‘মাঘ মাসে বর্ষে দেবা
রাজ্য ছেড়ে প্রজার সেবা। ’
-খনার বচন।
একদা মানুষের মুখে মুখেই ছড়িয়ে ছিল খনার বচন। গ্রামের কৃষক কথায় কাজে উপমা টানত।
নেতিবাচক চিন্তা মানুষকে শেষ করে দেয়। আগের যুগের মায়েরা শিশু সন্তানের কপালে কালো টিপ দিতেন, যাতে কেউ অমঙ্গল কামনা করতে না পারে। ব্ল্যাক ম্যাজিকের গল্প ছিল। সহজ সরল গ্রামের মানুষ ব্ল্যাক ম্যাজিকে জড়াত। শহরের মানুষও বাদ যেত না। এ বিশ্বাস শুধু বাংলাদেশে নয়, উন্নত বিশ্বে ছিল, আছে। কালো জাদুর সন্ধানে অনেকে কামরূপ কামাখ্যা যেত। অমাবস্যায় শ্মশানঘাটে সাধনা করত। কালো জাদু, তাবিজ করে মানুষ হত্যার গল্পও ছিল। অমঙ্গলের ভয়ে অনেকে অমাবস্যা-পূর্ণিমায় বের হতো না। তার পরও এক বাড়ির বিপদে দশ গ্রাম ছুটে আসত। বিজ্ঞানের এই যুগে এখন সেসব দিন নেই। মানুষের আস্থা বেড়েছে মেডিকেল সায়েন্সে। আবেগ কমেছে। বেড়েছে অন্যের অমঙ্গল কামনা। কেউ কারও ভালো দেখতে পারে না। চোখের বিষেই সব শেষ করে দিতে চায়। কেউ বোঝে না অমঙ্গল কামনায় অন্যকে শেষও করা যায় না, নিজেরও ভালো হয় না। ভালোটুকু জয় করে নিতে হয়। শ্রম মেধা ঘামের বিনিয়োগ থাকতে হয়। জীবনের গথিপথে কাউকে সাময়িক আটকে রাখা যায়। স্থায়ীভাবে নয়।
ট্রাম্প ৬৯ বছর বয়সে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। আর বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট পদ ছেড়েছেন ৫৫ বছর বয়সে। সবার একসঙ্গে সবকিছু হবে তা নয়। চিন্তা ও লক্ষ্য স্থির থাকলে কাউকে দমানো যায় না। শেষ বয়সে সফলতার মুখ দেখেন বিশ্বখ্যাত ফাস্টফুডের চেইনশপ কেএফসির প্রতিষ্ঠাতা কর্নেল হারল্যান্ড সান্ডারস। না, তিনি সেনাবাহিনীর কর্নেল ছিলেন না। সফলতার মাঝামাঝি এ খেতাব পেয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে বাবাকে হারান সান্ডারস। মা যেতেন কাজে। ছোট দুই ভাইবোনকে দেখে রাখার দায়িত্ব ছিল তার। সান্ডারসের ১২ বছর বয়সের সময় মা বিয়ে করেন। জীবিকার সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন সান্ডারস। কাজের খোঁজে যান চাচার কাছে। কম বয়সে কাজে যোগ দেন। বিভিন্ন পেশায় দীর্ঘ সময় ঘুরে স্থিতি পাননি। দেখা মেলেনি সাফল্যের। শেষ বয়সে এসে শুরু করেন ছোটবেলায় শেখা ফ্রাইড চিকেন বানানোর রেসিপির বাস্তবায়ন। প্রথমে বানাতেন বাড়িতে বসে। তারপর শুরু করেন স্বল্প পরিসরে বিক্রি। পেট্রোল পাম্পে চাকরির সময় ফ্রায়েড চিকেন রাখতেন। হোটেল ব্যবসায় যুক্ত হলেন। পারলেন না। আগুনে পুড়ে সব শেষ। সর্বশেষ কেন্টাকি শহরে ফ্রায়েড চিকেনের দোকান খুললেন। সফলতা আসতে শুরু করল। ১০ বছরে ৬০০ শাখা খোলেন। অস্থিরতার কারণে হুট করেই কেএফসি বিক্রি করে দেন ২ মিলিয়নে। বিক্রেতার সঙ্গে চুক্তি হলো লোগোতে ছবি ব্যবহার করতে হবে তাঁর। নিজেও থাকবেন ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হিসেবে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সারা দুনিয়া ঘুরে ঘুরে শিখিয়েছেন ফ্রায়েড চিকেন তৈরি। একজন ব্যর্থ মানুষের শেষ বয়সের সাফল্যের কাহিনি কেএফসি।
