কেউ যদি প্রকৃতই একাত্তরের যুদ্ধ আর জেনোসাইডকে আমলে নিয়ে কোটা প্রথার কথা ভাবতো তাহলে সবার আগে কোটা পাওয়ার কথা একাত্তরের জেনোসাইডের ভিকটিম পরিবারগুলোর। জেনোসাইডের সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মানুষ জেনোসাইডের ভিকটিম। আসেন বুঝে দেখি। একাত্তরের জেনোসাইডের ভিকটিম মোটা দাগে ১৯৭১ সালের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সাত কোটি মানুষ।
ত্রিশ লাখ মানুষ মারা গিয়ে থাকলে আহত কতজন হয়ে ছিলেন? নিশ্চয়ই নিহতের চেয়ে কম নয়? তারা কি জেনোসাইড ভিকটিম নন? জেনোসাইডের সময় স্কুল বন্ধ ছিল, যারা স্কুলে যেতে পারে নাই তারাও জেনোসাইডের ভিকটিম।
দেড় কোটির ওপরে শুধু ঘর পুড়েছে একাত্তরে, এসবই জেনোসাইডের অংশ। দেড় কোটি ঘরে কয় কোটি মানুষ বাস করতেন? মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা পুড়েছে, এসব প্রার্থনালয়ে যারা প্রার্থনা করতেন এবং পুড়িয়ে ফেলার ফলে আর সেখানে প্রার্থনা করতে পারেননি তারা কি জেনোসাইডের ভিকটিম নন? একমাত্র দেশদ্রোহী জামায়াত-রাজাকার-আলবদর আর তাদের সমর্থক গোষ্ঠী ছাড়া আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ কোনো না কোনো ফর্মে জেনোসাইডের ভিকটিম। সত্যিই যদি মুক্তিযুদ্ধকে একনলেজ করেন তাহলে মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞায় এই বিষয়গুলো একনলেজ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ কোটা বহাল থাকুক আপত্তি নেই, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞাটা রিথিংক করা হোক। মুক্তিযুদ্ধ কিছু নির্দিষ্ট মানুষের মধ্যে আটকে রাখা চলবে না। প্রতিটা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে এতে জায়গা দিতে হবে। জার্মানি, বসনিয়া, রুয়ান্ডার মতো দেশেও কোটা ছিলো। কিন্তু তারা কোটাকে কেবল যুদ্ধে অংশ নেওয়া মানুষের ভেতর সীমাবদ্ধ রাখেনি। তারা একে বিস্তৃত করেছে জেনোসাইড সারভাইভার পর্যন্ত। যেটা আমাদের দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের পওয়া উচিত। আপনারা ভেবে দেখেন একাত্তর সালে যে যুদ্ধে গেছেন এবং অক্ষত ফিরে এসেছেন তিনি বেশি সংকটে আছেন নাকি যিনি যুদ্ধে না গিয়েও হত্যার স্বীকার হয়েছে, রেইপের স্বীকার হয়েছেন, বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তিনি বেশি সংকটে আছেন? বীরের সম্মাননা প্রদান ভিন্ন জিনিস আর কোটা ভিন্ন জিনিস। বীরদের জন্য অনেককিছু রিজার্ভ থাকবে, সুবিধা থাকবে। কোটা থাকবে এই ইভেন্ট অফ জেনসাইডে যারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তাদের জন্য। ক্ষতি হলেই মানুষ পিছিয়ে পড়ে, তখন তাকে কোটা দিয়ে অগ্রসর করাতে হয়।
বাংলাদেশের বর্তমান সরকার প্রমাণ করতে চায়, একাত্তরের যুদ্ধে সাধারণ মানুষের স্টেইক নেই, কিন্তু আমাদের সংবিধান একাত্তরের সংগ্রামকে গণ-মানুষের সংগ্রাম হিসেবেই একনলেজ করে। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা বক্তৃতা দিয়ে গলা ফাটায় যারা রান্না করেছে, যারা পথ দেখিয়েছে, যারা ধর্ষিত হয়েছে তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু কাজের বেলায় তার প্রকাশ আমরা দেখি না। কোটা যদি বহাল থাকতে হয় সেই কোটার নাম এখন আর মুক্তিযোদ্ধা কোটা হতে পারে না, এখন এর নাম হতে হবে মুক্তিযুদ্ধ কোটা, আর এই কোটার ভাগিদার হবে একাত্তরে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন দেওয়া এবং সেই সমর্থন দেওয়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এ দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের সবাই। কোটা পাবে না শুধু তারা যারা এই দেশটা নির্মাণের বিরোধিতা করেছে সেই ১০ শতাংশ মানুষ। তাই বলে তাদের বংশধরদের আমরা ঘৃণা করবো না। আমরা তাদের মেধার জোরে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে বলবো। এই নিয়ম মেনে কোটা ৫০ শতাংশ করলেও বাংলাদেশের মানুষের কোনো আপত্তি থাকবে না। কারণ এই দেশটা গণমানুষের রক্তের উপরেই স্বাধীন হয়েছে।
লেখক ও গবেষক।
news24bd.tv/ডিডি