পরিবেশদূষণ রোধে ইসলামের নির্দেশনা

পরিবেশদূষণ রোধে ইসলামের নির্দেশনা

 মুফতি মানযুর সিদ্দিক

আল্লাহ তাআলা পার্থিব ও আসমানি মহাবিশ্ব সুনিপুণভাবে সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীকে সবুজ শস্য ও ক্ষেত-খামার, সবুজ বন, বিবেক-বুদ্ধি, হৃদয় ও চোখকে মোহনীয় করা জলপ্রপাত, নদী-সাগর, সুউচ্চ পর্বতমালা ও লম্বা লম্বা গাছ, সুগন্ধি ফুল ও ফল দিয়ে সাজিয়েছেন। তিনিই পৃথিবীর আকাশকে প্রদীপ (অর্থাৎ নক্ষত্র ও গ্রহ) দ্বারা সজ্জিত করেছেন এবং প্রতিটি মহাকাশীয় মহাবিশ্বে তিনি একটি সিস্টেম জমা করেছেন এবং সৃষ্টি ব্যবস্থায় তিনি কোনো অনিয়ম বা অসামঞ্জস্য রাখেননি, যাতে একে অন্যের ভেতর অনুপ্রবেশ না ঘটে। কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে : ‘তিনি সপ্ত আকাশ স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন।

তুমি করুণাময় আল্লাহ তাআলার সৃষ্টিতে কোনো তফাত দেখতে পাবে না। আবার দৃষ্টি ফেরাও, কোনো ফাটল দেখতে পাও কি?’ (সুরা : আল মুলক, আয়াত : ৩)
পৃথিবী যখন বায়বীয় পদার্থের উদ্ভাবন ও তাদের ব্যাপক ব্যবহারের যুগে প্রবেশ করে, তখন শিল্প বিকাশের মাধ্যমে মানুষ বিভিন্ন উদ্ভাবন, বিভিন্ন অনুসন্ধান, রাসায়নিক ও জৈবিক আবিষ্কারের ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করে। এই অনাকাঙ্ক্ষিত ও ব্যাপক উন্নয়নের কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্প আজ কোনো না কোনো পরিবেশদূষণে অবদান রাখছে।

১৭৫০ সালে শিল্প বিপ্লবের পর থেকে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট বেড়েছে। (Climate Change 2014 Synthesis Report Summary for Policymakers, Intergovernmental panel on climate change 2014, pp. 47)
আর চলতি শতাব্দীর শেষ নাগাদ তাপমাত্রা ২-১.৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, যা খুবই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি। এই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হিমবাহ গলতে শুরু করেছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা উপকূলীয় এলাকা তলিয়ে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছে। তা ছাড়া অনাবৃষ্টি ও অপ্রত্যাশিত ঝড় হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনিচ্ছা অভিবাসন, স্বাস্থ্য সমস্যা, খাদ্য সমস্যা, বন্য প্রাণী বিলুপ্তি, বিশুদ্ধ পানির অভাব, অর্থনৈতিক সমস্যা এবং অন্যান্য সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এই বৈশ্বিক উষ্ণায়নের (Global Warming) কারণে বিভিন্ন উৎস থেকে বায়ুমণ্ডলে যুক্ত হচ্ছে গ্রিনহাউস গ্যাস। যার প্রধান উৎস হলো পরিবহন ও শিল্প উৎপাদনের জন্য জৈব জ্বালানি (তেল, গ্যাস, কয়লা ইত্যাদি) পোড়ানো। এ ছাড়া শিল্প উৎপাদনের ফলে নির্গত গ্যাস বায়ুমণ্ডলকে দূষিত করছে। মানুষের এসব কার্যকলাপের কারণে বছরে ৪০ বিলিয়ন টন গ্রিনহাউস গ্যাস বায়ুমণ্ডলে যোগ হচ্ছে।

(Michelle Melton, Sarah Ladislaw, Climate 101: An introduction to climate Change, CSIS, pp. 2, 2015)
অন্যদিকে গাছ কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে পরিবেশকে মনোরম করে। তাই ব্যাপক হারে গাছ কেটে সেখানে দ্রুত জনবসতি গড়ে তোলা, সবুজ এলাকাগুলোকে শক্ত কংক্রিটের ভবন ও সড়কে রূপান্তরিত করার ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বর্তমান অবস্থা থেকে জানা যায়, পরিবেশদূষণ মানবজীবনের বেঁচে থাকার জন্য অন্যতম বড় হুমকি, যা আবহাওয়ার অনিয়ম, তাপমাত্রার ঘাটতি ও আধিক্য, খরা, ঝড়, বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অন্যান্য মানবিক কারণে সৃষ্টি হয়, যার কারণে জন্ম নেয় নানা রোগ।

পরিবেশদূষণ থেকে মানবজীবন সুরক্ষা কিভাবে সম্ভব?

পরিবেশের স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য ইসলাম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও বৃক্ষরোপণের বিস্তারিত নির্দেশ জারি করে এ সমস্যার সুস্পষ্ট সমাধান দিয়েছে। কোরআনে উদ্ভিদ ও বৃক্ষ নষ্ট করা বা কেটে ফেলাকে মুনাফিকদের পথ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন : ‘যখন সে প্রস্থান করে তখন সে পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টির এবং শস্যক্ষেত্র ও জীবজন্তু ধ্বংসের চেষ্টা করে। আর আল্লাহ অশান্তি পছন্দ করেন না। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২০৫