আরও পড়ুন: ধর্ষকদের সমাজে চোখ অন্ধ, বিবেকের কণ্ঠও স্তব্ধ
অন্যের সফলতার গল্প অনেকের ভালো লাগে না। নেতিবাচক ভাবনা আমাদের ঘিরে রেখেছে। বেড়েছে সামাজিক, পারিবারিক অপরাধ ভয়াবহভাবে। ন্যায়বিচারের বাণী নীরবে কাঁদে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- সংকটের স্থায়ী সমাধান নয়। সাময়িক সমাধান হতে পারে। সংকটের স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন। আইনের শাসনের বিকল্প নেই। একটা অস্বস্তিকর সময় অতিবাহিত করছি শীত আসার আগেই কুয়াশায় ঢেকে থাকা আকাশের মতো। মনোজগতে পরিবর্তন চলছে। রাষ্ট্র, সমাজের অস্থিরতা ও প্রযুক্তির অপব্যবহারের প্রভাব পড়েছে মানুষের ওপর। রেস্টুরেন্টে খেতে প্রবেশ করছে এক পরিবারের চারজন। খাবার আসার আগ পর্যন্ত কেউ কারও সঙ্গে কথা বলে না। বাবা মা সন্তান সবার চোখ ফোনের ভিতর। সবাই ব্যস্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এক বাড়িতে থেকেও কেউ কারও সঙ্গে কথা বলার সময় নেই। সামাজিক অনুষ্ঠানে গিয়ে পরচর্চা, পরনিন্দা হয়। নিজের জন্য সময় কারও নেই। সুস্থতা নেই। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ বলেছেন, ‘আমি একা। এই ব্রহ্মা-ের ভেতর/একটি বিন্দুর মতো আমি একা। ’ আসলেই তাই। সবাই যার যার মতো একা। ফকির লালন শাহ বলেছেন, ‘সময় গেলে সাধন হবে না। ’ সাধন কীভাবে হবে? জগৎ সংসারে সবাই নিজেরটা নিয়ে আছে। অন্যের সুখ-দুঃখ কাউকে স্পর্শ করে না। একটা হিরোইজমের যুগ চলছে। সবাই নিজেরটা ষোল আনা বোঝে। সমাজের বঞ্চিত মানুষ একসময় বলত, ‘আই উইল সি ইউ ইন কোর্ট। ’ আদালতের ওপর আস্থা ছিল। এ আস্থা শেষ হয়ে গেলে সমাজ টেকে না। জগৎ সংসারে সবাই এখন ক্ষমতাবান। অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সার্ভিস বিচার চেয়েছ একজন এমপির। কার কাছে বিচার চাইছেন প্রশাসনের দায়িত্ববানরা, ক্ষমতার মালিকরা? জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে একটা গ্যাপ তৈরি হয়েছে। মাঠ প্রশাসনে কেউ কাউকে মানছে না। প্রশাসনিক কর্তারা হয়তো ভাবেন, জনগণ নয় তারা এমপি তৈরি করেছেন। সেই এমপিরা কেন খবরদারি করবেন? কিছুটা যুক্তি আছেও বটে! কিছু বলার নেই। তবে কথায় কথায় ট্রেড ইউনিয়নের মতো অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সার্ভিসের বিবৃতিও ভালো বার্তা দেয় না। বুঝি, অধিক ক্ষমতার লোভ রাজনীতিবিদদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে। লাগামহীন করছে। তার পরও সবকিছুর একটা শালীনতা বলে কথা আছে।
আরও পড়ুন: বেনজিরের সেনা ব্রিফ, নজরুলের প্রেম ও আইনের শাসন
