যে কারণে অস্কার পেয়েও নিতে পারেননি ডাল্টন ট্রাম্বো

যে কারণে অস্কার পেয়েও নিতে পারেননি ডাল্টন ট্রাম্বো

অনলাইন ডেস্ক

১৯৫৩ সালে মুক্তি পায় হলিউড রোমান্টিক কমেডি ঘরানার সিনেমা ‘রোমান হলিডে’। অড্র্রে হেপবার্ন ও গ্রেগরি পেক অভিনীত এই সিনেমার প্রকৃত চিত্রনাট্যকার ছিলেন ডাল্টন ট্রাম্বো। সেবার সেরা চিত্রনাট্যের অস্কার ছিল ‘রোমান হলিডে’র। কিন্তু অস্কার পেয়েও তিনি নিতে পারেননি।

কেন নিতে পারেন নি এর পেছনে রয়েছে লম্বা ইতিহাস।  

মূলত ‘রোমান হলিডে’র প্রকৃত চিত্রনাট্যকার ছিলেন ডাল্টন ট্রাম্বো হলে রুপালি পর্দায় চিত্রনাট্যকার হিসেবে নাম ছিল ইয়ান ম্যাকলেলান ও জন ডিগটনের।

পরবর্তীতে মুক্তির ৪০ বছর পর ১৯৯৩ সালে প্রকৃত চিত্রনাট্যকার ডাল্টন ট্রাম্বোকে দেওয়া হয় মরণোত্তর অস্কার।

ডাল্টন ট্রাম্বোর জন্ম ১৯০৫ সালের ডিসেম্বরে, যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোতে।

বাবার আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। চোখে স্বপ্ন ঔপন্যাসিক হওয়ার। পরবর্তীতে সাহিত্য নিয়ে পড়তে ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি অব কলোরাডোতে।

তবে কলোরাডোতে আর থাকা হয়নি ডাল্টনের পরিবারের। আরেকটু ভালো আয়, আরেকটু উন্নত জীবনের আশায় তাঁর পরিবার ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। নতুন জায়গায় এসে তিনি ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়াতে। তবে বেশি দিন আর ছাত্র থাকা হয়নি তাঁর।
লস অ্যাঞ্জেলেসে আসার বছরখানেকের মধ্যেই ডাল্টন ট্রাম্বোর বাবা ওরাস ট্রাম্বো মারা যান। পরিবারের দেখভালের দায়িত্ব পড়ে তাঁর ওপর। তিনি সপ্তাহে ১৮ ডলার পারিশ্রমিকে একটি বেকারিতে কাজ নেন। সেখানে কেটে যায় আট বছর। এরপর সেই কাজ ছেড়ে দেন। মন দেন উপন্যাস ও ছোটগল্প লেখায়।

১৯৩৩ সালে ডাল্টন ট্রাম্বো হলিউড স্পেকটর পত্রিকায় লেখালেখির চাকরি পান। সেই চাকরির সুবাদে পরের বছর তিনি সিনেমাজগতের পরিচিত নাম ওয়ার্নার ব্রাদার্স স্টুডিওতে চিত্রনাট্য পড়ার কাজ পান। ১৯৩৫ সালে তিনি জুনিয়র চিত্রনাট্যকার হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরের বছর তাঁর প্রথম উপন্যাস বাজারে আসে।
এর পরের বছরগুলো ডাল্টন ট্রাম্বোর শীর্ষে ওঠার গল্পে ভরপুর। চল্লিশের দশকের শেষ দিকে চিত্রনাট্য লিখে প্রতি সপ্তাহে তিনি পেতেন চার হাজার ডলার। তিনি তাঁর সময়ের সুপরিচিত ও সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পাওয়া চিত্রনাট্যকারদের একজন। কর্মজীবনের মতো ব্যক্তিজীবনেরও তাঁর বৃহস্পতি তখন তুঙ্গে। ১৯৩৮ সালে তিনি ক্লিও ফিনচারকে বিয়ে করেন। তাঁদের ঘরে আসে তিন সন্তান—খ্রিস্টফার, মিৎজি ও নিকোলা। হলিউড–জীবনের ব্যস্ততা থেকে খানিকটা অবকাশে যেতে কেনেন খামারবাড়ি।

ডাল্টন ট্রাম্বো সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলতেন। ১৯৪৩ সালের ডিসেম্বরে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি মার্ক্সবাদী ছিলেন না, তবে মার্ক্সবাদের অনেক নীতির সঙ্গে একমত ছিলেন।

চল্লিশের দশকের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেওয়ার একটা ঝোঁক তৈরি হয়েছিল। ৮০ হাজার কার্ডধারী কমিউনিস্টের একজন ছিলেন ডাল্টন ট্রাম্বো।

