সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার থাকা অবস্থায় সেন্ট মার্টিনে জমি কিনেন পুলিশের সাবেক আইজি ও র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। পরিবেশ অধিদপ্তর ১৯৯৯ সালে সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে সেখানে যত্রতত্র জায়গা জমি বেচাবিক্রি এবং অবৈধভাবে অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধ ঘোষণা করে। সরকারি এই আদেশ উপেক্ষা করে দ্বীপটিতে নিজের নামে এবং স্ত্রী সন্তানদের নামে জমি কেনেন বেনজীর আহমেদ।

সেন্ট মার্টিনে ১০ বছর আগে নিজের নামে ১ একর ৭৫ শতক জমি কেনেন পুলিশের সাবেক এই আইজি।

অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, সেন্ট মার্টিনের দক্ষিণপাড়া গ্রামের সব মানুষের যত জমি আছে, তার চেয়ে বেশি জমি একাই কিনেছেন সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ। দ্বীপের উত্তরপাড়ায় জমি কিনে সীমানাপ্রাচীরও দিয়েছেন তিনি।

সরেজমিনে দ্বীপের দক্ষিণ পাড়া পরিদর্শন করে দেখা গেছে, কাঁটাতার ঘেরা ওই জমিতে রাস্তার দিকের অংশে বড় একটি ফটক। জানা যায়, ফটকের পাশে কয়েক মাস আগেও জমির মালিক হিসেবে বেনজীর আহমেদের নামে সাইনবোর্ড টাঙানো ছিল। এখন সেই সাইনবোর্ড নেই জানিয়ে স্থানীয় ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নজির আহমদ বলেন, দ্বীপের মানুষ জানে জায়গাটির মালিক সাবেক আইজিপি। এ কারণে ওই জমিতে কেউ প্রবেশ করে না।

বেনজীরের জমিগুলো দেখাশোনা করেন সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ইউনিয়ন বিএনপির আহ্বায়ক আবদুর রহমান। তিনি সেখানকার আবাসিক হোটেল সেন্ডশোর–এর মালিক। ২০১৪ সালে স্থানীয় ২২ জনের কাছ থেকে বেনজীর ১ একর ৭৫ শতক জমি কেনার কথা স্বীকার করে আবদুর রহমান বলেন, দ্বীপের দক্ষিণ পাশের বিশাল এই জায়গা পরিত্যক্ত ছিল, মাটির নিচে পাথর থাকায় চাষাবাদ হয় না। তখন প্রতি কানি (১ কানিতে ৪০ শতক) জমি বিক্রি হয়েছিল ৬-৭ লাখ টাকা দামে। দলিল রেজিস্ট্রির সময় বেনজীর আহমেদ টেকনাফ আসেননি জানিয়ে আবদুর রহমান বলেন, সেন্ট মার্টিনে বেনজীরকে তিনি ১৮৫ শতাংশ জমি কিনে দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ১৭৫ শতাংশের (পৌনে দুই একর) নাম খতিয়ান হয়েছে।

বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগ ওঠে। এরপর তাঁর জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অনুসন্ধান করছে দুদক। সংস্থাটি এখন পর্যন্ত বেনজীর ও তাঁর পরিবারের নামে গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে ৬২১ বিঘা জমি, ১৯টি কোম্পানির শেয়ার, গুলশানে ৪টি ফ্ল্যাট, ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, ৩৩টি ব্যাংক হিসাব এবং তিনটি বিও হিসাব (শেয়ার ব্যবসার বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট) খুঁজে পেয়েছে। আদালতের আদেশে এসব সম্পদ জব্দ ও অবরুদ্ধ করা হয়েছে।

২০১১ সালে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করা মৌলভী আব্দুর রহমান এলাকায় বেনজীরের খাস লোক হিসেবে পরিচিত। তিনিই ওই এলাকায় বেনজীরের জমিজমা দেখভালের দায়িত্ব পালন করেন।

