সুদের ধর্মীয় ও সামাজিক কুফল

সুদের ধর্মীয় ও সামাজিক কুফল

 ড. ইকবাল কবীর মোহন

রিবা বা সুদ একটি সামাজিক ব্যাধি। সমাজে সুদের কুফল অত্যন্ত ব্যাপক। রিবা সমাজে চরম বিপর্যয় ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। সুদের অশুভ পরিণাম নিয়ে যুগে যুগে সচেতন লোকেরা বিচলিত ছিল।

সুদ মানবিক অনাচার সৃষ্টি করে এবং সমাজকে প্রচণ্ড বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দেয়। তাই সুদের কুফল সম্পর্কে অধিকাংশ ধর্ম নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। নানা মতবাদ ও বিশিষ্ট দার্শনিক সুদকে শোষণের হাতিয়ার বলে ঘোষণা করেছেন। সুদের সর্বগ্রাসী অকল্যাণ সম্পর্কে তাঁরা সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন।

ইসলামেও সুদ নিষিদ্ধ। যেমনটি অন্যান্য ধর্ম, দর্শন ও মতবাদে অবৈধ বলা হয়েছে। সব ধরনের সুদকে কোরআন ও হাদিসে সুস্পষ্টভাবে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। এর পেছনে ধর্মীয় কারণ রয়েছে।

নিম্নে সুদের ধর্মীয় ও সামাজিক কুফল তুলে ধরা হলো :

১. ধর্মীয় কুফল
ক. সুদ হারাম : মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে সুদ হারাম হওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আর আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন, হারাম করেছেন সুদ। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৭৫) অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, তোমরা সুদ খেয়ো না চক্রবৃদ্ধি হারে, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যাতে সফল হতে পার। ’ (সুরা আলে-ইমরান, আয়াত : ১৩০)

খ. আখিরাতে ভয়ংকর পরিণতি : আল্লাহ তাআলা সুদের লেনদেনের জন্য আখিরাতে কঠিন আজাবের কথা ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ বলেছেন, ‘যারা সুদ খায় তারা দাঁড়াবে ওই ব্যক্তির মতো, যাকে শয়তান স্পর্শ করে মোহাবিষ্ট করে দেয়। এ অবস্থা তাদের এ জন্য যে তারা বলে, ‘বেচাকেনা তো সুদেরই মতো। অথচ আল্লাহ বেচাকেনা বৈধ করেছেন এবং সুদ অবৈধ করেছেন। যার কাছে তার পালনকর্তার তরফ থেকে উপদেশ এসেছে এবং সে নিবৃত্ত হয়েছে, তবে পূর্বে যা হয়ে গেছে তা তার, আর তার ব্যাপার আল্লাহর কাছে সোপর্দ। কিন্তু যারা পুনরায় সুদ নেবে, তারাই দোজখবাসী, তারা সেখানে চিরকাল থাকবে। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৭৫)

গ. আল্লাহর বিপক্ষে যুদ্ধের শামিল : যারা সুদের লেনদেন করে তাদের অবস্থা হলো, তারা আল্লাহর প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। আল-কোরআনে তাই বলা হয়েছে, ‘তারপর যদি তোমরা পরিত্যাগ না কর, তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সঙ্গে যুদ্ধ করতে তৈরি হয়ে যাও। কিন্তু তোমরা যদি তাওবা করো, তবে তোমাদের জন্য তোমাদের মূলধন রয়ে যাবে। তোমরা কাউকে অত্যাচার করবে না, না কেউ তোমাদের অত্যাচার করবে। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৭৯)

ঘ. সুদ ভয়াবহ পাপ : সুদের লেনদেন করার পাপ হচ্ছে সর্বাধিক জঘন্য, কুৎসিত ও বীভৎস ধরনের। এ ব্যাপারে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সুদের গুনাহের তিয়াত্তরটি স্তর রয়েছে। এর মধ্যে সর্বনিম্নটি হচ্ছে ব্যক্তি কর্তৃক তার মাকে বিয়ে করার সমতুল্য। ’ (মুসতাদরাকে হাকিম)

ঙ. জাতীয় বিপর্যয় সৃষ্টি : সুদের প্রচলন একটি জাতিকে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দেয়। হাদিসের ভাষ্য থেকে জানা যায়, ‘কোনো জনপদে যখন সুদ ও ব্যভিচারের প্রচলন ঘটে, তখন সেই জনপদবাসীরা নিজেদের ওপর আল্লাহর আজাব টেনে নিয়ে আসে। ’

চ. জান্নাত লাভে ব্যর্থতা : সুদি লেনদেন যারা করবে তাদের স্থান জাহান্নামে হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। আল-কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আর যারা পুনরায় শুরু করবে (সুদি কারবার) তারাই জাহান্নামি হবে। সেখানে তারা চিরদিন থাকবে। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৭৫)

২. সুদের নৈতিক কুফল
ইসলামে সুদ হারাম হওয়ার পেছনে ধর্মীয় কারণ যেমন রয়েছে, তেমনি নৈতিক ও সামাজিকভাবেও সুদ ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত। নিম্নে সুদের নৈতিক ও সামাজিক কুফলগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :

