ময়মনসিংহের তারাকান্দায় বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুল

ময়মনসিংহের তারাকান্দায় বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুলের শিক্ষার্থীরা

ময়মনসিংহের তারাকান্দায় বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুল

অনলাইন ডেস্ক

‘ভোর হলো দোর খোলো খুকুমণি উঠরে, ঐ ডাকে জুঁই শাখে ফুল খুকি ছোটরে’ ছোট্ট সোনামণিদের সুমধুর স্বরে কবিতার এমন কথাগুলো শোনা গেল দূর থেকেই। কাছে গিয়ে দেখা যায় ছোট শিশুরা বসেছে সারি বেঁধে। শিক্ষক বই হাতে নিয়ে কবিতা বলছেন, আর তাঁর সঙ্গে সুর মিলিয়ে শিশুরাও বলে যাচ্ছে। অনেক উৎসাহী অভিভাবক স্কুলের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন।

নয়ন-জুড়ানো এমন দৃশ্যটি ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার গালাগাঁও ইউনিয়নের চড়ারকান্দা গ্রামের বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুলের। স্থানীয় বসুন্ধরা শুভসংঘের বন্ধুরা স্কুলটি শুরু করেছেন। এখনই ৬০ জন শিক্ষার্থী এই স্কুলে পড়ছে। গ্রামটি তারাকান্দা উপজেলা সদর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে।

কিছুটা পাকা সড়ক আর কিছুটা মাটির রাস্তা ধরে গ্রামে পৌঁছতে হয়। এই গ্রামে কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। আশপাশের স্কুলগুলো দু-তিন কিলোমিটার দূরে। অনেক শিশুকে তাদের মা-বাবা দূরের স্কুলে পাঠাতে চান না।

আবার সেসব স্কুলে আসা-যাওয়ার ব্যবস্থাও ভালো নয়। গ্রামের অনেক শিশুই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। যারা দূরের স্কুলগুলোতে ভর্তি হয়েছে, তারাও নিয়মিত সেসব স্কুলে আসা-যাওয়া করতে পারে না।

এলাকারই ছেলে আবু সায়েম। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে যুক্ত ছিলেন শুভসংঘের কাজে।

এখন তিনি পড়াশোনা শেষ করে এলাকায় চলে এসেছেন। এখানে এসে উপজেলা বসুন্ধরা শুভসংঘের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তাঁর স্ত্রী শান্তা ইসলাম নূপুর স্থানীয় একটি কেজি স্কুলে পাঠদান করেন। তিনিও শুভসংঘের সদস্য। আবু সায়েম এ গ্রামেই শুভসংঘের একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন।  

তিনি পরামর্শ করলেন তারাকান্দা শুভসংঘের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মুবিনসহ অন্য বন্ধুদের সঙ্গে। স্কুল প্রতিষ্ঠায় আবু সায়েম কথা বললেন শুভসংঘের পরিচালক জাকারিয়া জামানের সঙ্গে। জাকারিয়া জামান শুভসংঘের প্রধান ও কালের কণ্ঠ’র প্রধান সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলনের সঙ্গে কথা বলে সায়েমকে আশ্বস্ত করলেন এবং স্কুল চালু করতে বললেন। এভাবেই শুরু হয়ে যায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুল।

আবু সায়েম, সৈয়দ মুবিনসহ অন্যরা গ্রামের বাড়ি বাড়ি গেলেন। তালিকা তৈরি করলেন স্কুলে না যাওয়া শিশুদের। এ ছাড়া দূরের স্কুলে যাওয়া অনিয়মিত শিক্ষার্থীদের তালিকাও তাঁরা সংগ্রহ করলেন। সব মিলিয়ে প্রায় এক মাস আগে তাঁরা স্কুলের যাত্রা শুরু করলেন। ভাড়া নেওয়া হলো স্থানীয় ইউনুছ আলীর বাড়ি। শুরু হলো পাঠদান। পাঠদানের কাজটি হাতে নিলেন আবু সায়েমের স্ত্রী নূপুর। কিছু পুরনো বইপত্র জোগাড় হলো। আবার কিছু বই কিনে আনলেন শুভসংঘের বন্ধুরা। স্কুল শুরুর পরই তাঁরা ব্যাপক সাড়া পেলেন। শিশুরা স্কুলের সময়ের আগেই চলে আসে। অনেক সময় শিশুদের মা-বাবারাও সঙ্গে আসেন। শিশুদের কচি কণ্ঠের পড়াশোনায় এক অন্য রকম আবহ তৈরি হয় ইউনুছ আলীর বাড়িতে। প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত পাঠদান চলে।

স্থানীয় অভিভাবক পারভীন আক্তার জানান, তিন মেয়ের মধ্যে দুজনকে বিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়েটির বয়স ছয় বছর। তার নাম রাত্রি। তাকে তিনি স্কুলে দেননি। কারণ স্কুল বেশ দূরে। এই স্কুল চালু হওয়ার পর রাত্রিকে তিনি এখানে দিয়েছেন। তিনি বলেন, রাত্রি বেশ উৎসাহী। স্কুলের সময় হলেই সে মাকে তাড়া দেয় স্কুলে নিয়ে আসার জন্য। এখানে পড়াশোনার জন্য কোনো টাকা-পয়সা দিতে হয় না। কমলা খাতুন নামের আরেক অভিভাবক বলেন, ‘আমার ছেলের ঘরের নাতি তাওয়াদ। বয়স চার বছর। তাকে এখানে নিয়ে এসেছি। নাতিডা এহন নিয়মিত পড়ে। ’

আনোয়ার হোসেন নামের এক শিশুর বাবা জানান, তাঁর ছেলে পাশের মুলাবাড়ী প্রাথমিক স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। এর পরও তিনি ছেলেকে এই স্কুলে নিয়ে এসেছেন। এখানকার পড়াশোনা ছেলে খুব পছন্দ করে।

ঘরটির মালিক ইউনুছ আলী বলেন, ছোট ছোট ছেলেমেয়ে বিকেল থেকেই এখানে আসে। এই দৃশ্য দেখে খুব ভালো লাগে। বসুন্ধরা গ্রুপ খুব ভালো কাজ করেছে। নয়তো এই শিশুরা স্কুলে যেত না। অঙ্কুরেই বিনষ্ট হতো ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা।