যেভাবে রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্ক সুন্দর হয়

যেভাবে রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্ক সুন্দর হয়

মো. আবদুল মজিদ মোল্লা

রাষ্ট্র একটি স্বাভাবিক মানবীয় সংগঠন। কেননা মানবজাতির পক্ষে জীবনোপকরণ সংগ্রহে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সমাজবদ্ধ জীবন যাপন করা ছাড়া আত্মরক্ষা করা সম্ভব নয়, পৃথিবীতে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনও সম্ভব নয়। সমাজবদ্ধ জীবনে মানুষ পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীল। তারা নির্ভরশীল উত্তম আচরণ ও প্রয়োজন পূরণের ক্ষেত্রে।

এই নির্ভরতা কাটাতে মানুষ আবার অন্যের জীবন ও সম্পদের ওপর হস্তক্ষেপ করে। কেননা প্রাণীর প্রকৃতিই হলো অন্যের ওপর অত্যাচার ও উৎপীড়ন। আত্মরক্ষাও মানবপ্রবৃত্তির একটি দিক। ফলে মানুষ স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের কারণে অন্যের ওপর হামলা ও অন্যের হামলা থেকে নিজেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে।

এভাবেই সমাজবদ্ধ মানবসমাজে বিশৃঙ্খল ও যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। মানুষের প্রয়োজন পূরণ এবং আত্মকলহ থেকে রক্ষার জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা অপরিহার্য। একজন রাষ্ট্রনায়ক, যার বিধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। রাষ্ট্র গঠন ও তা রক্ষায় নাগরিকের প্রতি ভালোবাসা অপরিহার্য।

কেননা নাগরিকের প্রতি ভালোবাসা ছাড়া যেমন মানুষের অধিকার আদায় করা সম্ভব নয়, তেমন কোনো রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষা করাও সম্ভব নয়। নাগরিকের প্রতি ভালোবাসাও ভারসাম্যপূর্ণ হওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে যদি শাসক ইনসাফ ও সমতা রক্ষা করতে না পারে; বরং স্বজাতীয়দের সর্বক্ষেত্রে প্রাধান্য দেয়, তবে রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা অবশ্যক হয়ে ওঠে। মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতর সাধারণ নাগরিক বা কোনো নাগরিকগোষ্ঠী নিজেদের বিপন্ন মনে করতে থাকলে রাষ্ট্রের প্রতি তাদের আনুগত্যের শপথ শিথিল হতে থাকে। তারা শাসকগোষ্ঠীর ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে।

সুতরাং রাষ্ট্র ও তার বিধায়কদের দায়িত্ব ইনসাফ ও সমতা নিশ্চিত করা। শাসকের ব্যক্তি পরিচয়, যোগ্যতা ও গুণাবলি নাগরিক ও রাষ্ট্রের কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ট নয়। বস্তুত শাসকের দৈহিক সৌন্দর্য, মুখচ্ছবির লাবণ্য, বিরাট আকৃতি, ব্যাপক কর্মক্ষমতা, সুন্দর হস্তাক্ষর বা অসাধারণ মেধা কোনোটাই তাদের মোহিত করে না। তাদের মূল প্রত্যাশা, শাসক তাদেরই একজন হবেন। রাজশক্তি ও শাসনক্ষমতা এই প্রত্যাশার ওপর নির্ভরশীল। আদর্শ শাসন ক্ষমতার অর্থ হলো শাসক নাগরিকদের শাসক হবেন, তাদের সর্বাধিক কাজের নিয়ামক হবেন।

নাগরিক সামগ্রিক অর্থে শাসকের ওপর নির্ভর করতে পারলেই তাকে আদর্শ শাসক বলা যায়। শাসক তিনিই, যার প্রজা আছে এবং প্রজা তারাই, যাদের শাসক আছেন। বস্তুত প্রজাদের আপনজন হওয়ার এই গুণকেই রাজকীয় ক্ষমতা বলে। এর দ্বারা শাসক গণমানুষের শাসক হয়ে ওঠেন। এই ক্ষমতা ও তার আনুষঙ্গিক গুণাবলি যদি যথাযথভাবে পাওয়া যায়, তবে রাষ্ট্রশক্তিও সুদৃঢ় ও স্থায়ী হয়, রাষ্ট্রশক্তি সর্বতোভাবে সার্থকতা লাভ করে। শাসক ও প্রজার মধ্যকার এই সম্পর্ক যত সুন্দর ও সৎ হবে, প্রজাসাধারণের ততই কল্যাণ। আর এটা অসৎ ও সংকীর্ণ হলে প্রজাদের সমূহ অকল্যাণ ও বিপদ আসন্ন হয়ে ওঠে।

