্ষমতাবানরা সাধারণ লোকের প্রতি হিংসার বশবর্তী হয়ে নির্যাতন আর নিপীড়ন করে। ফলে একসময় জালিম বা অন্যায়কারীর জীবনে নেমে আসে নানা বিপদ-আপদ। যারা মানুষের ওপর জুলুম করে এবং প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাদের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই যারা মানুষকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাআলা তাদের শাস্তি প্রদান করবেন। ’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৬১৩)

জুলুমের শেষ পরিণাম
জুলুমের পরিণাম খুবই ভয়াবহ। জুলুম এমন একটি অন্যায় কাজ, যার শাস্তি আল্লাহ তাআলা ইহকালেও দিয়ে থাকেন। জালিমের বিচার শুধু কিয়ামতের দিবসেই হবে না, বরং দুনিয়া থেকেই আল্লাহ তাআলা তাদের জুলুমের প্রতিদান দেওয়া শুরু করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দুটি পাপের শাস্তি আল্লাহ তাআলা আখিরাতের পাশাপাশি দুনিয়ায়ও দিয়ে থাকেন। তা হলো জুলুম ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার শাস্তি। ’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৫১১)

সমাজে বিরাজমান অত্যাচার-অনাচার ও বিশৃঙ্খলা-অস্থিরতার মূল কারণ হলো জুলুম। একে অন্যের ওপর নানা রকম অবিচারের ফলে আল্লাহ তাআলা মানুষের ওপর এ বিশৃঙ্খলা চাপিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘জল ও স্থলভাগে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে তা মানুষের কর্মের ফলস্বরূপ। ’ (সুরা : রুম, আয়াত : ৪১)

পরিশেষে মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তিনি যেন আমাদের জালিমদের অত্যাচার-নিপীড়ন থেকে রক্ষা করেন এবং মজলুমের অভিসম্পাত থেকে বাঁচিয়ে রাখেন। আমিন।

লেখক : শিক্ষক, মাদরাসা আশরাফুল মাদারিস, তেজগাঁও, ঢাকা

এই রকম আরও টপিক