নিয়তি সব সময় নিষ্ঠুর হয় নজরুলের সেই কথার মতো, ‘চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়’। সবকিছু সব সময় উন্নয়নে হয় না। স্থাপত্য আর উন্নয়নে সম্রাট শাহজাহান অমর হয়ে আছেন। সৃষ্টিশীল এই সম্রাট মতি মসজিদ, দিল্লির জুমা মসজিদ, আগ্রার খাসমহল, ময়ূর সিংহাসন, শিশমহল, দিল্লির দিওয়ান-ই-আম, শাহজাহানাবাদ শহর, অনেক কিছু প্রতিষ্ঠা করেন। লাহোর, দিল্লি, আগ্রাসহ অনেক শহরে তাঁর স্থাপনাগুলো এখনো স্মৃতি হয়ে আছে। বিশ্বের সেরা স্থাপত্যবিদ আর কারিগর দিয়ে তাজমহল নির্মাণ করে চমকে দেন বিশ্বকে। শাহজাহান চেয়েছিলেন আরেকটি তাজমহল প্রতিষ্ঠা করতে। কালো পাথরের মর্মর সেই স্থাপনা নির্মাণও শুরু করেছিলেন যমুনার অন্য তীরে। এক তীরে শ্বেত পাথর, অন্য তীরে কালো। অনেকটা আলো-আঁধারির দ্যুতির মতো। অন্ধকারের রূপ-সৌন্দর্য সবাই দেখতে পায় না। কেউ কেউ পায়। শাহজাহান শেষ জীবনে অন্ধকারকে ভালোবাসতেন। নির্জনে বসে দেখতেন যমুনার উছলে পড়া জলের স্রোতধারা। সম্রাটের এ অবস্থা হওয়ার কথা ছিল না। হঠাৎ করেই শরীরটা খারাপ হয়। বাবা চলে যাচ্ছেন ভেবে মসনদ দখলের প্রতিযোগিতায় নামলেন সন্তানরা। বাবাকে দেখে রাখতেন দারাশিকো। সম্রাটের দুর্বলতা ছিল তাঁর প্রতি। শাহজাহান চেয়েছিলেন পুত্র দারা হবেন মোগলদের উত্তরাধিকার। কিন্তু বাকি ভাইয়েরা তা মানবেন কেন? তাই চার ছেলে ও এক নাতির মধ্যে সম্পদের বণ্টনও চেয়েছিলেন সম্রাট। আওরঙ্গজেবের ছেলে মুহাম্মদকে পছন্দ করতেন তিনি। কন্যাকে দিয়েছিলেন মধ্যস্থতা করতে। কিন্তু হলো না। কেউ রাজি নন। ক্ষমতার লড়াইয়ে একজোট হলেন আওরঙ্গজেব ও মুরাদ। দারাশিকোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে আগ্রায় এসে হাজির হন। অবস্থান নেন বাবার বিরুদ্ধে। ১৬৫৮ সালে আওরঙ্গজেব আর মুরাদ আগ্রা দুর্গ অবরোধ করেন। বন্ধ করে দেন দুর্গে পানি সরবরাহ। সাত দিন পর তৃষ্ণায় কাতর বৃদ্ধ সম্রাট দুর্গের দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন। আত্মসমর্পণ করেন পুত্রদের কাছে। আটকের পর পিতার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ আনেন ক্ষমতা গ্রহণকারী পুত্র আওরঙ্গজেব। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ছিল রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ ব্যয় করে অপ্রয়োজনীয় স্থাপনা নির্মাণ। ছিল তাজমহলের নামও। অভিযোগের পাহাড় নিয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সাড়ে সাত বছর দুর্গে বন্দী ছিলেন শাহজাহান। এ সময় নিজের কষ্ট-দুঃখ শেয়ার করতেন কন্যা জাহানারা ও নাতি মুহাম্মদের সঙ্গে। পিতার সঙ্গে স্বেচ্ছায় বন্দিত্ব বেছে নিয়েছিলেন জাহানারা। এই জাহানারার প্রেমিককে হত্যা করেছিলেন বাবা শাহজাহান। আর দাদার বন্দিত্ব জীবনের দেখাশোনা, নজরদারির দায়িত্ব ছিল আওরঙ্গজেব-পুত্র মুহাম্মদের। নজরদারির চেয়ে মুহাম্মদ দাদার সঙ্গে গল্প করে সময় কাটাতে বেশি পছন্দ করতেন। কন্যা জাহানারার কবিতা আবৃত্তি শুনতেন সম্রাট। ফারসি কবিতা আবৃত্তিতে জাহানারার সুনাম ছিল। প্রেমিক খুনের পর আর বিয়ে করেননি জাহানারা। গুমরে কাঁদতেন আওরঙ্গজেবের হাতে ভাইদের হত্যার খবর শুনে। বাবাকে এ খবরগুলো তিনি দিতেন। আওরঙ্গজেব কীভাবে চার ভাইকে হত্যা করেছিলেন সে কথা আরেক দিন লিখব।
লেখক: সিইও, নিউজ টোয়েন্টিফোর ও সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।