১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে এফবিআইয়ের সদস্যরা হঠাৎ তার খামারবাড়িতে হাজির হন। তাঁকে কমিউনিজমের নামে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে গঠিত দ্য হাউস কমিটি অন আন-আমেরিকান অ্যাকটিভিটিজেসে (এইচইউএসি) হাজির হতে সমন দেওয়া হয়।

ঘটনার আকস্মিকতায় ডাল্টনের ছেলে খ্রিস্টফার জানতে চেয়েছিল, কী হয়েছে? কেন বাবাকে এই লোকদের (এফবিআই সদস্য) সঙ্গে যেতে হবে? তিনি তখন ছেলেকে বলেন, ‘আমরা কমিউনিস্ট। আমাকে ওয়াশিংটনে যেতে হবে আমার কমিউনিজম নিয়ে কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য। ’

এমন সমন হলিউডের ৪০ জনকে পাঠানো হয়েছিল। এর মধ্যে ৩০ জনই আপস করেন ফেলেন। ডাল্টন ট্রাম্বোসহ চিত্রনাট্যকার, পরিচালক ও প্রযোজকদের ১০ জন আপস করেননি।

পরবর্তীতে এই ১০ জন ‘হলিউড ১০’ তকমা পেয়েছিলেন। তাঁদের ‘কালোতালিকা’ভুক্ত করা হয়। হলিউডের বড় বড় নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে বলা হয় তাঁদের কাজ না দিতে। তাঁরা কংগ্রেসের অবমাননা করেছেন মর্মে দোষী সাব্যস্ত হন। ডাল্টনের এক বছরের কারাদণ্ড হয়।

১৯৫০ সালের জুনে ডাল্টন ট্রাম্বো কারাগারে যান। কারাগারে ভালো আচরণের কারণে মেয়াদ পূর্তির দুই মাস আগেই তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।

১৯৪৭ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে তিনি ছদ্মনামে প্রায় ৩০টি চিত্রনাট্য লিখেছেন। এর মধ্যে আছে ধ্রুপদি দুই চলচ্চিত্র ‘রোমান হলিডে’ (১৯৫৩) ও ‘দ্য ব্রেভ ওয়ান’ (১৯৫৬)। দুটিই সেরা চিত্রনাট্যের জন্য অস্কার পায়। তবে তিনি পুরস্কার নিতে যেতে পারেননি। কারণ, কাগজে-কলমে ‘রোমান হলিডে’র চিত্রনাট্যকার ইয়ান ম্যাকলেলান ও জন ডিগটন আর ‘দ্য ব্রেভ ওয়ান’র চিত্রনাট্যকার রবার্ট রিচ।

‘দ্য ব্রেভ ওয়ান’ সিনেমার জন্য রবার্ট রিচের অস্কার পাওয়া প্রসঙ্গে ডাল্টন ট্রাম্বো পরে বিবিসিকে বলেছিলেন, ‘নানাজন এসে দাবি করতে থাকেন যে তিনি রবার্ট রিচ। কেউ কেউ আবার বলেন যে চিত্রনাট্যের গল্প তাঁদের কাছ থেকে চুরি করা হয়েছে। পরিস্থিতি এমন ছিল, আমি যে এটি লিখেছি—এটি বলার কোনো উপায় ছিল না। আমি চুপ করে ছিলাম। কোনো কথা বলিনি। যার জন্য কাজটি করেছিলাম, তার সঙ্গে বোঝাপড়া ছিল, লেখার জন্য টাকাও পেয়েছিলাম। ’

নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও ডাল্টন এত এত চিত্রনাট্য লেখেন যে ‘কালোতালিকা’ একটা হাস্যকর বিষয়ে পরিণত হয়।

১৯৬০ সালে পরিচালক ওটো প্রিমিঞ্জার ও অভিনেতা ক্রিক ডগলাস প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন, আলোচিত ‘স্পার্টাকাস’-এর চিত্রনাট্য ডাল্টন ট্রাম্বোর। আরেক কালোতালিকাভুক্ত লেখক হাওয়ার্ড ফাস্টের উপন্যাস অবলম্বনে তিনি চিত্রনাট্যটি লিখেছিলেন।

কালোতালিকার কারণে বাদ পড়া রাইটার্স ইউনিয়নে আবার অন্তর্ভুক্ত হন ডাল্টন। চিত্রনাট্যকার হিসেবে রুপালি পর্দায় আবারও নিজের নাম দেখে আপ্লুত হন তিনি। হারিয়ে যাওয়া সুনাম-প্রভাব ফিরতে শুরু করে তাঁর কাছে।

১৯৭৫ সালে তিনি ১৯৫৬ সালের ‘দ্য ব্রেভ ওয়ান’ চলচ্চিত্রের জন্য অস্কার-মূর্তিটি হাতে পান। ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে পরের বছর তিনি মারা যান।

এই রকম আরও টপিক

সম্পর্কিত খবর