তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না/ কোলাহল করি সারা দিনমান কারও ধ্যান ভাঙিব না/ নিশ্চল নিশ্চুপ/ আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধুর ধূপ…। গন্ধবিধুর ধূপ হয়ে জ্বলা দুখুমিয়াকে আজ তাঁরই গানে, তাঁরই কবিতায় স্মরণ করবে বাঙালি। আজ রবিবার ১২ ভাদ্র ১৪২৪ বঙ্গাব্দ সাম্য, প্রেম ও মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী।
বিদ্রোহের কবি কাজী নজরুল মানবতার জয়গানে ছিলেন উচ্চকণ্ঠ।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার পক্ষে অহর্নিশ সংগ্রাম করা মানুষটি যেন বলে কয়েই বিদায় নিয়েছিলেন সবার থেকে। লিখেছিলেন, ‘আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম। সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী হতে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম। ’
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নতুন যুগের স্রষ্টা এখনও যেন বিস্ময়কর আলো হয়ে জ্বলছেন। পথ দেখিয়ে চলেছেন বাঙালিকে। তাঁর কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে বিপুল সমৃদ্ধি। বৈচিত্র্যময় বাংলা গানের সবচেয়ে বড় ভাণ্ডারটির স্রষ্টা তিনি। কাজী নজরুল ইসলাম নিজের সকল সৃষ্টির মধ্য দিয়ে প্রেমের কথা বলেছেন। মানবতার কথা বলেছেন। সাম্যের কবি নারীর প্রতি উপেক্ষা কখনও মেনে নেননি। সমাজের নীচু শ্রেণির মানুষকে কাছে টেনে নিয়েছেন। ধার্মিক মুসলিম সমাজ ও অবহেলিত জনগণের সঙ্গে তাঁর বিশেষ সম্পর্ক থাকলেও সাম্প্রদায়িকতার নিন্দা করেছেন তীব্র ভাষায়। স্বার্থান্ধ মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন সর্বদা। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এই কবি তৎকালীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কারণে অসংখ্যবার জেল খেটেছেন।
অসাম্প্রদায়িক এই কবি বাঙালীর চিন্তা-মনন ও অনুভূতির জগতে নানাভাবে নাড়া দিয়েছেন। অন্যান্য সৃষ্টির পাশাপাশি তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতা নজরুলকে ভিন্ন উচ্চতায় আসীন করে। এ কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে সকল নিপীড়নের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেন কবি। মানবতার বাণী প্রচার করেন। কাছাকাছি সময়ে রচিত তাঁর আরেকটি বিখ্যাত কবিতা ‘কামাল পাশা’। এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সাড়াজাগানো কবিতা সংকলন ‘অগ্নিবীণা’। কাব্যগ্রন্থটি বাংলা কাব্যের ভুবনে পালাবদল ঘটাতে সক্ষম হয়। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে যায়। পরে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আরও কয়েকটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ‘বিদ্রোহী’, ‘কামাল পাশা’ ছাড়াও এই কাব্যগ্রন্থেও ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘আগমনী’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘শাত-ইল্-আরব’ কবিতা দারুণ হৈচৈ ফেলে দেয় সে সময়।
জীবনের শুরুটা ছিল ভীষণ অনিশ্চয়তার। ক্ষণজন্মা মানুষটি ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অতিদরিদ্র পরিবারের সন্তান নজরুলের পড়ালেখার শুরু মক্তবে। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর দারিদ্র্যের কারণে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশিদূর এগোয়নি। মাত্র ১০ বছর বয়সেই পরিবারের ভার কাঁধে নিতে হয় তাঁকে। রুটির দোকানে কাজ শুরু করেন কবি। বালক বয়সেই লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যোগ দেন লেটো দলে। এই দলেই তার সাহিত্যচর্চা শুরু হয়। পরে মসজিদের মুয়াজ্জিন, মাজারের খাদেম হিসেবেও কাজ করেছেন। যৌবনে সেনা সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছেন যুদ্ধেও। সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। করেছেন রাজনীতি। এভাবে অত্যন্ত বর্ণাঢ্য আর বিচিত্র জীবনযাপন করেন নজরুল। ১৯৪২ সালে অগ্রজ রবীন্দ্রনাথের ‘ট্রাজেডি’র আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করেন তিনি। এ বছর চিরবিদ্রোহী রণক্লান্ত নজরুল বাকশক্তি ও মানসিক ভারসাম্য হারান।
এ অবস্থায় ১৯৭২ সালে রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারত থেকে কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। নজরুলকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেন তিনি। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করে। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি তাঁকে দেওয়া হয় একুশে পদক।
কবির জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (তৎকালীন পিজি হাসপাতাল)। দীর্ঘ রোগ ভোগের পর এখানেই ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট পৃথিবীকে চিরবিদায় জানান তিনি।
প্রতিবারের মতো এবারও প্রয়াণবার্ষিকীতে কৃতজ্ঞচিত্তে কাজী নজরুল ইসলামকে স্মরণ করছে বাঙালি। একদিন আগে শনিবার সন্ধ্যায় প্রয়াণবার্ষিকীর বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করে ছায়ানট।
আজ রবিবার সন্ধ্যায় বহুবিধ আনুষ্ঠানিকতায় কবিকে স্মরণ করছে তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত নজরুল ইন্সটিটিউট। থাকবে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। একই অনুষ্ঠান থেকে প্রদান করা হবে নজরুল পুরস্কার ২০১৬।