কোরআনে মানবজাতির সর্বোত্তম আদর্শ যাঁরা

কোরআনে মানবজাতির সর্বোত্তম আদর্শ যাঁরা

 আলেমা হাবিবা আক্তার

মানবসমাজে বিচিত্র স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যের মানুষ বসবাস করে। তাদের মধ্যে যারা ভালো ও মন্দ উভয় শ্রেণির মানুষ বিদ্যমান। যারা উত্তম চরিত্র ও গুণাবলির অধিকারী তারা মানবজাতির জন্য আদর্শ ও অনুসরণীয়। আর যাদের স্বভাব-চরিত্র মন্দ তারা পরিহারযোগ্য।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ উভয় শ্রেণির মানুষের বর্ণনা দিয়েছেন; যেন মানুষ ভালোদের অনুসরণ এবং মন্দদের থেকে দূরে থাকতে পারে।

আদর্শের পরিচয়

আরবি ভাষায় আদর্শ ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব বোঝাতে প্রধানত দুটি শব্দ ব্যবহার করা হয় : উসওয়াহ ও কিদওয়াহ। ইমাম কুরতুবি (রহ.) উভয় শব্দকে সমার্থক বলেছেন। এরপর তিনি আদর্শের পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘আদর্শ হলো এমন বিষয়, যা মানুষ সব কাজে ও সব সময়ে অনুসরণ করে থাকে।

’ (তাফসিরে কুরতুবি)

নবী-রাসুলরাই মানবজাতির আদর্শ

নবী-রাসুল (আ.) মানবজাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান এবং তাঁরাই মানবজাতির জন্য আদর্শ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাঁদের অনুসরণের নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘তাদেরকেই আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেছেন, সুতরাং তুমি তাদের পথের অনুসরণ কোরো। বোলো, এর জন্য আমি তোমাদের কাছে পারিশ্রমিক চাই না, তা তো শুধু বিশ্বজগতের জন্য উপদেশ। ’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ৯০)

সর্বোত্তম আদর্শ মহানবী (সা.)

কোনো সন্দেহ নেই, সব নবী-রাসুল (আ.) মানবজাতির জন্য আদর্শ ও অনুসরণীয় ছিলেন। তবে আল্লাহ রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সর্বোত্তম আদর্শ হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে আছে উত্তম আদর্শ। ’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ২১)

আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, আয়াতটি কথা, কাজ ও অবস্থার ক্ষেত্রে নবীজি (সা.)-এর আনুগত্য বিষয়ে শরিয়তের বড় একটি মূলনীতি।

তাঁরা মানবজাতির আদর্শ কেন

নবী-রাসুল (আ.) মানবজাতির জন্য আদর্শ এবং মহানবী (সা.) সর্বোত্তম আদর্শ। কেননা তাঁরা ছিলেন মাসুম তথা আল্লাহ কর্তৃক সুরক্ষাপ্রাপ্ত এবং তাঁদের সমগ্র জীবন ছিল ঐশী নির্দেশনায় পরিচালিত।

 সাইয়েদ কুতুব শহীদ (রহ.) বলেন, ‘নবীজি (সা.)-এর জীবনচরিত, তাঁর বাস্তব জীবন এবং তাতে যা কিছু আছে তার সব আসমানি আহ্বানের প্রকৃতি দ্বারা সুবাসিত। তিনি আসমানি আলোয় পা ফেলে এগিয়েছেন। যার বিভা প্রকাশ পেয়েছে তাঁর পরিবার ও নিকটজনদের জীবনচরিতে। ফলে তাঁরা হয়ে ওঠেন মুক্তিপ্রাপ্ত মানুষের দৃষ্টান্ত। ’ (ফি দিলালিল কোরআন : ৭/২৫৩)

আদর্শ মানবের আনুগত্য ঈমানের দাবি

সুরা আহজাবের ২১ নং আয়াতে আল্লাহ ‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে’ বাক্য যুক্ত করেছেন। যার দ্বারা বোঝা যায়, নবীজি (সা.)-এর অনুসরণ করা মুমিনের ঈমানের দাবি। তবে কারো ঈমান যদি দুর্বল হয় এবং রাসুল (সা.)-এর প্রতি তাঁর ভালোবাসা দুর্বল হয়, তবে তার প্রতি আল্লাহর নির্দেশ হলো, ‘বলো, আল্লাহর আনুগত্য করো এবং রাসুলের আনুগত্য করো। ’ (সুরা : নুর, আয়াত : ৫৪)