রাষ্ট্রশক্তির সৌন্দর্য হলো সহানুভূতি। শাসক যদি কঠোরতা ও প্রতাপের অধিকারী হন, মানুষকে শাস্তি দিতে, তাদের গোপনীয়তা নষ্ট করতে এবং তাদের পাপাচার খুঁজতে তৎপর হন, তাহলে তারা ভীত ও অপমানিত বোধ করতে থাকে। তখন তারা শাসকের হাত থেকে রক্ষা পেতে মিথ্যা, কূটকৌশল ও প্রতারণার আশ্রয় নেয়। ধীরে ধীরে তাতেই অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। এভাবে নাগরিকের বিবেক-বুদ্ধি ও চরিত্র নষ্ট হয়।

বহু সময় রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যুদ্ধ ও প্রতিরোধের প্রয়োজন দেখা দিলে তারা শৈথিল্য প্রদর্শন করে। ফলে জাতীয় দুর্যোগের সময় ইচ্ছাশক্তির অভাবে সহায়তার কাজ বিঘ্নিত হয়। রাষ্ট্রের কঠোরতা চরম পর্যায়ে পৌঁছালে জনগণ সংঘবদ্ধ হয়ে শাসককে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। এতে রাষ্ট্র দুর্বল হয়, ধ্বংসের মুখোমুখি হয় এবং পতনের মুখে পড়ে। যদি শাসকের রূঢ়তা ও কঠোরতা স্থায়ী হয় তাহলে সামাজিক সম্প্রীতি সমূলে বিনষ্ট হয়। প্রজাদের সহায়তার অভাবে রাষ্ট্র ও তার নিরাপত্তা ক্রমেই দুর্বল হয়। অন্যদিকে যদি শাসক তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হন, তাহলে তারা তাকে বিশ্বাস করে, তার শাসনাধীন থাকতে নিরাপদ বোধ করে, তাকে গভীরভাবে ভালোবাসে এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণপণে অংশগ্রহণ করে। এভাবেই রাষ্ট্র একটি দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়।

শাসকের একটি প্রশংসনীয় গুণ হলো, নাগরিকদের কল্যাণ কামনা ও তাদের রক্ষণাবেক্ষণ। নাগরিকের রক্ষণাবেক্ষণের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রশক্তি যথার্থ পূর্ণতা লাভ করে। নাগরিকের কল্যাণ কামনার অর্থ তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া এবং তাদের জীবন প্রবাহের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া। এটা প্রজাদের ভালোবাসা বৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ।

শাসক বেশি ধূর্ত হলে সে হৃদয়হীন হয়। অনেক সময় শাসক এমন বিধি-নিষেধ প্রবর্তন করে, যা তাদের নাগরিকরা বুঝতে পারে না। এটা তাদের জন্য বোঝা হয়ে ওঠে, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা দুর্বল, তাদের অনুপাতে পদচারণা কোরো। ’ এই নীতি সামনে রেখে ইসলামী আইনজ্ঞরা শাসকদের অতিরিক্ত ধূর্ত হতে নিষেধ করেছেন।

জিয়াদ ইবনে আবি সুফিয়ানের ঘটনা এর উপমা হতে পারে। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) তাঁকে ইরাকের প্রশাসক পদ থেকে বরখাস্ত করেন। তিনি এর কারণ জানতে চাইলে ওমর (রা.) বলেন, ‘আমি তোমাকে দুর্বলতা ও অসততার জন্য পদচ্যুত করিনি; বরং আমি সাধারণ মানুষের ওপর তোমার বুদ্ধির দৌরাত্ম্য আমার ভালো লাগেনি। ’

এর থেকে বোঝা যায়, শাসকরা অতিরিক্ত ধূর্ত ও বুদ্ধিমান হওয়া ঠিক নয়। কেননা এতে তার চরিত্রে উৎপীড়ন ও অন্যায্যতার জন্ম হয়। তার ভেতর এমন অনেক স্বভাব জন্ম নেয়, যা স্বাভাবিক নয়। প্রকৃতপক্ষে ধূর্ততা ও নির্বুদ্ধিতা উভয়টি নিন্দনীয়; বরং মধ্যপন্থাই সুন্দর। যেমন দানের ক্ষেত্রে কার্পণ্য ও অপব্যয় উভয়টি নিন্দনীয়। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ।

আল্লামা ইবনে খালদুনের মুকাদ্দিমা অবলম্বনে

সম্পর্কিত খবর