হজ ব্যবস্থাপনায় যেসব সংস্কার করেছিলেন নবীজি (সা.)  

হজ ব্যবস্থাপনায় যেসব সংস্কার করেছিলেন নবীজি (সা.)  

 মুফতি আতাউর রহমান

ইসলাম আসার আগেই হজের প্রচলন ছিল। শরিয়তে হজ কখন ফরজ হয়েছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের ভেতর মতভিন্নতা আছে। তবে আল্লামা ইবনুল কাইয়িম জাওজি (রহ.) দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, নবম বা দশম হিজরিতে হজ ফরজ হয়েছিল। তিনি লেখেন, ‘এ বিষয়ে কোনো বিরোধ নেই, হিজরতের পর নবীজি (সা.) শুধু একবারই হজ করেছিলেন।

তা হলো বিদায় হজ। এ বিষয়েও কোনো বিরোধ নেই, বিদায় হজ দশম হিজরিতেই হয়েছিল। আর এ বিষয়েও কোনো সন্দেহ পোষণের সুযোগ নেই যে হজ ফরজ হওয়ার পর তিনি কোনো বিলম্ব ছাড়াই তা আদায় করেছেন। ’ (জাদুল মাআদ)

ইসলাম হজ ব্যবস্থায় যে পরিবর্তন আনে রাসুলুল্লাহ (সা.) হজের বিধি-বিধানকে শিরক, কুসংস্কার ও বিদআত মুক্ত করেন।

নিম্নে হজ কার্যক্রমে নবীজি (সা.)-এর সংস্কারগুলো তুলে ধরা হলো—

১. কাবাঘরকে মূর্তিমুক্ত করা: রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কা বিজয়ের পর কাবাঘরকে মূর্তিমুক্ত করেন। তখন কাবাঘরে ৩৬০টি মূর্তি ছিল। কথিত আছে, এসব মূর্তি আরবের বিভিন্ন অঞ্চল ও কবিলার প্রতিনিধিত্ব করত। রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কা বিজয়ের পর কাবা চত্বরে প্রবেশ করেন।

তিনি একটি ধনুকের সাহায্যে মূর্তিগুলোকে খোঁচা দিচ্ছিলেন এবং পাঠ করছিলেন, ‘সত্য সমাগত, মিথ্যা দূরীভূত আর নিশ্চয়ই মিথ্যার বিনাশ অবশ্যম্ভাবী। ’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৮১)
তখন একেকটি মূর্তি মুখ থুবড়ে পড়ছিল। এ সময় কাবাঘরে টাঙানো কিছু ছবিও ধ্বংস করা হয়। (নবীয়ে রহমত, পৃষ্ঠা-৩৩৮)

২. তাওয়াফের বৈষম্য দূর: জাহেলি যুগে কেবল কুরাইশ, তাদের বংশোদ্ভূত ও মিত্ররাই কাপড় পরিধান করে তাওয়াফের অনুমতি পেত। অন্যদের উলঙ্গ হয়ে তাওয়াফ করতে হতো, নতুবা হুমসদের কাছ থেকে কাপড় কিনে বা ধার নিয়ে তা পরে তাওয়াফ করত।

ইসলাম এই বৈষম্য দূর করে এবং উলঙ্গ হয়ে তাওয়াফ করাকে নিষিদ্ধ করে। ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন তারা কোনো অশ্লীল আচরণ করে তখন বলে, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষকে এটা করতে দেখেছি এবং আল্লাহও আমাদেরকে এটার নির্দেশ দিয়েছেন। বলো, আল্লাহ অশ্লীল আচরণের নির্দেশ দেন না। তোমরা কি আল্লাহ সম্পর্কে এমন কিছু বলছ, যা তোমরা জানো না?’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ২৮)

৩. হাত বেঁধে তাওয়াফ না করা: জাহেলি যুগের মানুষ বিশ্বাস করত তাওয়াফ করার সময় তারা পরস্পরের হাত কিছু দিয়ে বেঁধে নিলে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করবে। ইসলাম এই রীতি নিষিদ্ধ করেছে। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বাইতুল্লাহর তাওয়াফের সময় এক ব্যক্তির কাছ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন, সে চামড়ার ফিতা বা সুতা অথবা অন্য কিছু দ্বারা আপন হাত অপর এক ব্যক্তির সঙ্গে বেঁধে দিয়েছিল। নবী (সা.) নিজ হাতে তার বাঁধন ছিন্ন করে দিয়ে বললেন, হাত ধরে টেনে নাও। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৬২০)

