অলিম্পিক ও বাংলাদেশ

ইকরামউজ্জমান

অলিম্পিক ও বাংলাদেশ

ইকরামউজ্জমান

পুরো দুনিয়ার তারুণ্যের প্রতিনিধিরা প্যারিসে সমবেত হয়েছেন। অলিম্পিক চত্বরে তাঁরা সবাই মিলেমিশে শারীরিক শক্তি, সামর্থ্য, সম্ভাবনা ও মানবিক সৌন্দর্য প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার অপেক্ষায় এখন উত্তেজনা ও স্নায়ুর চাপে ভুগছেন। ‘গ্রেটেস্ট স্পোর্টস ইভেন্ট অন আর্থ’—অলিম্পিক। জীবনের উৎসব।

২৬ জুলাই থেকে শুরু হয়ে পক্ষকাল ধরে চলবে সহমর্মিতা, সহাবস্থান, শান্তি, ভ্রাতৃত্ববোধ এবং দেশ গরিমার জন্য প্রাণপণ লড়াই। অলিম্পিক আয়োজন মানবজাতির অগ্রগতি এবং কল্যাণের জন্য। অলিম্পিক মূলত খেলাধুলার উৎসব হলেও এর আদর্শ, নীতি এবং দর্শন অনেক বড় বিষয়। অলিম্পিক আপন ঐতিহ্যে মহিমান্বিত।

অলিম্পিক একটি আন্দোলন, একটি প্রতিশ্রুতি। একদিকে নীতির মহিমা, আরেক দিকে গতির কাব্য। শক্তি শৈলী বীরপনার। সারা দুনিয়া থেকে খেলোয়াড় ও ক্রীড়াবিদরা নিজ দেশ ও জাতির স্বপ্ন বহন করে নিয়ে আসেন।

স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাঁরা শুধু দেশকে মহিমান্বিত করেন না, নিজেরাও সম্মানিত এবং গৌরবান্বিত হন। অলিম্পিকের বার্তা হলো—মানবজাতির প্রগতির জন্য অতিক্রম কর অনতিক্রম্য বাধা। যারা পিছিয়ে আছ হতাশ হয়ো না, প্রস্তুতি নাও। সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে উদ্যোগকে বাস্তবায়িত করো নিরলস সাধনা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে। মানুষ কখনো সব সময়ের জন্য পরাজিত থাকে না।

দেশে, দেশের ক্রীড়াঙ্গনে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা আছে, থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, তা সত্ত্বেও অর্জনের আলো দেখার চেষ্টায় কুণ্ঠিত হলে চলবে না!

বাস্তবসম্মত ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা না থাকায় অনেক বেশি জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশও অলিম্পিকে কিছুই করতে পারছে না। বাংলাদেশ তাদের একটি। ক্রীড়া সংগঠকরা পারছেন না পরিপক্বতা দেখাতে। সাংগঠনিক দুর্বলতা ক্রীড়াঙ্গনের অগ্রগতির ক্ষেত্রে স্পষ্ট অন্তরায়। অনেক যুক্তি দাঁড় করানোর প্রয়োজন নেই। বিরাজমান কাঠামোর মধ্যেই সমাধান খুঁজতে হবে। অলিম্পিকে মেডেল নিশ্চিত করতে হলে দরকার নির্দিষ্ট উদ্যোগ, আর এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন বড় অঙ্কের অর্থ; সরকারপ্রধান থেকে নিয়ে মন্ত্রণালয়, ফেডারেশনসহ সর্বমহলের সর্বাত্মক সহযোগিতা। ইচ্ছাশক্তি পারে স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে। স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান ভূমিকা নিয়ে ভুল ধারণা আছে। ন্যাশনাল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের ভূমিকা কিন্তু একদম ভিন্ন! বাংলাদেশে বিওএ বিভিন্ন জায়গায় মাথা ঢোকাতে বাধ্য হয়েছে বিভিন্ন কারণে। আসলে কাজটা হলো পুরোপুরি খেলার ফেডারেশন এবং ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের। অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সাহায্যগুলো নিশ্চিত করবে। ন্যাশনাল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের জবাবদিহি শুধু আইওসির কাছে।

