তরুণরা বাংলাদেশকে শিল্প বিপ্লবের নেতৃত্বে নিয়ে যেতে পারবে

তরুণরা বাংলাদেশকে শিল্প বিপ্লবের নেতৃত্বে নিয়ে যেতে পারবে

আলী হাবিব

একটি পরিবর্তন হয়ে গেছে দেশে। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিয়েছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে।

নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নতুন সরকারের প্রধান করা হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে পাহাড়সমান সমস্যা। শুরুতেই এই সরকারকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। বাংলাদেশের এই সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে বেকার সমস্যা।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত মাসের মাঝামাঝি থেকে সংঘাত শুরু হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গত ১৯ জুলাই রাত থেকে কারফিউ জারি করে সরকার। সে সময় সাধারণ ছুটি ঘোষণা ও ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংক ও বন্দরের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে কক্সবাজারে ব্যাবসায়িক ক্ষতি হয়েছে অন্তত ৭০০ কোটি টাকা।

মোবাইল ব্যাংকিংয়ে ভাটা পড়েছে দুই মাস ধরে। সহজ ও দ্রুততম আর্থিক লেনদেন সুবিধার কারণে প্রতি মাসে লেনদেন ও গ্রাহকসংখ্যা বাড়ছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে লেনদেন কমতির দিকে, যা উন্নয়নমুখী সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। কোটাবিরোধী আন্দোলন ঘিরে দেশজুড়ে সৃষ্টি হওয়া অস্থিরতায় ক্ষুদ্র ব্যবসার উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বিশেষ করে অনলাইনভিত্তিক ব্যবসায়ীরা দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন।

কারফিউয়ের কারণে চলাচল সীমিত হয়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের কাছে পণ্য পৌঁছাতে পারেননি। চলতি মৌসুমে একের পর এক ধাক্কায় বিপর্যস্ত সিলেটের পর্যটন খাত। তিন দফায় বন্যার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ও কারফিউয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে এ খাত। এতে চলতি মৌসুমে পর্যটন খাতের ক্ষতি হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

দেশের অর্থনীতি এখন উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে আছে। প্রায় সব পণ্য ও সেবার মূল্য বাড়ছে। বিগত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতি ক্রমাগত বাড়ছে। সরকারি সংস্থা পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী বেশ কয়েক মাস ধরে প্রতি মাসেই মুদ্রাস্ফীতি ১০ শতাংশ ছুঁই ছুঁই করছে। খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি ১০ শতাংশেরও অধিক। অর্থনীতিবিদদের অনেকেই বলছেন, বাজেটে নেওয়া কিছু উদ্যোগ মূল্যস্ফীতিকে আরো উসকে দিতে পারে। কারণ মূল্যস্তর অনেক বেশি বেড়ে গেছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষকে স্বস্তি দিতে বাজেটে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা-ও যথেষ্ট নয়।

তরুণরা বাংলাদেশকে শিল্প বিপ্লবের নেতৃত্বে নিয়ে যেতে পারবেআরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ কর্মসংস্থান। বিবিএসের তথ্য মতে, দেশে মোট বেকারের ১২ শতাংশই উচ্চশিক্ষিত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপে বলা হয়েছে, দেশে কর্মক্ষম বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ ৮০ হাজার। লন্ডনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) তথ্য মতে, বাংলাদেশে ১০০ জন স্নাতকধারীর ৪৭ জনই বেকার। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা বলছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করা ৬৬ শতাংশই বেকার থাকছে। ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি পান। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য বলছে, গত বছরের শেষ তিন মাসের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে বেকার বেড়েছে প্রায় আড়াই লাখ। প্রাথমিকভাবে পাঁচ লাখ তরুণের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা গেলে সেটি অর্থনীতিতে বড় গতি আনতে সহায়তা করবে। ইউএনডিপি তাদের এক প্রতিবেদনে জানাচ্ছে, বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অতিক্রম করছে।

