বাংলাদেশের নির্বাচনে ভূ-রাজনীতির প্রভাব

সংগৃহীত ছবি

বাংলাদেশের নির্বাচনে ভূ-রাজনীতির প্রভাব

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

আন্তর্জাতিক আইন, জাতিসংঘ সনদ, আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) রায় অনুযায়ী জাতিসংঘের সব সদস্য রাষ্ট্রই সমান মর্যাদায় সার্বভৌমত্বের অধিকারী এবং কোনো দেশ অন্য দেশের ঘরোয়া বিষয়ে নাক গলাতে পারে না। এই নির্দেশনারই প্রচ্ছন্ন প্রতিফলন ঘটেছে গত ১০ নভেম্বর যখন ভারত সরকার সফররত মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দেয় যে বাংলাদেশের নির্বাচন একান্তভাবেই সে দেশের বিষয় হওয়ায় তাতে অন্য কোনো রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

বাংলাদেশ ভারতের নিকটতম প্রতিবেশী হওয়ায় এবং দুই দেশের মধ্যে বিরাট সীমান্ত রয়েছে বিধায় এক দেশের ঘটনাবলি অন্য দেশের জন্য তাৎপর্য বহন করে। সে অর্থে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে ভারতের স্বার্থ থাকা খুবই স্বাভাবিক।

কিন্তু সে বিষয়গুলো প্রকাশ্যে না এনে ভারত আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে  প্রশংসিত হয়েছে।

বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ করুক, সেখানে একটি অসাম্প্রদায়িক সরকার ক্ষমতাপ্রাপ্ত হোক, এমন সরকার ক্ষমতাপ্রাপ্ত না হোক, যারা মজ্জাগত ভারতবিরোধী, সে প্রত্যাশা ভারত করবে- এটা স্বাভাবিক। ভারত তা-ই চাইছে। তবে সে কারণে কোনো দলকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেওয়া থেকেও বিরত থাকছে, আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যবাধকতার কারণে।

ভারতের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বাংলাদেশের নির্বাচনে ভারতের ভূমিকা কী হওয়া উচিত, সে বিষয়ে বেশ কয়েক মাস ধরেই লেখালেখি চলছে। এসব পত্রিকা ভারত সরকার নিয়ন্ত্রিত নয়। এসব লেখার অধিকার তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত। আওয়ামী লীগ ও তার সমমনা দলগুলো যে ভারতের আকাঙ্ক্ষাভুক্ত, সে ব্যাপারে গোপনীয়তার অবকাশ নেই।

ভারতের আওয়ামীপ্রীতির পক্ষে যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বাংলাদেশের নির্বাচনে ভূ-রাজনীতির প্রভাব১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী এই দলটির সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে ভারতের, ভারত কর্তৃক প্রত্যক্ষ এবং অকৃপণভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা প্রদানের কারণে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং তারপর দলের অন্যান্য কর্ণধার ভারতের সঙ্গে রক্তের সম্পর্কের কথা শুধু ভাষায়ই ব্যক্ত করেননি, বরং বাস্তবেও প্রমাণ করেছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির লোকজন ভারতবিরোধিতাকে উসকে দেওয়ার যে চেষ্টা করেছে, আওয়ামী লীগ ও তার সমমনা দলগুলো তা সব সময়ই প্রতিহত করার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।

গত ১৬ নভেম্বর ভারতের দৈনিক টেলিগ্রাফ পত্রিকা তাদের মতামত কলামে লিখেছে যে বাংলাদেশের কোনো বিশেষ দলকে সমর্থন দেওয়া ভারতের উচিত হবে না, বরং দলনিরপেক্ষ থাকাই হবে যৌক্তিক।

পত্রিকাটির ভাষ্যে এমন ইঙ্গিত রয়েছে যে বিএনপিকেও হাতছাড়া করা ভারতের জন্য ঠিক হবে না। পত্রিকাটি ওই মতের সমর্থনে যা লিখেছে তা হলো এই যে বাংলাদেশ ভারতের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাষ্ট্র হলেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়ে বাংলাদেশ চীনের দিকে অনেকটা ঝুঁকে পড়েছে, বাংলাদেশে চীনের প্রভাব অনেক বেড়ে গেছে। চীনের সঙ্গে ভারতের বৈরিতার কারণ অবোধগম্য নয়। চীন এখনো ভারতের উত্তরাঞ্চলের বিশাল এলাকা থেকে তার লোলুপ দৃষ্টি সরায়নি। সে দেশটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ম্যাকমেহন লাইন মানতে নারাজ। তারা এমনকি চীন-ভারত স্বীকৃত লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলকে মানছে না। চীন যেভাবে তিব্বত ও জিন জিয়াং অঞ্চল দখল করেছিল, একই পন্থায় ভারতের বিরাট এলাকা দখলের পাঁয়তারা করছে। ভারতের সেই অঞ্চলে চীন প্রচুর সামরিক সরঞ্জাম জড়ো করে ভারতের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। প্রায়ই সেখানে ভারতীয় ও চীনা সেনাদের মধ্যে ছোটখাটো যুদ্ধের ঘটনা ঘটছে। এর কারণে ভারতকে বিশাল অঙ্ক ব্যয় করতে হচ্ছে তার সামরিক বাহিনীকে চীন ও পাকিস্তানি সম্ভাব্য আগ্রাসন থেকে নিরাপদ রাখার জন্য। শুধু ভারতের উত্তরাঞ্চলই নয়, চীন ভারতের পার্শ্ববর্তী দেশগুলো ব্যবহার করে ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার সব অপকর্মই চালিয়ে যাচ্ছে।

ছলে-কৌশলে শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর দখলে নেওয়ার পর চীন সেটি একাধিকবার ব্যবহার করেছে ভারতের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের জন্য। নেপালে তাদের পছন্দের সরকারকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার জন্য চীন নগ্নভাবে সে দেশের ঘরোয়া ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেছে, যার উদ্দেশ্য ছিল নেপালে চীনপন্থী সরকার বসিয়ে সে দেশের ভূমি ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা। সম্প্রতি মালদ্বীপের নির্বাচনকালেও চীন সর্বশক্তি প্রয়োগ করে সেখানে চীনপন্থী সরকার বসাতে সক্ষম হয়েছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ব্রহ্ম চেলানি কয়েক মাস আগে এই মর্মে একটি ভয়ংকর তথ্য প্রকাশ করেছেন যে চীন আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের অতি নিকটে এমন একটি নৌঘাঁটি মিয়ানমারের সহায়তায় গড়ে তুলছে, যেখান থেকে সে ভারতের বিরুদ্ধে সহজেই অভিযান চালাতে পারবে। তবে ভালো কথা হলো যে এই শেখ হাসিনা সরকারই চীনের সেই দুরভিসন্ধি কার্যকর হতে দিচ্ছে না।

ভারতের টেলিগ্রাফ পত্রিকার মতে, ভারতের উচিত বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলকে কাছে রাখা। পত্রিকাটি নিশ্চয়ই ভুলে যায়নি যে এই দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের যাত্রাই শুরু হয়েছিল ভারতবিরোধিতা দিয়ে, পাকিস্তানি শাসকদের নির্দেশে। জিয়াউর রহমান তাঁর ক্ষমতায় থাকার গোটা সময় ভারতবিরোধিতা এবং সাম্প্রদায়িকতার ধারণা প্রচারে ব্যস্ত ছিল। তাঁর অপশাসন আমলেই বাংলাদেশে ভারতবিরোধিতা তুঙ্গে ওঠে জিয়ার অপকৌশলে, যা এখনো বলবৎ রয়েছে। স্বাধীনতার পরপরই স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির টার্গেট হয় ভারত আর সে উদ্দেশ্য সফল করতে তারা এমন একটি শ্রেণি সৃষ্টি করে, যাদের ইংরেজি ভাষায় Pathological anti Indian, বা মজ্জাগত ভারতবিরোধী বলা যায়।