৪. কাবাঘর ছাড়া অন্য কিছুর তাওয়াফ নিষিদ্ধকরণ: আরবরা শুধু কাবাঘরের তাওয়াফ করত না, বরং একাধিক ঘর, দেবালয়, পাথর ও স্থাপনার তাওয়াফ করত। এগুলোকে তারা কাবাঘরের সমকক্ষ মনে করত। যেমন বনি সাকিফ গোত্রের স্থপতি দেবতা লাতের মন্দির। রাসুলুল্লাহ (সা.) কাবাঘর ছাড়া অন্য সব কিছুর তাওয়াফ নিষিদ্ধ করেন। আবু সুফিয়ান ও মুগিরা (রা.)-কে পাঠিয়ে লাতের মন্দির ধ্বংস করেন। (কিতাবুল মুহাব্বার, পৃষ্ঠা-৩১৫)

৫. পরকালীন দোয়া শিক্ষা: ইসলামপূর্ব যুগে হাজিরা পার্থিব কল্যাণের জন্য দোয়া করতেন। তাঁদের দোয়ায় পরকাল থাকত অনুপস্থিত। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, জাহেলি যুগের লোকেরা হজের সময় কেবল পার্থিব উন্নতির জন্য দোয়া করত। যেমন তারা বলত, হে আল্লাহ! এই বছরকে বৃষ্টি ও সবুজের বছর করুন, সুন্দর সন্তানের বছর করুন, আমাদের সম্পদ ও সন্তান বাড়িয়ে দিন ইত্যাদি। তাদের ব্যাপারে নাজিল হয়, ‘মানুষের মধ্যে যারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ইহকালেই দাও, বস্তুত পরকালে তাদের জন্য কোনো অংশ নেই। আর তাদের মধ্যে যারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের দুনিয়াতে কল্যাণ দাও এবং আখিরাতে কল্যাণ দাও এবং আমাদেরকে আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করো। তারা যা অর্জন করেছে তার প্রাপ্য অংশ তাদেরই। বস্তুত আল্লাহ হিসাব গ্রহণে অত্যন্ত তৎপর। ’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২০০-২০২; আদ-দুররুল মানসুর : ১/৫৫৮)

৬. কাবা চত্বরে শিস বাজানো নিষিদ্ধকরণ: জাহেলি যুগের লোকেরা কাবা চত্বরে মাথা নেড়ে নেড়ে শিস বাজাত। এটাকে তারা নামাজের স্থলাভিষিক্ত মনে করত। ইসলাম কাবা চত্বরে শিস বাজানো ও হাতে তালি দেওয়া নিষিদ্ধ করে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘কাবাঘরের কাছে শুধু শিস ও করতালি দেওয়াই তাদের নামাজ; সুতরাং কুফরির জন্য তোমরা শাস্তি ভোগ কোরো। ’ (সুরা : আনফাল, আয়াত : ৩৫)

৭. সাফা-মারওয়ার সাঈ করা আবশ্যক: জাহেলি যুগে সবাই সাফা ও মারওয়া সাঈ করা আবশ্যক মনে করত না। যেমন মানাতের পূজারিরা এবং তিহামা অঞ্চলের একদল মানুষ সাঈ করত না। অন্যদিকে ইসলামপূর্ব যুগে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে মূর্তি থাকায় কোনো কোনো মুসলমানের অন্তরে বিষয়টি নিয়ে সংশয় তৈরি হয়। উত্তরে মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং যে ব্যক্তি কাবাঘরের হজ কিংবা ওমরাহ সম্পন্ন করে এ দুটির মধ্যে সাঈ করল তার কোনো পাপ নেই। আর কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৎকাজ করলে আল্লাহ পুরস্কারদাতা, সর্বজ্ঞ। ’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৫৮)

৮. ব্যবসার অনুমতি প্রদান: জাহেলি যুগে হজের সময় যারা ব্যবসা করতে বা শ্রমিক হিসেবে মক্কায় আসত তাদের হাজি বলে স্বীকার করা হতো না। তাদের বলা হতো ‘দাজ্জ’। এরা মিনার উপকণ্ঠে গিয়ে অবস্থান করত। ইসলাম আগমনের পর হাজিদের ব্যবসার অনুমতি প্রদান করা হয়। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহ সন্ধান করাতে তোমাদের কোনো পাপ নেই। ’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৯৮)

আল্লাহ সবাইকে তাঁর ঘরের হজ করার তাওফিক দিন। আমিন।