শেষ মালয়েশিয়া যাওয়ার স্বপ্ন, বিমানবন্দরে হতাশা

টিকিট না পেয়ে বিমানবন্দরে অবস্থান করছেন মালয়েশিয়াগামী শ্রমিকরা।

শেষ মালয়েশিয়া যাওয়ার স্বপ্ন, বিমানবন্দরে হতাশা

অনলাইন ডেস্ক

বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হাজির হয়েছিলেন কয়েকশ মানুষ, যাদের বেশিরভাই ফ্লাইট ধরতে পারছেন না।

বিদেশে কর্মসংস্থানে ইচ্ছুক বাংলাদেশি কর্মীদের অন্যতম পছন্দের জায়গা মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার গতকাল শুক্রবার বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে একটি সিন্ডিকেট বা চক্রের নির্মম দুর্নীতির চিত্র। তাদের মাধ্যমে দেশে ও বিদেশে প্রতারিত হয়েছেন হাজারো কর্মী, যার চিত্র গতকাল হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দেখা গেছে।

গতকাল রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত অনুমোদন পাওয়া প্রায় সাড়ে তিন হাজার কর্মীকে অনিশ্চয়তার মধ্যে অপেক্ষা করতে দেখা যায়।

গতকাল মালয়েশিয়া যেতে শেষবারের চেষ্টায় ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সমবেত হন বঞ্চিত কর্মীরা। এসব কর্মীর মধ্যে বেশির ভাগই জমি বা শেষ সম্বলটুকু বেচে ও চড়া সুদে মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার টাকা জোগাড় করেন। নির্দিষ্ট সময় শেষে নিদারুণ স্বপ্নভঙ্গের মাধ্যমে তাঁদের সে আশা শূন্যে মিলিয়ে গেছে।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সূত্র বলছে, গতকাল বাংলাদেশ থেকে ১২টি ফ্লাইট মালয়েশিয়ার উদ্দেশে ছেড়ে গেছে। এসব ফ্লাইটে দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার কর্মী মালয়েশিয়া গেছেন।

গতকাল সকাল থেকে বিমানবন্দরে প্রায় পাঁচ হাজার কর্মী অবস্থান করেন। কর্মীদের দাবি, এজেন্সিগুলো টিকিটের ব্যবস্থা করে দেবে বলে তাঁদের আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু সে টিকিট কখন দেবে, ওই নিশ্চয়তা দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকেন কর্মীরা।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মালয়েশিয়ার সরকারের সঙ্গে অনুষ্ঠিত আজকের (গতকাল) অনলাইন বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে বাংলাদেশ থেকে আজ রাত পর্যন্ত যত কর্মী যাবেন, সবাইকে মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করতে দেওয়া হবে।

বিমানবন্দরে অবস্থানরত কর্মীদের হাহাকার:

কর্মীদের মধ্যে অনেকে তিন-চার দিন ধরে শাহজালাল বিমানবন্দরে অবস্থান করছিলেন। এই কয়েকটি দিন আশা-নিরাশার দোলাচলে সময় কেটেছে তাঁদের।

রিক্রুটিং এজেন্সি গ্রিনল্যান্ড ওভারসিজের মাধ্যমে ২৪ জন কর্মীর মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা। কিন্তু তিন দিন ধরে বিমানবন্দরে অবস্থান করেও তাঁরা টিকিটের দেখা পাননি।

গতকাল নওগাঁর বাসিন্দা মো. সাইফুল্লাহ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘মালয়েশিয়া যেতে না পারলে আর বাড়ি ফেরা হবে না। জমি বন্ধক রেখে, সুদে ও কিস্তিতে ঋণ করে ছয় লাখ টাকা জোগাড় করেছি। যদি মালয়েশিয়া না-ই যেতে পারি, না-ই কাজ করতে পারি, এই টাকা আমি দেব কোথা থেকে?’

জামালপুরের বাসিন্দা মো. রুবেল বলেন, ‘আজকে যেতে না পারলে তো পুরো নিঃস্ব হয়ে যাব। তারা টাকা ফেরত দেবে কি না, সঠিক জানি না। জমি বেচে, সুদে ও কিস্তিতে ঋণ করে ছয় লাখ টাকা জোগাড় করেছি। এখন যেতে না পারলে বাড়ি কিভাবে ফিরব জানি না। ’

একই জেলার বাসিন্দা সালমা বেগম বলেন, ‘তিন দিন ধরে শুধু বিমানবন্দরে ঘুরতে আছি। গত পরশু বাড়ি থেকে নিয়া আসছে। বলে—তোমরা তাড়াতাড়ি আসো, তোমাদের টিকিট দেব। এখন টিকিটও পাই না, কিছু বলেও না। নদীর মাঝে ডুবে মানুষ যেমন হাবুডুবু খায়, আমাদের ওই রকম অবস্থা। ’

শুধু সাইফুল্লাহ, রুবেল বা সালমা বেগম নন, বিমানবন্দরজুড়ে এমন হাজারো কর্মীর মধ্যে এই হতাশা। পটুয়াখালী থেকে এসেছেন মো. শফিক শিকদারসহ পাঁচজন। কিন্তু টিকিটের সুরাহা হয়নি।

শফিক শিকদার সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘এখন আমাদের বলছে যে আপনারা যদি টিকিট কাটতে পারেন, তাহলে কেটে চলে যান। এখন ব্যাপারটা যদি আমাদের ওপর ছেড়ে দেয়, তাহলে আমরা এদের কাছে কেন গেলাম? কেন তাহলে তখন বলল যে তারা সব কিছু করে দেবে। এখন আমাদের মাথার ওপর ভার চাপিয়ে তারা পালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের কোনো ফ্লাইট পাওয়ার সুযোগ নেই। এখন শুধু অন্ধকার দেখছি। অনেক কষ্টে সুদের ওপর ঋণ করে টাকা নিয়ে আসছি। এই কিস্তির টাকা প্রতি সপ্তাহে দিতে হবে। এটা ঠিকমতো দিতে না পারলে আমার নামে মামলা করে দেবে তারা। ’

খুলনার বাসিন্দা শিহাব মোল্লা বলেন, ‘দালাল শুধু বলতাছে টিকিট আছে, দিচ্ছি, বিমানবন্দরে আসেন। এ রকম তিন দিন ধরে ঘোরাচ্ছে। প্রতিদিনই শুধু আসি আর যাই। এখন টাকা তো তাদের হাতে। আমরা তাদের কাছে জিম্মি। তারা যা করছে, আমাদের তা-ই মানতে হচ্ছে। এখন বলতাছে, আজকে হবে। কিন্তু কখন হবে, তা বলতাছে না। ’

এ বিষয় বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) যুগ্ম সম্পাদক টিপু সুলতান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘৩১ তারিখে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, এটা সবাই আগে থেকে জানত। আমরা সরকারকে বলেছিলাম, কূটনৈতিকভাবে আলাপ-আলোচনা করে যদি অধিকসংখ্যক চার্টার্ড ফ্লাইট করা যেত, তবে এ সমস্যা অনেক আগেই দূর করা যেত। আমরা মনে করি, সরকারের উদ্যোগের অভাব ছিল। এখনো সরকারই পারে যাঁরা ভিসা পেয়েছেন,  কূটনৈতিকভাবে তাঁদের যাওয়ার ব্যবস্থা করতে। ’

এ ব্যাপারে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘কত মানুষ যাবে, কিভাবে যাবে, সেই তালিকা চেয়েছিলাম বায়রার কাছে। কিন্তু তারা কোনো তালিকা দিতে পারেনি। এর ফলে আমাদের সমস্যায় পড়তে হয়েছে। তবে এখন যাঁদের টিকিট কনফার্ম হয়েছে, তাঁদের পাঠানো হচ্ছে। অন্যদের বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ’

বাংলাদেশ থেকে কর্মী ভিসায় মালয়েশিয়া যাওয়ার শেষ সময় শুক্রবার রাত পর্যন্ত। এক মাস আগে থেকে এ তারিখ নির্ধারণ করা ছিল। বেঁধে দেওয়া শেষ তারিখের সুযোগ নিয়ে একটি চক্র টিকেটের দাম বাড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন কায়দায় বেশি টাকা আদায়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে খবরও প্রকাশিত হয়েছে।

বিমানবন্দরে অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এজেন্সিগুলো মালয়েশিয়া রুটে বিমান ভাড়া কয়েকগুণ বেশি নিয়েছ। ৩০ হাজার টাকার টিকেটের দাম ১ লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। তারপরও টিকেট মেলেনি।

বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, গত ২১ মে পর্যন্ত প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ৫ লাখ ২৩ হাজার ৮৩৪ জন কর্মীকে মালয়েশিয়া যাওয়ার অনুমোদন দেয়। ২১ মের পর আর অনুমোদন দেওয়ার কথা না থাকলেও মন্ত্রণালয় আরও ১ হাজার ১১২ জনকে তা দিয়েছে।

অর্থাৎ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৫ লাখ ২৪ হাজার ৯৪৬ জন বাংলাদেশি মালয়েশিয়া যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মালয়েশিয়া চলে গেছেন ৪ লাখ ৯১ হাজার ৭৪৫ জন।

বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার বাংলাদেশ থেকে মাত্র ১ হাজার ৫০০ জন মালয়েশিয়ায় যেতে পারবেন। তাই যদি হয়, তাহলে অনুমোদন পেয়েও ৩১ হাজার ৭০১ জনের মালায়েশিয়া যাওয়া হচ্ছে না।

news24bd.tv/DHL