কোনো কারণ ছাড়াই এই গোষ্ঠী মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণকে ভারতবিদ্বেষী করে তুলতে সচেষ্ট। জিয়া ক্ষমতা অপদখলের পর এই গোষ্ঠী আরো বহুগুণ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। জিয়া-পরবর্তীকালে, বিশেষ করে তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়ার শাসনকালেও এই মজ্জাগত ভারতবিরোধিতা শুধু চলতেই থাকে না, বরং বাস্তবতা প্রাপ্ত হয়। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রত্যক্ষ মদদ এবং সহায়তায় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সংগঠনকে বাংলাদেশের মাটিতে ঘাঁটি তৈরি করতে দেওয়া হয়। তাদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। চীন থেকে অস্ত্র এনে তাদের উদ্দেশে পাঠানোর জন্য বাংলাদেশের বন্দর এবং ভূমি ব্যবহার করা হয়। যে কথা ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালানের ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর জানা যায়। সেই ১০ ট্রাকই যে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উদ্দেশে পাঠানো একমাত্র অস্ত্রের চালান ছিল, তা নয়। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের, বিশেষ করে অনুপ চেটিয়ার বিবৃতি থেকে জানা গেছে যে অতীতে এ ধরনের বহু অস্ত্র বিএনপি-জামায়াত সরকারের সহায়তায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছে পাঠানো হয়েছিল। শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি-জামায়াত সরকারের সহায়তায় ভারতবিরোধী সন্ত্রাসীদের সমস্ত ঘাঁটি ধ্বংস করে ভারতের উত্তর-পূর্ব সাতটি প্রদেশে শান্তির পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপধ্যায়ের ঢাকা সফরকালে খালেদা জিয়া তাঁর প্রতি যে অসদাচরণ করেছেন, টেলিগ্রাফ পত্রিকার সেটিও ভুলে যাওয়ার কথা নয়।

আজ বিএনপি ভারতের সমর্থন পেয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বলতে গেলে উন্মাদ হয়ে গেছে। বিএনপির কোনো কোনো নেতার বক্তব্য থেকেই এটি পরিষ্কার। বিএনপি ভারতকে বহুবিধ প্রস্তাব দিচ্ছে, বহু প্রতিজ্ঞাসুলভ কথাও বলছে। এর মধ্যে চীন ঠেকানোর প্রস্তাবও রয়েছে। কিন্তু এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে বিএনপি এমন একটি দল, যার সৃষ্টিই হয়েছিল পাকিস্তানি নির্দেশনায় ভারতবিরোধী অপশক্তি হিসেবে। যে দলটি মজ্জাগতভাবে ভারতবিরোধী, সে দলে রাতারাতি ভারতপ্রীতি গড়ে উঠবে, তা হতে পারে না। বিএনপিকে বিশ্বাস করলে ভারত মস্ত বড় ভুল করবে। চীন আজ যা-ই বলুক না কেন, বিএনপিই যে তাদের স্বাভাবিক মিত্র সে কথা প্রমাণিত। ১৯৭৭ সালে জিয়া পিকিং সফরে গেলে চীন সরকার তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য, যে কথা গণমাধ্যমেও উঠে এসেছে। চীনের আগ্রাসী নীতি সারা বিশ্বে যেমন চিন্তার কারণ হয়েছে, বাংলাদেশের দেশপ্রেমিকরাও একইভাবে উদ্বিগ্ন। চীন যেন ভারতবিরোধী কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশকে ব্যবহার করতে না পারে সে ব্যাপারে জনগণের মধ্যেই বেশ সচেতনতা রয়েছে। অতীতের অভিজ্ঞতা বলছে, পাকিস্তানপ্রেমী বিএনপি-জামায়াতিরা ক্ষমতায় এলেই চীনের সেই অভিলাষ জোরালো হবে। ভারতের এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যার কারণে বাংলাদেশ সরকার আরো বেশি চীননির্ভর হয়ে পড়ে।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি