মৃত্যুও আমাকে ভীত করে না আর কিন্তু গতানুগতিক অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার চিন্তায় আমার গা গুলিয়ে ওঠে।
মৃত্যুর আগে হয়তো এসব ভয় কাটিয়ে উঠব আমি।
-নাজিম হিকমত
চলার পথে অনেক কিছু না ভাবলেও ঘটে। মসনদে ক্ষমতার দম্ভে পরের পরিণতি নিয়ে কেউ ভাবে না।
দুনিয়ায় অনেক কিছুর পরের অ্যাকশনের কথা কেউ ভাবে না। এমনকি ইরাক আক্রমণের সময় আমেরিকা দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়ার কথা চিন্তা করেছিল কিনা সন্দেহ। সেই ইরাক থেকে এখন আমেরিকাকে দূতাবাস গুটিয়ে নিতে হচ্ছে। কারণ বারবার হামলা হচ্ছে তাদের দূতাবাসে। যা কোনোভাবে বন্ধ হচ্ছে না। হিসাব করলে দেখা যায়, সাদ্দামের সময় তাদের দূতাবাস স্বাভাবিকভাবে কাজ করেছিল। অর্থ ক্ষমতার রাজনীতির অনেক জটিলতা থাকে। যার কোনো আগামাথা নেই। ভিয়েতনাম যুদ্ধে কঠিন ধাক্কা খাওয়ার পরও যুদ্ধের দামামা থেকে আমেরিকা সরতে পারেনি। অস্ত্র, তেলসহ নানামুখী ব্যবসার কারণে বারবার তারা যুদ্ধে জড়িয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শান্তির সুবাতাসের কথা সবাই বলতেন। সেই শান্তি আর ফিরে আসেনি। বরং বিশ^ আরও জটিল হয়েছে। যুদ্ধ কোনো শান্তি আনতে পারে না। বরং অস্বাভাবিকতা তৈরি করে। তারপর যুদ্ধ হচ্ছেই। মুসলিম বিশ্ব সবচেয়ে বেশি অশান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত। কারণে অকারণে বড় দেশগুলো ছোটদের নিয়ে তামাশা করে। এ তামাশায় তারা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের চিন্তা করে না। একদল করে অস্ত্রের যুদ্ধ, আরেকদল সাইবারের। সাইবার দুনিয়া এখন অপরাধের স্বর্গরাজ্য। বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা, বিদ্বেষ সবকিছু বদলে দিচ্ছে। অপ্রতিরোধ্য অপরাধ জগতে স্বাভাবিকতার চিন্তা কারও নেই। পরিবার, সমাজ, আল্লাহর ভয়ও দেখি না। দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতার নেতিবাচক প্রভাব সর্বত্র। নিরীহ মানুষ অকারণে হেনস্তা হয়। আর ঘাটে ঘাটে তৈরি হয় হতাশা, বঞ্চনা। আইনের শাসন হয়ে যায় প্রশ্নবিদ্ধ। সেদিন একজন বললেন, ধর্ষণের বিরুদ্ধে বামেরা মাঠে কেন? বললাম সমস্যা কী? কেউ না কেউ তো কথা বলবেই। একটা সময় নাগরিক সমস্যা নিয়ে তারাই কথা বলত। দ্রব্যমূল্য বাড়লে একটা মিছিল হতো। তেল, গ্যাসসহ অনেক ইস্যুতে থাকত মাঠে। সামাজিক ইস্যুতে সর্বকালে বামদের একটা ভয়েস ছিল। সময় এখন বদলে গেছে। প্রযুক্তির আধুনিকায়নে বামদের সেই ভয়েসও নেই। যৌবন ফুরিয়ে বার্ধক্যে ক্ষমতার মৌচাক তাদেরও ভর করেছে। তার পরও কেউ কেউ আলাদা অবস্থান থেকে জানান দেন, তারা আছেন। তাদের শেষ করলে আর কিছুই থাকে না। একদা পূর্ণিমা ধর্ষণের প্রতিবাদ তারাই করেছিল। এখনো ধর্ষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা রাখছে। এ ইস্যুতে শুধু বাম কেন, সবারই কথা বলা উচিত। সরকারি দলেরও বোঝা দরকার গাছের পাতাও আওয়ামী লীগ হয়ে গেলে সংকটের সমাধান হয় না। বরং নতুন জটিলতা দেখা দেবে। এ কারণে সংসদে বিরোধী দলের দরকার পড়ে। গণতন্ত্রের সৌন্দর্য সংসদে বিরোধী দলের শক্ত অবস্থানে। এখানে আসন কমবেশি হতে পারে। ১৯৭৯ সালে মাত্র ৩৯ জন এমপি নিয়ে আওয়ামী লীগ সংসদকে প্রাণবন্ত রেখেছিল। সঙ্গে যুক্ত ছিল ছোট ছোট কয়েকটি দল। ’৮৬ সালে আন্দোলনে ঝড়ের গতি আসে বিরোধী দলের