কাবাঘরে স্থাপিত পাথর নিয়ে মহানবী (সা.) যা বলেছেন

কাবাঘরে স্থাপিত পাথর নিয়ে মহানবী (সা.) যা বলেছেন

 শরিফ আহমাদ

হাজরে আসওয়াদ একটি মূল্যবান পাথর। এটি পবিত্র কাবার দেয়ালে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে দেড় মিটার উচ্চতায় স্থাপিত। এ পাথর তাওয়াফের সূচনা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাওয়াফের সময় হাজিদের পাথরটিতে সরাসরি কিংবা ইশারায় চুমা দিতে হয়।

মূল্যবান এই পাথর জান্নাত থেকে এসেছে। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, হাজরে আসওয়াদ জান্নাত থেকে অবতীর্ণ হয়েছিল। তখন সেটি ছিল দুধ থেকেও শুভ্র। মানুষের গুনাহ এটিকে এমন কালো করে দিয়েছে।

(তিরমিজি, হাদিস : ৮৭৭; নাসায়ি, হাদিস : ২৯৩৫)

জান্নাতি পাথর হাজরে আসওয়াদ
বাইতুল্লাহ নির্মাণের সঙ্গে হাজরে আসওয়াদের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যদিও বাইতুল্লাহর প্রথম নির্মাণ সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। একটি বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহর নির্দেশে ইবরাহিম (আ.) পুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে সঙ্গে নিয়ে বাইতুল্লাহর নির্মাণকাজ শুরু করেন। যখন রুকনে ইয়ামানির কাছে পৌঁছলেন, তখন ইবরাহিম (আ.) ইসমাঈল (আ.)-কে একটি সুন্দর পাথর আনতে নির্দেশ দেন এবং বলেন, আমি রুকনের ওপর তা স্থাপন করব, যা বিশ্ববাসীর জন্য একটি প্রতীক হয়ে থাকবে।

ইসমাঈল (আ.) একটি পাথর আনেন। কিন্তু ইবরাহিম (আ.)-এর পছন্দ হয়নি। তখন তিনি বলেন, অন্য একটি নিয়ে আসো। ইসমাঈল (আ.) পাথরের সন্ধানে গেলেন। ফিরে এসে দেখেন সেখানে পাথর স্থাপন করা হয়েছে।

জিজ্ঞাসা করেন, সম্মানিত পিতা! কে এই পাথর এনে দিল? তিনি বলেন, যিনি তোমার ওপর নির্ভর করেননি। অর্থাৎ জিবরাইল (আ.) আকাশ থেকে নিয়ে এসেছেন। অন্য এক বর্ণনায় আছে, নুহ (আ.)-এর প্লাবনের সময় আল্লাহ তাআলা কাবাকে আকাশে উঠিয়ে নেন এবং হাজরে আসওয়াদকে আবু কুবায়স পর্বতে উঠিয়ে রাখেন।

অতঃপর ইবরাহিম (আ.)-এর নির্মাণের সময় যখন তিনি ইসমাঈল (আ.)-কে সুন্দর পাথর আনতে নির্দেশ দেন, যা বিশ্ববাসীর জন্য প্রতীক হবে, তখন আবু কুবায়স পর্বত থেকে ডাক আসে যে আমার কাছে তোমার একটি আমানত আছে। সেই আমানত গ্রহণ করো। এই বলে আবু কুবায়স পর্বত হাজরে আসওয়াদকে ইবরাহিম (আ.)-এর কাছে সোপর্দ করে। অতঃপর ইবরাহিম (আ.) তা যথাস্থানে স্থাপন করেন। (কাসাসুল আম্বিয়া : ৯২৯৩; সীরাত বিশ্বকোষ : ৩৬৯)

কুরাইশদের দ্বন্দ্ব নিরসন
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বয়স যখন ৩৫ বছর ছিল, তখন কুরাইশরা বাইতুল্লাহকে নতুন করে মেরামত করার ইচ্ছা করে। বরকতময় কাজে সব গোত্র অংশ নেয়। কিন্তু হাজরে আসওয়াদ উঠিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করার ব্যাপারে গোত্রসমূহের মধ্যে চরম মতানৈক্য দেখা দিল। শেষ পর্যন্ত কওমের চিন্তাশীল ব্যক্তিরা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি মীমাংসার পন্থা বের করেন। তা হলো যে ব্যক্তি আগামীকাল ভোরে সর্বপ্রথম এ মসজিদের দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে ওই ব্যক্তি মীমাংসা দেবেন এবং তাঁর এই মীমাংসা খোদায়ি সিদ্ধান্ত মনে করে সবাই মেনে নেবে।

আল্লাহর কী অপূর্ব মহিমা! সর্বপ্রথম মহানবী (সা.) সেই দরজা দিয়ে বাইতুল্লায় প্রবেশ করেন। তাঁকে দেখেই এক বাক্যে সবাই বলে উঠল—ইনি আমাদের আল আমিন। আমরা তাঁর ফায়সালা মেনে নেব। রাসুলুল্লাহ (সা.) তখন এমন অভিজ্ঞতাপূর্ণ ফায়সালা করলেন যে সবার দিল খুশিতে টইটম্বুর হয়ে গেল। তিনি একটি চাদর নিজ হাতে বিছিয়ে তাতে হাজরে আসওয়াদ রেখে দিলেন এবং হুকুম দিলেন যে প্রত্যেক গোত্রের মনোনীত ব্যক্তিরা চাদরের একেক কোণ ধরে নিয়ে চলো, তারা তা-ই করল। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) চাদর থেকে পাথরখানা নিয়ে যথাস্থানে রেখে দিলেন। দ্বন্দ্ব নিরসন হয়ে গেল। (সীরাতে ইবনে হিশাম : ১/১০৫)

হাজরে আসওয়াদের ফজিলত
যুগে যুগে পাথর সবার কাছে প্রিয় ছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কিরাম পাথরটিতে গুরুত্বের সঙ্গে চুমু দিয়েছেন। ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত যে তিনি হাজরে আসওয়াদের কাছে এসে তা চুম্বন করে বলেন, আমি অবশ্যই জানি যে তুমি একখানা পাথর মাত্র, তুমি কারো কল্যাণ বা অকল্যাণ করতে পারো না। নবী করিম (সা.)-কে তোমায় চুম্বন করতে না দেখলে কখনো আমি তোমাকে চুম্বন করতাম না। (বুখারি, হাদিস : ১৫০২)

ঐতিহাসিক এই পাথরে চুমু দেওয়ার ফজিলত সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, এই দুটি রোকন (হাজরে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামানি) স্পর্শ করা সব গুনাহ মুছে দেয়। ’ (তিরমিজি, হাদিস : ৯৫৯)

কিয়ামতের দিন হাজরে আসওয়াদকে সাক্ষ্য প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া হবে। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ অবশ্যই কিয়ামতের দিন হাজরে আসওয়াদকে উত্থিত করবেন। তার দুটি চোখ থাকবে, যা দিয়ে সে দেখতে পাবে। একটি জিহ্বা বা মুখ থাকবে, যা দিয়ে সে কথা বলবে এবং যারা তাকে সততার সঙ্গে স্পর্শ করেছে তাদের পক্ষে সাক্ষ্য দেবে। (তিরমিজি, হাদিস : ৯৬১; ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৯৪৪)

মহান আল্লাহ আমাদের এই জান্নাতি পাথরের স্পর্শে বারবার যাওয়ার তাওফিক দান করুন।