সোনা চোরাচালানের অভয়ারণ্য দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল

স্বর্ণের বার

সোনা চোরাচালানের অভয়ারণ্য দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল

*যশোরে থেমে নেই পাচারকারীদের তৎপরতা
*ঝিনাইদহ সীমান্তে সক্রিয় একাধিক সিন্ডিকেট 
*পাচারের নিরাপদ রুট এখন চুয়াডাঙ্গা

অনলাইন ডেস্ক

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, যশোর ও সাতক্ষীরা জেলার সীমান্ত এলাকা এখন সোনা চোরাচালানের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এসব এলাকায় সোনা পাচারের একাধিক সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। সাম্প্রতিককালে ভারতে পাচারের সময় এসব এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে সবচেয়ে বেশি সোনা জব্দ হয়েছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সোনার সঙ্গে যাদের আটক করা হয়েছে তাদের ‘বাহক’ বলছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

সিন্ডিকেটের মূল হোতারা ধরা না পড়ায় বন্ধ হচ্ছে না চোরাচালান। অভিযোগ রয়েছে, সোনা চোরাচালানে জড়িত এলাকার প্রভাবশালীরা।

যশোরে থেমে নেই পাচারকারীদের তৎপরতা

যশোর সীমান্তে প্রায়ই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ধরা পড়ে সোনার বড় বড় চালান। তার পরও থেমে নেই সোনা পাচারকারী চক্রের তৎপরতা।

সংশ্লিষ্টদের দাবি, পাচারের সময় জব্দ সোনার সঙ্গে যারা আটক হন তারা সবাই বাহক। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পাচার চক্রের মূলহোতাদের কখনোই শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। যার পরিপ্রেক্ষিতে তারা থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে।

যশোর বিজিবি সূত্র জানায়, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে পরের বছর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যশোরের বিভিন্ন সীমান্তে ২০টি অভিযানে জব্দ করা হয় ৯৩ কেজি ৩৪৭ গ্রাম সোনা। যার মূল্য ৮০ কোটি  টাকারও বেশি। এ ছাড়া গত বছর ১২ নভেম্বর শার্শার কৃষ্ণপুর সীমান্ত থেকে দেড় কেজি ওজনের ১২টি সোনার বার জব্দ করেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা। আটক করা হয় তিনজনকে। একই বছর ২২ আগস্ট চৌগাছা উপজেলার বড় আন্দুলিয়া সীমান্ত থেকে ১৩ কেজি ৪৬৪ গ্রাম ওজনের ৪৩টি সোনার বার জব্দ করে যশোর বিজিবি। যার মূল্য ১৩ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এ ঘটনায় আটক হয় দুজন। এর আগে ২০২২ সালের ২০ এপ্রিল চৌগাছার কাবিলপুর সীমান্ত থেকে ১০ কোটি ১১ লাখ টাকা মূল্যের ১৪ কেজি ৪৫০ গ্রাম ওজনের ১২৪টি সোনার বার জব্দ করে বিজিবি। এ ঘটনায় একজন আটক হয়।

এদিকে চলতি বছরের ১৮ মার্চ যশোর শহরের খাজুরা বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে একটি প্রাইভেট কার আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। সেখান থেকে জব্দ করা হয় ৩ কেজি ৩৫৬ গ্রাম ওজনের ৩২টি সোনার বার। যার মূল্য প্রায় ৩ কোটি টাকা। এ সময় দুজনকে আটক করা হয়। এর এক মাস আগে ১৪ ফেব্রুয়ারি যশোর ও খুলনা বিজিবি যৌথ অভিযান চালিয়ে রাজারহাট থেকে ৯ কেজি ওজনের ৬০টি সোনার বার জব্দ করা হয়।

সূত্রগুলো জানায়, সোনা চোরাচালানের জন্য যশোরের শার্শা উপজেলার অগ্রভুলাট, রুদ্রপুর, সাদীপুর, শিকারপুর, কায়বা, পুটখালী এবং চৌগাছা উপজেলার কয়েকটি সীমান্ত সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়। সোনা পাচার সিন্ডিকেটগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে মাঝেমধ্যে একে অপরের তথ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানিয়ে দেয়। তখন সহজেই তাদের আটক করা যায়। আবার অনেক সময় বড় বড় চালান ছোট ছোট ভাগ করে বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে পাঠানো হয়। তাতে একটি চালান আটক হলেও বাকি চালানগুলো নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে যায়।

এর পরও যশোরের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে পাচারের প্রাক্কালে নিয়মিত বিরতিতে সোনা উদ্ধার করেন বিজিবি সদস্যরা।

বিজিবি, পুলিশ ও সীমান্ত এলাকার সূত্রগুলো জানায়, সোনা চোরাচালানের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অংশে বাহক হিসেবে নিম্নবিত্ত অভাবী মানুষকে নিয়োগ করা হয়। পুরো চোরাচালান প্রক্রিয়াটি কাটআউট পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয়। যে কারণে এ প্রক্রিয়ায় জড়িত কেউই ওপরের নির্দেশদাতাকে চেনেন না বা তার সম্পর্কে কিছুই জানেন না। ফলে পাচারের সময় উদ্ধার হওয়া সোনার সঙ্গে যারা আটক হন, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পাচার চক্রের মূলহোতাদের কখনোই শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। যার পরিপ্রেক্ষিতে তারা থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে।