দেশে মোট বেকারের ১২ শতাংশই উচ্চশিক্ষিত। লন্ডনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) তথ্য মতে, বাংলাদেশে ১০০ জন স্নাতকধারীর ৪৭ জনই বেকার। আইএলওর ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা তিন কোটি। তখন সংস্থাটি আভাস দেয়, কয়েক বছরে তা দ্বিগুণ হয়ে ছয় কোটিতে দাঁড়াবে, যা মোট জনসংখ্যার ৩৯.৪০ শতাংশ হবে। ইউএনডিপি তাদের এক প্রতিবেদনে জানাচ্ছে, বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অতিক্রম করছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হবে। জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এখন তরুণ জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্র। এ দেশের কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ৫৬ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ৬৬ শতাংশ। ২০৩০ সালে দেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা আরো বেড়ে দাঁড়াবে ১২ কোটি ৯৮ লাখে। আর ২০৫০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা ১৩ কোটি ৬০ লাখে উন্নীত হবে। আজকের তরুণদের জন্য যথাযথ ও পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান নেই। এটা ঠিক যে দেশের অনেক তরুণ এখন অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে নিয়োজিত। তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজে লাগাতে হবে। তাঁদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাটাই এখন জরুরি। উচ্চশিক্ষিত তরুণদের উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে দিলে দেশ এগিয়ে যাবে।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে অনেক দিন ধরেই ঋণের নামে রীতিমতো লুটপাট চলে আসছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। কালের কণ্ঠে গতকাল প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে এক বছরে সাড়ে ৬২ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিল করেছে ব্যাংক। হিসাব অনুযায়ী ঋণ পুনঃ তফসিলের দিক থেকে যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিলের পরিমাণ অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পেছনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে দায়ী করা হচ্ছে। কারণ নির্বাচনে প্রার্থী হতে সে সময় অনেক প্রার্থীই খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত হন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের তিন মাসে প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিল করা হয়, যা আগের তিন মাসের চেয়ে প্রায় সাড়ে ৯ গুণ বেশি। এক ত্রৈমাসিকের হিসাবেও এটি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এই ঋণের প্রায় ৯২ শতাংশই পুনঃ তফসিল করে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো।

আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ। আমাদের দেশের খেলাপি ঋণ দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত এক সমস্যা। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে ঋণগ্রহীতার কারণে যেমন কোনো একটি ঋণ খেলাপি হয়, তেমনি ব্যাংকের ঋণ ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণেও কোনো কোনো ঋণ খেলাপি হতে পারে। খেলাপি ঋণসংক্রান্ত অনিয়মগুলো বন্ধ করে দেশের খেলাপি ঋণের পরিমাণ সন্তোষজনকভাবে কমিয়ে আনতে হলে দেশের ব্যাংকিং খাতে ঋণ প্রদান এবং ঋণ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে।

দেশের আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা রক্ষার তাগিদেই অবিলম্বে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির এই প্রবণতা রোধ করতে হবে। বর্তমানে একটি ভিন্ন চিত্র লক্ষ করা যাচ্ছে। কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যেন পরিকল্পিতভাবেই ঋণখেলাপি হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের টাকা পুরোটাই লোপাট করে দিতে চাইছে। ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা এবং ব্যাংকগুলোর কিছু কর্মকর্তার অনৈতিক যোগসাজশের কারণে ঋণের নিরাপত্তা চিন্তা না করেই ঋণ দেওয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক ও অন্যান্য প্রভাবও এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে। খেলাপি ঋণের সঙ্গে অর্থপাচারের যোগ রয়েছে।

গত কয়েক দিনের কর্মসূচিতে সারা দেশ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় একদিকে যেমন জনজীবনে ভোগান্তি হয়েছে, অন্যদিকে স্থবির হয়ে পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য। বাংলাদেশ টেলিভিশন, সেতু ভবন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) প্রধান কার্যালয়, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা, মিরপুরের পদচারী সেতু এবং বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ বক্সে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সেতু ভবন ও পুলিশ বক্সে লুটপাটও চালানো হয়েছে।  

দেশের এই বিপুল আর্থিক ক্ষতি পূরণ করতে হবে। কী করে হবে সেই ক্ষতিপূরণ? আমাদের তরুণরা সামান্য সহযোগিতা পেলে বাংলাদেশকে শিল্প বিপ্লবের নেতৃত্বের জায়গায় নিয়ে যেতে পারবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই সুযোগ কি কাজে লাগাতে পারবে বাংলাদেশ?

লেখক : সাংবাদিক

habib.alihabib@gmail.com