বিনা প্রয়োজনে গাছ কাটা ইসলামী শিক্ষায় নিষিদ্ধ। এমনকি যুদ্ধে যাওয়ার সময়ও মুসলিম বাহিনীকে শহর ও ফসল ধ্বংস না করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো মক্কা বিজয়। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শক্তি ও ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তিনি সাহাবায়ে কিরামকে মানবজীবনের ক্ষতি করতে নিষেধ করেছেন এবং ফসল ও গাছ নষ্ট করতেও নিষেধ করেছেন। মহানবী (সা.) বৃক্ষরোপণকে সদকা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং কিয়ামতের আগে একটি গাছ লাগানোর সুযোগ পেলে গাছ লাগাতেও নির্দেশ দিয়েছেন।

আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : ‘যদি কিয়ামত এসে যায় এবং তখন তোমাদের কারো হাতে (খেজুরের) চারাগাছ থাকে তবে কিয়ামত আসার আগেই সে যদি পারে এই চারাগাছ যেন রোপণ করে। (আল আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ৪৮০; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১২৯০২)

হাদিসের আলোকে পরিবেশদূষণ সমস্যার সমাধান

যত্রতত্র দুর্গন্ধময় পানির কারণে পুরো শহর বন্যায় পরিণত হলে প্রাকৃতিক ও চিকিৎসার দিক থেকে এমন জায়গায় মানুষের জীবনযাপন অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ কারণেই ইসলাম সব ধরনের পরিবেশদূষণ দূর করার শিক্ষা দিয়েছে, যাতে মানুষ মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও শারীরিকভাবে নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করতে পারে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনী এই ধরনের পরিবেশদূষণকে নির্মূল করাই যেন মুখ্য উদ্দেশ্য। এখানে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো—

পানির অপচয় রোধ

পানি আল্লাহ তাআলার একটি বড় নিয়ামত। তা রক্ষা করতে হবে এবং যথাসম্ভব অপচয় এড়িয়ে চলতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবায়ে কিরামকে পানির অপচয় থেকে রক্ষা করার জন্য কতটা তাগিদ দিয়েছেন, তা জানলে যে কেউ অবাক হবে। ইবনে উমর (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এক ব্যক্তিকে অজু করতে দেখে বললেন, অপচয় কোরো না, অপচয় কোরো না। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪২৪)

রাসুলুল্লাহ (সা.) যেমন পানির অপচয় করতে নিষেধ করেছেন, তেমনি তিনি পানিকে অপবিত্রতা থেকে রক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছেন; সে পানি স্থির হোক বা প্রবাহিত। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যেন স্থিরকৃত পানিতে প্রস্রাব না করে। ’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৪৪)

অন্য বর্ণনায় এসেছে, জাবের (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বহমান পানিতে প্রস্রাব করতে নিষেধ করেছেন। (আল মুজামুল আওসাত, হাদিস : ১৭৪৯)

ভূমি ও বায়ুদূষণের প্রতিকার

হাদিসের আলোকে বৃক্ষরোপণ ভূমি ও বায়ুদূষণ থেকে পরিত্রাণের একটি উপায়, যা কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্মূল ও অক্সিজেন সমৃদ্ধ করার সর্বোত্তম মাধ্যম। রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবায়ে কিরামকেও গাছ লাগানোর প্রতি উৎসাহিত করেছেন এবং গাছ লাগানোর সওয়াব ঘোষণা করেছেন। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে মুসলমান গাছ লাগায় বা ক্ষেত চাষ করে এরপর তা থেকে পাখি, মানুষ বা পশু খায়, এটা তার জন্য সদকাস্বরূপ। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৩২০, সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৫৬৩)

সাহাবায়ে কিরামদের বৃক্ষরোপণ

আবু হুরায়রা (রা.) বলেছেন, ‘একদিন আমি একটি বৃক্ষ রোপণ করছিলাম, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন এবং তিনি বলেন, হে আবু হুরায়রা! তুমি কী করছ? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল (সা.), আমি গাছ রোপণ করছি। ’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৮০৭)

বিনা প্রয়োজনে গাছ নিধন নিষিদ্ধ

আবদুল্লাহ ইবনে হুবশি (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি (অকারণে) একটি কুলগাছ কাটবে আল্লাহ তাকে অধোমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ৫২৩৯)

বাজার বা রাস্তায় ময়লা ফেলা নিষিদ্ধ

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সিরাত থেকে রাস্তাঘাট ও বাজার পরিষ্কার রাখার ব্যাপারে নির্দেশ পাওয়া যায়। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ঈমানের সত্তরোর্ধ্ব কিংবা ষাটোর্ধ্ব শাখা আছে এবং সর্বনিম্ন শাখা হচ্ছে পথ থেকে কষ্টদায়ক কিছু সরিয়ে ফেলা। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৩৫)

অর্থাৎ ঈমানের ন্যূনতম দাবি, চলার পথে সাধ্যানুযায়ী কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেওয়া। এটি আমার নাজাতেরও কারণ হয়ে যেতে পারে!

পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে ইসলামের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ধর্ম আর নেই। ইসলাম তার অনুসারীদের নিজেদের শরীর ও চারপাশ পরিষ্কার রাখার নির্দেশ দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) পবিত্রতাকে ঈমানের অর্ধেক বলে ঘোষণা করেছেন। আবু মালেক আল আশআরি (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : পবিত্রতা হলো, ঈমানের অর্ধেক। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২২৩)

আসুন! আমরা আমাদের চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখি। পাশাপাশি যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত হই। আল্লাহ তাআলা আমাদের এমন ভয়াবহ জলবায়ু পরিবর্তন থেকে হেফাজত করুন। আমিন।

লেখক : বিভাগীয় প্রধান ও তত্ত্বাবধায়ক, ফতওয়া ও ইসলামী গবেষণা বিভাগ, আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম। ‘বৈশ্বিক পর্যালোচনা’ শীর্ষক লেকচার থেকে অনুলিখন করেছেন আসআদ শাহীন