ঝিনাইদহ সীমান্তে সক্রিয় একাধিক সিন্ডিকেট

ঝিনাইদহসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, যশোর, সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে সোনা পাচারের একাধিক সিন্ডিকেট রয়েছে। এর মধ্যে যশোর-চুয়াডাঙ্গা মহাসড়কের ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার ওপর দিয়ে যাওয়ায় জায়গাটি সহজ রুট হিসেবে মনে করেন সোনা পাচারকারীরা। কারণ এখান থেকে কালীগঞ্জ অতিক্রম করে সহজেই চলে যাওয়া যায় সীমান্তে। তার পরও কালীগঞ্জ পুলিশ প্রশাসন রহস্যজনক কারণে সোনা পাচারের ঘটনা এড়িয়ে যায়। চোরাচালান প্রতিরোধে একটি চেকপোস্টও চোখে পড়ে না ঝিনাইদহ সদর থেকে কালীগঞ্জ, কোটচাঁদপুর ও মহেশপুরে।

সর্বশেষ দেশে সোনা চোরাচালান বেড়ে যাওয়ায় আলোচনায় আসে  মহেশপুর সীমান্ত। সেখানে একাধিক চোরাচালান এবং পাচারকারী চক্র রয়েছে। যার মধ্যে বিজিবির সোর্স পরিচয়ে কিছু লোক এ চোরাচালান সিন্ডিকেট পরিচালনা করেন।

সূত্র বলছে, সোনা চোরাচালান ঠেকানো খুবই কঠিন। কেননা এর পেছনে অনেক বড় মাপের লোকদের হাত থাকে। তাদের চোখের কাঁটা হওয়ার চেয়ে নীরব থাকাই বেশি নিরাপদ। এ কারবারে রাজনীতিবিদ, শিল্পপতি, প্রভাবশালীরা জড়িত থাকায় তাদের কেউ সন্দেহ করে না। সীমান্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও প্রশাসনের একশ্রেণির কর্মকর্তাকে পছন্দের লোক হিসেবে বদলি করিয়ে আনে সোনা চোরাচালান সিন্ডিকেট। সেখানে তাদের নিজস্ব লোক বসানো হয়।

বিজিবি সামান্য পরিমাণ সোনা আটক করলেও মূল হোতারা সব সময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। সোনা চোরাচালান নিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তবর্তী এলাকায় খুনের ঘটনা অনেক ঘটেছে।

এ ছাড়া সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে সম্প্রতি একজন চোরাকারবারি ৭ কেজি সোনা পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়েন। যশোর সীমান্তবর্তী ভারতের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার আংরাইলে জানুয়ারিতে ৩০টি সোনার বার ও বিস্কুট জব্দ করে বিএসএফ। যার ওজন ৪ কেজি ৮২০ গ্রাম। চলতি বছরের প্রথম দিকে মহেশপুর সীমান্ত থেকে ৩০৪টি সোনার বার জব্দ করে বিজিবি। ৩৮ কেজি ৪০ গ্রাম ওজনের ওই সোনার বাজারমূল্য আনুমানিক ২৬ কোটি ২৯ লাখ ১৪ হাজার টাকা। এ সময় আটজন চোরাকারবারি আটক হয়েছেন। মামলা হয়েছে শুধু ১২টি। শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতেও এ দেশ থেকে পাচার হওয়া প্রচুর সোনা আটক হচ্ছে। এর বেশির ভাগই আটক হচ্ছে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোর সীমান্তসংলগ্ন এলাকায়।

এ বিষয়ে মহেশপুর ৫৮ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আজিজুস শহীদ বলেন, ‘চোরাচালান ঠেকাতে আমরা নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে সীমান্তে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করা হচ্ছে। ’

পাচারের নিরাপদ রুট এখন চুয়াডাঙ্গা

দিনদিন সোনা পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে সীমান্তবর্তী চুয়াডাঙ্গা জেলা। এ জেলার দর্শনা, জীবননগর ও কার্পাসডাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভারতে সোনা পাচার হচ্ছে। বর্তমানে দেশের এ সীমান্ত এলাকা আন্তর্জাতিক চোরাকারবারিদের কাছে সোনা পাচারের অন্যতম নিরাপদ রুট হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। প্রায়ই এ জেলার বিভিন্ন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ছোট-বড় সোনার চালান ধরা পড়ে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ২৫ এপ্রিল দর্শনার নাস্তিপুর এলাকা থেকে ৩৭ কেজি ওজনের ৩২০টি সোনার বার আটক করেন বিজিবি সদস্যরা। ভারতে পাচারের সময় চুয়াডাঙ্গা সীমান্ত এলাকায় আটক হওয়া একটি বড় চালান এটি। ২০২৩ সালের ২৮ নভেম্বর দর্শনার রুদ্রনগর এলাকা থেকে ১৬ কেজি ১৪ গ্রাম ওজনের ৯৬টি সোনার বারসহ এক পাচারকারীকে আটক করে বিজিবি।

এর আগে একই বছরের ৮ অক্টোবর দর্শনার বারাদী সীমান্ত এলাকা থেকে ১০ কেজি ২৬৩ গ্রাম ওজনের ৬৮টি সোনার বার জব্দ করা হয়। এ সময় পাচারকারী নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পালানোর সময় ডুবে মারা যান।  

এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে পাচারকারী দল।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতে, সোনা পাচারের সময় যাদের আটক করা হয় তাদের বেশির ভাগই বহনকারী। বেশির ভাগ সময়ই এরা সোনার প্রকৃত মালিকের সন্ধান দিতে ব্যর্থ হয়। ফলে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় বড় পাচারকারীরা।

news24bd.tv/TR/আইএএম   

 

সম্পর্কিত খবর