টেকনাফ সাবরেজিস্ট্রি কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের ২৯ মে সেন্ট মার্টিনের কোনারপাড়ার (বর্তমান বাজারপাড়া) বাসিন্দা আবদুর রহমানসহ কয়েকজনের কাছ থেকে জিনজিরা মৌজার ২২ শতাংশ জমি কেনেন বেনজীর। জমির দলিলমূল্য দেখানো হয় ১৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা। একই দিন জোসনা বেগম গংয়ের কাছ থেকে ১২ লাখ ৬৫ হাজার টাকায় কেনা হয় ৪৪ শতাংশ জমি, মোহাম্মদ হোছন গংয়ের কাছ থেকে ১০ লাখ ৭ হাজার টাকায় কেনা হয় ৩৫ শতাংশ, মোহাম্মদ ইসলাম গংয়ের কাছ থেকে ১৩ লাখ টাকা দামে ৪৫ শতাংশ, আবদুল জলিল গংয়ের কাছ থেকে ৮ লাখ ৩৫ হাজার টাকায় কেনা হয় আরও ২৯ শতক জমি।

টেকনাফ ভূমি অফিসের সাবেক সহকারী তহশিলদার আবদুল জব্বার জানান, সেন্ট মার্টিনের দক্ষিণপাড়া এলাকায় বেনজীর আহমেদ সাহেবের জমি আছে। এসব জমি তিনি কিনেছেন ২০১৬ ও ২০১৭ সালে। এর পরেও উনি নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামেও কিনেছেন বেশকিছু জমি।

ইনানীতে স্ত্রী ও কন্যাদের নামে ৭২ শতাংশ জমি:

কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভের ইনানী সৈকতে বেনজীরের স্ত্রী ও তাঁর তিন মেয়ের নামে ৭২ শতাংশ জমি রয়েছে। ওই জমি উখিয়ার মেরিন ড্রাইভের পাশে এলজিইডি ভবনসংলগ্ন। জমি কেনার ক্ষেত্রে সহায়তা করেন স্থানীয় জালিয়া পালং ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য শামসুল আলম। তিনি বলেন, জমিগুলো এখনো পড়ে আছে।

২০০৯ সালে স্ত্রী জীসান মীর্জার নামে ৪০ শতক জমি কেনেন বেনজীর। জমির দলিলমূল্য উল্লেখ করা হয় ৫ লাখ টাকা। জীসান মীর্জার নামে পরে আরও ১০ ও ৭ শতাংশ জমি কেনেন, যার দলিলমূল্য যথাক্রমে ১৬ লাখ ৬৬ হাজার টাকা ও ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা।

এছাড়া বেনজীরের তিন মেয়ে ফারহীন রিশতা বিনতে বেনজীর, তাহসিন রাইশা বিনতে বেনজীর ও জারা জেরিন বিনতে বেনজীরের নামে কেনা হয় ১৫ শতাংশ জমি। যার দলিলমূল্য দেখানো হয় ২৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা।

নিয়মের তোয়াক্কা না করে জমি ক্রয়: 

পরিবেশ অধিদপ্তর ১৯৯৯ সালে সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে সেখানে যত্রতত্র জায়গা জমি বেচাবিক্রি এবং অবৈধভাবে অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধ ঘোষণা করে। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ৪ জানুয়ারি বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন অনুযায়ী সেন্ট মার্টিন দ্বীপসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের ১ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে পরিবেশ মন্ত্রণালয়।

এ বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সৈয়দ সাফফাত আলী বলেন, ২০১২ সালের ২০ মে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে কক্সবাজার জেলার মহাপরিকল্পনা নিয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এর পর থেকে সেন্ট মার্টিনসহ টেকনাফ উপজেলার আটটি মৌজার জমি বেচাকেনা করতে জেলা প্রশাসনের অনুমতি লাগে। বেনজীর আহমেদের জমি কেনার আগে অনুমতি নেওয়া হয়েছিল কি না, তা তাঁর জানা নেই।

news24bd.tv/DHL