আদর্শ মানবের আনুগত্যের পুরস্কার

আল্লাহ পবিত্র কোরআনে আদর্শ মানুষ তথা নবী-রাসুলদের পরিচয় তুলে ধরেছেন, তাঁদের আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছেন এবং অনুগতদের জন্য পুরস্কারও ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন, ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে ও তাঁর অবাধ্যতা থেকে সাবধান থাকে তারাই সফলকাম। ’ (সুরা : নুর, আয়াত : ৫২)

আনুগত্য ঐচ্ছিক নয়, আবশ্যিক

সাধারণ অবস্থায় মানবজাতির জন্য আদর্শ মহানবী (সা.)-এর আনুগত্য করা। এটা ঐচ্ছিক নয়, আবশ্যিক। কেননা আল্লাহ তাঁর নবীর অনুগত্যকে নিজের আনুগত্য বলে ঘোষণা করেছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘কেউ রাসুলের আনুগত্য করলে সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করল এবং মুখ ফিরিয়ে নিলে তোমাকে তাদের ওপর তত্ত্বাবধায়ক প্রেরণ করি নাই। ’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৮০)

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে আমার আনুগত্য করল সে আল্লাহরই আনুগত্য করল এবং যে আমার অবাধ্য হলো সে আল্লাহরই অবাধ্য হলো। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭১৩৭)

অনুসরণে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ

যেসব বিষয় শরিয়ত-সংশ্লিষ্ট নয়, বরং জাগতিক, সেগুলো অনুসরণ করা আবশ্যক নয়। তা অনুসরণ করা ঐচ্ছিক। প্রাজ্ঞ আলেমরা বলেন, জাগতিক বিষয়ে নবীজি (সা.)-এর অনুসরণও বরকতশূন্য নয়। কেননা এর মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি মুমিনের ভালোবাসা প্রকাশ পায়। আর নবীজি (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা, তার সন্তান ও সব মানুষের চেয়ে বেশি প্রিয়পাত্র হবো না। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৫)

তবে এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, যে কাজগুলো রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে বিশেষায়িত ছিল তা উম্মতের জন্য অনুসরণীয় নয়। যেমন—চারের অধিক বিয়ে করা, অবিরাম রোজা, তাহাজ্জুদ ওয়াজিব হওয়া ইত্যাদি। (নুরুল আনওয়ার, পৃষ্ঠা-২১৬)

মুমিন অন্যের জন্য অনুসরণীয়

একজন মুমিন, যিনি তাঁর ঈমান ও ইসলামের ক্ষেত্রে যত্নশীল, তিনি দেশ, জাতি ও সমাজের জন্য আদর্শ। আদর্শ হিসেবে তাঁরা নবী-রাসুলদের সঙ্গে তুল্য নন, তবে তাঁদের ভেতর থেকেও যে আল্লাহ অনুসরণীয় মানুষ তৈরি করেন তা নিম্নোক্ত আয়াত দ্বারা বোঝা যায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং স্মরণ করো, যখন ইবরাহিমকে তার প্রতিপালক কয়েকটি কথা দ্বারা পরীক্ষা করেছিলেন এবং সেগুলো সে পূর্ণ করেছিল। আল্লাহ বললেন, আমি তোমাকে মানবজাতির নেতা করেছি। সে বলল, আমার বংশধরদের মধ্য থেকেও? আল্লাহ বললেন, আমার প্রতিশ্রুতি জালিমদের জন্য প্রযোজ্য নয়। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১২৪)

অনুসরণীয় হওয়ার প্রার্থনা

মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে মানবজাতির জন্য অনুসরণীয় হওয়ার দোয়া শিখিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং যারা প্রার্থনা করে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জন্য এমন স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দান করো, যারা হবে আমাদের জন্য নয়নপ্রীতিকর এবং আমাদেরকে করো মুত্তাকিদের জন্য অনুসরণযোগ্য। ’ (সুরা : ফোরকান, আয়াত : ৭৪)

আল্লাহ সবাইকে মহানবী (সা.)-এর আদর্শের যথাযথ অনুসরণ করার তাওফিক দিন। আমিন।