অলিম্পিক থেকে মেডেল জেতা সহজ কথা নয়। মুখে মুখে বলে অলিম্পিক মেডেল জেতা কখনো সম্ভব নয়। প্রতিবার অলিম্পিক বছর এলেই সবাই নড়াচড়া দিয়ে বসেন। এরপর প্রধান ভরসা ওয়াইল্ড কার্ডের কৃপায় অংশগ্রহণ। এবার শুধু আর্চার সাগর ইসলাম নিজ যোগ্যতায় অংশ নিচ্ছেন। যাওয়ার আগে সব সময়ই ক্রীড়াঙ্গনের সংস্কৃতি অনুযায়ী প্রতিশ্রুতি দেওয়া আগামী অলিম্পিকের জন্য যথাযথ প্রস্তুতি নেওয়া হবে, যাতে পদক জেতা সম্ভব হয়। যাঁরা মঞ্চে বসে কথাগুলো প্রতিবার মিডিয়াকে বলেন, তাঁরাও জানেন অলিম্পিকের স্বর্ণ ছেলের হাতের মোয়া নয়। অলিম্পিকের প্রস্তুতির জন্য ক্রীড়া সংগঠকদের মানসিকতার পরিবর্তনের পাশাপাশি প্রয়োজন সঠিক রাষ্ট্রীয় চিন্তার প্রতিফলন। যাঁরা পদক জেতেন তাঁরা জানেন অলিম্পিক পদক কত বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর যাঁরা পদক পান তাঁরা জানেন এই পদক পেতে বছরের পর বছর কী করতে হয়।

ক্রীড়াঙ্গনে মুক্ত আলোচনার সুযোগ নেই। চিন্তাশীল, গবেষণাধর্মী কাজকে উৎসাহিত করা হয় না। আমাদের ক্রীড়াঙ্গনে মাতামাতি শুধু সাময়িক ভালো ও খারাপ নিয়ে। ক্রীড়াঙ্গনে অনেক কৃতিত্ব আছে, এগুলো গুটিকয়েক ব্যক্তি বা নির্দিষ্ট যুগের নয়। ধাপে ধাপে এগুলো অর্জিত হয়েছে বহুজনের পরিশ্রমে। ক্রীড়াঙ্গনে ইচ্ছা, আন্তরিকতার অভাব, প্রতিকূল অবস্থা ও সমন্বয়হীনতার জন্য উদ্যোগ গ্রহণে দেরি হয়েছে—অর্থাৎ সময়ে যখন প্রয়োজন ছিল হয়নি। পৃথিবীর কোনো কিছুই অনিবার্য নয়। অনেকে এখন ক্রীড়াঙ্গনে আছেন। একসময় ক্রীড়াঙ্গনে থাকবেন না—ক্রীড়াঙ্গন কিন্তু চলমান। ক্রীড়াঙ্গনের স্বপ্ন সব সময় সমষ্টিগত। ক্রীড়াঙ্গনে সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব হলে ব্যবস্থাপনা এবং পরিষেবার দুর্বলতাগুলো কেটে যাবে। পাল্টাবে ক্রীড়াঙ্গনের চেহারা।

আমরা যখন অলিম্পিক নিয়ে কথা বলি, তখন যদি পেছনের দিকে ফিরে তাকাই দেখব, ক্রীড়াঙ্গনের জীবনপথ আমাদের অবশ্যই অন্যদিকে নিয়ে গেছে। তবে এই পথ পরিবর্তন করা সম্ভব। এর জন্য বাস্তবধর্মী এবং কার্যকরী আট বছর মেয়াদি অর্থাৎ ২০৩২ সালের অলিম্পিক টার্গেট কারে ‘অ্যাকশন প্ল্যান’ তৈরি করা। আমাদের তরুণ মানবসম্পদে সমস্যা নেই। গন্তব্য নিশ্চিত করতে হবে। অলিম্পিকের কোন কোন খেলা আমাদের জন্য উপযোগী। এরপর সম্ভাবনাময় ক্রীড়াবিদ ও খেলোয়াড় বা খেলা নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিয়ে। আর এই আট বছর এই খেলাগুলোর খেলোয়াড়, ক্রীড়াবিদ, দেশি-বিদেশি কোচ, বিদেশে দীর্ঘ সময়ের প্রশিক্ষণ, খেলোয়াড় ও ক্রীড়াবিদদের জন্য মাসিক ভাতা (যা তাঁদের পরিবার পাবে), অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা এবং আট বছর ধরে খেলোয়াড়, ক্রীড়াবিদদের সংশ্লিষ্ট অন্যদের থাকা-খাওয়ার খরচ, স্বাস্থ্য খরচ এবং প্রয়োজনীয় কিছু ক্রীড়াকাঠামো নতুন নির্মাণ এবং সংস্কার সাধন করতে যে অর্থের প্রয়োজন সেটা নির্ধারণ করে একটি ‘এস্টিমেটেড বাজেট’ তৈরি করে খেলার ফেডারেশনগুলো ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে জমা দেবে। আর এই বাজেট সরকারের উঁচু মহল থেকে অনুমোদিত হলেই সবাই মিলে ধর্মকর্ম পালনের মতো কাজে নেমে পড়তে হবে। সুষ্ঠু প্রসেসের মধ্যে চললে এশিয়ান গেমস, কমনওয়েলথ গেমস এবং অলিম্পিক থেকে পদক জয় সম্ভব হবে। ইচ্ছাশক্তিটা হলো সবচেয়ে বড় শক্তি। সবাই মিলে প্রত্যয়ের সঙ্গে কাজ করলে সুন্দরভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব। সম্ভব স্বপ্নপূরণ। সবচেয়ে বড় কথা বিশ্বাস। বিশ্বাস করতে হবে, সবই সম্ভব। যে সময় আমরা পার করে এসেছি, ইতিহাসের সেই অধ্যায়গুলো আর নতুন করে লেখার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু ইতিহাস থেকে তো শিক্ষা নিয়ে সময়ের প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিয়ে সে অনুযায়ী বদলাতে পারি। অলিম্পিক আন্দোলন তো সব সময় বলছে—নিজেকে বদলে ফেলো, নিজেকে প্রস্তুত করো। চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করো। বিজয়ের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। অলিম্পিক দর্শনে অসম্ভব বলে কিছু নেই।

১৯৮৪ সাল থেকে বাংলাদেশ অলিম্পিক গেমসে অংশগ্রহণ করছে। এবারের প্যারিস অলিম্পিক নিয়ে (এবার অংশ নিচ্ছেন পাঁচজন) ‘অলিম্পিয়ান’ হওয়ার গৌরবের অধিকারী হতে যাচ্ছেন ৫৪ জন খেলোয়াড় ও ক্রীড়াবিদ। আর এ ক্ষেত্রে ৩০ বছরে অবশ্য দেশের প্রাপ্তি শূন্য। বিভিন্ন সময়ে ‘ওয়াইল্ড কার্ডে’ অংশগ্রহণ নিয়ে কথা উঠেছে। এ ছাড়া তো উপায় নেই। অলিম্পিকে অংশগ্রহণের জন্য যে ধরনের যোগ্যতা অর্জনের প্রয়োজন, দেশের ক্রীড়াঙ্গনে তো সে পরিবেশ নেই। দেশের ক্রীড়াঙ্গন তো সীমাবদ্ধ গণ্ডিতে আবদ্ধ। এ পর্যন্ত মাত্র দুজন ক্রীড়াবিদ নিজ যোগ্যতায় অংশ নিয়েছেন। তাঁরা হলেন গলফার সিদ্দিকুর রহমান, এরপর আর্চার রোমান সানা। আর এবার নিয়ে অংশগ্রহণ হবে তিনজন—আর্চার সাগর ইসলাম। লক্ষণীয় হলো, আর্চার দুজনের সুযোগ হয়েছে নিজ যোগ্যতায়। আর্চার সাগর ইসলাম ছাড়াও অংশ নেবেন স্প্রিন্টার ইমরানুর রহমান, সুইমার সোনিয়া খাতুন, সামিউল ইসলাম এবং শ্যুটার রবিউল ইসলাম। দেশ ছাড়ার আগে মিডিয়ার সঙ্গে তাঁরা সবাই কথা বলেছেন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। তবে একটি কথা বিবেচনায় রাখতে হবে, তাঁরা কিভাবে কোন পরিবেশে কোন ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে অংশগ্রহণ করতে গেছেন। ছোট একটি উদাহরণ দিচ্ছি—সুইমাররা ‘হ্যান্ডওয়াচের টাইম’ অনুসরণ করে গেছেন অলিম্পিকে অংশ নিতে। সাঁতার ফেডারেশন অসহায়, বছরের পর বছর ধরে ধরনা দিয়েও তাদের সুইমিংপুলের ইলেকট্রনিক অচল ঘড়িটি সচল করতে পারেনি। আইওসির এক সেমিনারে সম্প্রতি আলোচিত হয়েছে, যে কয়টি দেশ কোটি কোটি মানুষ অধ্যুষিত কিন্তু বৃহৎ ক্রীড়াঙ্গনে তাদের মানবসম্পদের সম্ভাবনা প্রতিফলিত হচ্ছে না, এর মধ্যে বাংলাদেশও আছে। দেশটি স্বাধীন হয়েছে চার যুগেরও বেশি আগে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে—ঘুম থেকে এবার জাগার সময়।

লেখক: কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া

news24bd.tv/আইএএম

এই রকম আরও টপিক