সংসদ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে। ’৯১ সালের সংসদ ছিল আলাদা উচ্চতায়। বিরোধী দল আনীত বিলও পাস হয়েছিল। এখন তেমন দেখা যায় না। চারদিকে আলাদা জগৎ তৈরি হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে। সুস্থধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। মানবতা পদে পদে ভূলুণ্ঠিত। ব্যক্তিজীবনের হিংসা-বিদ্বেষ সমাজকে করছে বিষাক্ত। শেষ নেই সামাজিক অপরাধের। ভন্ড, প্রতারকরা আশ্রয় নিয়েছে ঘাটে ঘাটে।
গৌতম বুদ্ধ বলেছেন, ‘কোনো পাপকে ক্ষুদ্র মনে কোরো না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাপই জমা হতে হতে মূর্খের পাপের ভান্ড পূর্ণ করে ফেলে। ’ হজরত আলী (রা.) বলেছেন, ‘পাপ লুকানোর চেষ্টা করে কোনো দিন কেউ সফলকাম হতে পারে না। পাপের কথা স্বীকার করে যদি কেউ তা ত্যাগ করার চেষ্টা করে তবে তার পক্ষে সফলতা লাভ সহজ হয়। ’ মানুষ চাইলে অনেক কিছু পারে। চুনিবালা দেবী পতিতালয় থেকে উঠে এসে হয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালি’র ইন্দিরা ঠাকরুন। খ্যাতিটা দেখে যেতে পারেননি। মুক্তির আগেই মারা যান। কিন্তু দুর্দান্ত অভিনয় করে এই বয়োবৃদ্ধা দুনিয়া কাঁপিয়ে দেন। সত্যজিৎ পেরেছিলেন একটি প্রতিভাকে খুঁজে বের করে পথ দেখাতে। পথ সবাই চলে। পথ দেখাতে সবাই পারে না।
কাঠিন্য থেকে বেরোনোর পথ তৈরি করতে হবে। কঠোর অবস্থান নিতে হবে বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। ভয়াবহ লোভ মানুষের আবেগ-অনুভূতি, প্রেম-ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছে। ইন্টারনেটে ভালোমন্দ দুই-ই আছে। কিন্তু নোংরামিটুকু নিয়ে সর্বনাশা ফাঁদে পা রাখছে তারুণ্য। সামাজিক অপরাধ রূপ নিয়েছে ক্যান্সারের মতো। এক ভয়ঙ্কর অবস্থার দিকে ছুটে চলেছি আমরা। জাগতিক রহস্যময়তা থেকে বের হতে পারছে না কেউই। কেউ বুঝতে চাইছে না ক্ষণস্থায়ী এ জীবনে আজ আছি কাল নাও থাকতে পারি। নিজের অস্তিত্বের সন্ধান করতে করতে বেলা শেষ হয়ে যাবে। জাগতিক বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই উড়ে যাবে পাখি। শুধু পড়ে থাকবে জগৎ-সংসার। ফকির লালন শাহ, রাধারমণ, কানাই শীল, উকিল মুন্সী, শাহ আবদুল করিমের আধ্যাত্মিক ভাবনায় সংসারকে খুঁজে দেখারও সময় পাওয়া যাবে না। মিশেনারের উপন্যাস ‘দ্য ক্যারাভান’ মানবজীবনকে নতুন ভাবনা দিয়েছে। যাযাবর জীবনে দুঃখকষ্টের মাঝে পথ চলতে হয় পশুপাখির সঙ্গে দীর্ঘ ক্লান্তিকর ভ্রমণে। পরিভ্রমণে ক্লান্ত মানুষের একদিকে প্রেমের আবেগ, অন্যদিকে নিষ্ঠুরতা। আধুনিক আমেরিকান কূটনীতিক প্রেমে পড়েন পাউন্দিয়া এক সুন্দরী নারীর। তারপর কাহিনি এগিয়ে যায়। মরুর মানুষের সঙ্গে সমতলের অনেক পার্থক্য। কষ্ট ও সহিষ্ণুতা, বন্ধুত্ব, হিংসা-বিদ্বেষ, নিষ্ঠুরতায় আফগানদের জীবনযাত্রার সেসব চিত্রই উঠে আসে ক্যারাভানে। আমরা ছুটে চলেছি ক্যারাভানের মতো অজানা পথের দিকে।