ক. সুদ লোভ, স্বার্থপরতা, কৃপণতার জন্ম দেয় : সুদ ব্যক্তির নৈতিকতা ও ঈমানকে ধ্বংস করে। সুদখোর সমাজের মানুষের জন্য কল্যাণকর কিছু করতে পারে না। সুদখোর ব্যক্তি হয় কৃপণ, লোভী, সংকীর্ণমনা, অর্থপূজার অনুসারী। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট দার্শনিক ও  চিন্তাবিদদের কয়েকটি উক্তি তুলে ধরা হলো :

১. সুদের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, অর্থ সঞ্চয়ের আকাঙ্ক্ষা থেকে শুরু করে সুদি ব্যবসায়ের বিভিন্ন পর্যায় পর্যন্ত সমগ্র মানসিক কর্মকাণ্ড স্বার্থান্ধতা, কার্পণ্য, সংকীর্ণমনতা, মানসিক কাঠিন্য ও অর্থপূজার পারদর্শিতার প্রভাবাধীনে পরিচালিত হয় এবং ব্যবসায়ে মানুষ যতই এগিয়ে যেতে থাকে এ পারদর্শিতা ততই তার মধ্যে বিকাশ লাভ করতে থাকে। ’

২. ড. আনোয়ার ইকবাল কোরেশী ‘ইসলাম অ্যান্ড থিওরি অব ইন্টারেস্ট’ বইয়ে বলেন, ‘এ ধরনের ঋণ সুদখোর সম্প্রদায়ের মধ্যে অর্থলিপ্সা, লোভ, স্বার্থপরতা ও সহানুভূতিহীন দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয়। ’

৩. অর্থনীতিবিদ আফজালুর রহমান তাঁর ‘ইকোনমিক ডকট্রিন্স অব ইসলাম’ বইয়ে উল্লেখ করেন—

ক. সুদ মানুষের মধ্যে কৃপণতা, স্বার্থপরতা, নিষ্ঠুরতা, সম্পদের মোহ ইত্যাদি ঘৃণ্য অভ্যাস গড়ে তোলে। সমাজে ঘৃণা-বিদ্বেষ ও শ্রেণিসংগ্রামের জন্ম দেয় এবং পারস্পরিক সহানুভূতি, সহমর্মিতা ও সহযোগিতার ন্যায় মহৎ গুণাবলির বিকাশ ও উত্কর্ষ বাধাগ্রস্ত করে।

খ. ঘৃণা ও বিদ্বেষ তৈরি করে : ঋণগ্রহীতা অনেক সময় তার সর্বস্ব বিক্রি করে মহাজনের ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে বাধ্য হয়। এর ফলে সুদি কারবারে নিয়োজিত লোকদের বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে জন্ম নেয় ঘৃণা ও বিদ্বেষ।

গ. সুদ ঋণের ভারে জর্জরিত করে : সুদি সমাজে ঋণ পাওয়ার জন্য সুদ ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। মানুষ সুদের আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে যায়। এই সমাজে মানুষ বিপদাপদ ও দুর্বিপাকে পড়লেও সহানুভূতির কোনো অবলম্বন থাকে না; বরং মানুষ মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদ এবং চক্রবৃদ্ধি সুদ দিয়ে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। অর্থনীতিবিদ কার্লমার্কস তাঁর দ্য ক্যাপিটাল পুস্তকে যথার্থই বলেছেন, ‘ঋণগ্রহীতা কখনো উৎপাদনকারী হিসেবে ঋণগ্রহণ করার সুযোগ পায় না। তারা যখনই ঋণ নেয়, তখন ব্যক্তিগত অভাব পূরণের সামগ্রী সংগ্রহের জন্য ঋণ গ্রহণে বাধ্য হয়। ’

ঘ. সুদ কর্মক্ষমতা হ্রাস করে : সুদ মানুষকে প্রকৃত অর্থনৈতিক কার্যকলাপ থেকে ফিরিয়ে রাখে। এ প্রসঙ্গে মুফতি তাকী উসমানী তাঁর ‘সুদ নিষিদ্ধ : পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের রায়’ বইটিতে উল্লেখ করেন, ‘এতে কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। এটি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও প্রচেষ্টার লক্ষ্য ঘুরিয়ে দেয়। যার জন্য প্রকৃত পণ্যসামগ্রী ও সেবা প্রদানের পরিবর্তে অর্থ দিয়ে লাভ করার লক্ষ্যেই যাবতীয় প্রচেষ্টা পরিচালিত হয়।

আমরা সুদের এই ভয়াবহ ধর্মীয় ও নৈতিক কুফল থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করব। এভাবে আখিরাতে মুক্তির পথ প্রসারিত করতে সক্ষম হবো, ইনশাআল্লাহ।

লেখক : প্রাবন্ধিক, ভারপ্রাপ্ত ম্যানেজিং ডিরেক্টর

স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক পিএলসি