প্রকৃতির কঠিন রুক্ষতাকে ধারণ করেই যেতে হচ্ছে সবাইকে। এ কাঠিন্যের মাঝে চলছে সমাজের স্বাভাবিক গতি। এ গতি ও ভালোবাসার টানে কবি নজরুল কঠিন দহন নিয়ে যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়াতেন। কখন কোথায় যাবেন নিজেও জানতেন না। বারবার কবি ছুটে গেছেন কুমিল্লায়। এক বিয়ের অনুষ্ঠানে হুট করে প্রেমে পড়ে বিয়ে করেন নার্গিসকে। এই নারীর আসল নাম সৈয়দা খাতুন। তার মামা আকবর আলী খান ছিলেন কলকাতার পুস্তক প্রকাশনার ব্যবসায় যুক্ত। সে কারণে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে নজরুল আসেন কুমিল্লার মুরাদনগরের দৌলতপুর গ্রামে। পুকুরঘাটে লম্বা কালো কেশের মেয়েটিকে নজরুলের ভালো লেগে যায়। ঘোরলাগা চোখ হৃদয়ে আঘাত হানে পুড়ে যাওয়া মধ্যরাতের তপ্ত মরুর খোলা জোছনার মতো। কবি তাঁর নাম দেন নার্গিস। লেখেন ‘ফুল নেবে না অশ্রু নেবে ভেবে হই আকুল’। আকবর আলী খানের সঙ্গে আলাপ করে বিয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু হায়! বিপত্তি বাধে বিয়ের আসরেই। চালচুলাহীন নজরুলকে ঘরজামাই থাকার প্রস্তাব নিয়েই ঝামেলার তৈরি। অপমানিত বোধ করেন নজরুল। ক্ষুব্ধ ব্যথিত অভিমানী কবি বিয়ের আসর ছেড়েই চলে আসেন কুমিল্লা শহরে। শরীর-মন সব ভেঙে যায়। ক্লান্ত অবসন্ন কবিকে মায়ের স্নেহে বিরজাসুন্দরী দেবী কাছে টেনে নেন। তিনি কুমিল্লার বীরেন্দ্র কুমার সেনগুপ্তের মা। নিজের কাছে আগলে রাখেন নজরুলকে। নজরুলের সঙ্গে প্রমীলার বিয়ে দেন। কবির দহন কিছুটা কমে। কিন্তু মমতার গভীর বন্ধন তৈরি হয় বিরজাসুন্দরীর সঙ্গেও। একবার নজরুল কারাগারে থাকাকালে অনশন করেন। সে অনশন ভাঙার অনুরোধ রবীন্দ্রনাথও করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিরজাসুন্দরীর অনুরোধেই নজরুল অনশন ভাঙেন। সম্পর্কের এ বন্ধনগুলো এখন আর নেই। আপনজনই এখন আর কাছে থাকে না। দূরের বাঁধনগুলো নিয়ে আলোচনা করে কী হবে? ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, নৈতিক, ধর্মীয় মূল্যবোধের দিন শেষ। কথায় কথায় হয় ডিভোর্স। সন্তানের বন্ধনেও জগৎ-সংসার টেকে না। অস্থির সমাজে প্রজন্ম বেড়ে উঠছে একটা ভয়াবহ পরিবেশের মাঝে। একটা অন্ধকার পথ ধরেই হাঁটছি আমরা। আলোর রশ্মি কোথায় কেউ জানি না। এ যুগে ভাবতেও পারি না সেই নার্গিস ১৬ বছর নজরুলের অপেক্ষায় ছিলেন। পরে বিয়ে করেন আরেকজনকে। তিনিও কবি ছিলেন। বিয়ের পর তারা চলে যান ব্রিটেনে। ১৯৮৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন। আর স্তব্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত নজরুল নার্গিসকে নিয়ে লেখেন দুই শতাধিক কবিতা, গান। সেসব দিন আর নেই। তখন মানুষের মনে আবেগ, ভালোবাসা, বিরহ ছিল। মান-অভিমান-ক্ষোভেরও কমতি ছিল না। এখন কোনোটাই নেই। একটা নেতিবাচক সমাজযুগে প্রবেশ করেছি। ধর্ষণের মহামারীর ভয়াবহতা সিলেটে শেষ না হতেই সামনে এলো নোয়াখালী। সারা দেশে ভালো কোনো খবর নেই। মানুষের মনুষ্যত্ববোধ শেষ হয়েছে। দুর্বৃত্তরা এখন সবখানে ভয়াবহ দানবে পরিণত হয়েছে। সব অপরাধ প্রকাশ হয় না। সব অপরাধী ধরা পড়ে না। আড়ালে থেকে যায়। অন্যায় আর অসংগতি শেষ করে দিচ্ছে সমাজকে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পক্ষপাতে গেলে সর্বনাশ হয়ে যায়। মৃত্যুদন্ডের বিধান করেও লাভ হবে না। পরিস্থিতি সামাল দিতে মৃত্যুদন্ডের বিধান করতে আইন সংস্কারের দরকার ছিল। কিন্তু সতর্ক থাকতে হবে। আইনের অপব্যবহার করা যাবে না। মিথ্যা অভিযোগ এনে কাউকে হয়রানি করলে পাল্টা শাস্তির ব্যবস্থাও রাখতে হবে। আর সবার আগে দরকার আইনের শাসন কার্যকরের ব্যবস্থা। আইনের শাসন স্বাভাবিক থাকলে অপরাধ করার সাহস কারও থাকে না।
লেখক: সিইও, নিউজ টোয়েন্টিফোর ও সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।