গত দুদিন পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষে অস্থির হয়ে উঠেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের দুই জেলা। অস্থিরতার শুরুটা হয় খাগড়াছড়িতে। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে রাঙামাটিতে। সংঘর্ষের ঘটনায় এখন পর্যন্ত চারজন নিহতের খবর পাওয়া গেছে।
এ পরিস্থিতিতে তিন পার্বত্য জেলায় উত্তেজনা নিরসনে ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে সর্বসাধারণকে অনুরোধ করেছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর)।
গত বুধবার খাগড়াছড়িতে মো. মামুন নামের এক ব্যক্তিকে গণপিটুনি এবং পরে তার মৃত্যুর ঘটনায় সেখানকার পরিস্থিতি অশান্ত হয়ে ওঠে। পরে জেলা সদরে সহিংস ঘটনার সময় গুলিতে তিনজন নিহত এবং ৯ জন আহত হন। এই পরিস্থিতিতে শুক্রবার দুপুর ২টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খাগড়াছড়ি শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। বাড়ানো হয় সেনাবাহিনী-বিজিবির টহল। সহিংসতা এড়াতে সবাইকে সহনশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান।
গত বৃহস্পতিবার রাত আনুমানিক ১১টার দিকে জেলা শহরের নারানখখাইয়া ও স্বনির্ভর এলাকায় গোলাগুলির শব্দ শুনতে পায় স্থানীয়রা। এতে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
এরপর রাতে ১২ জনকে খাগড়াছড়ি জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর মধ্যে জুনান চাকমা (২২), ধন রঞ্জন চাকমা (৫০) ও রুবেল ত্রিপুরা (২৪) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। জুনান চাকমা ও রুবেল ত্রিপুরার বাড়ি খাগড়াছড়ি সদরে, ধন রঞ্জন চাকমার বাড়ি দীঘিনালার উদাল বাগান এলাকায়।
খাগড়াছড়ি জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. রিপল বাপ্পি চাকমা বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, ময়নাতদন্তের পর নিহত হওয়ার কারণ জানা যাবে। আর যে চারজনকে চট্টগ্রাম মেডিক্যালে পাঠানো হয়েছে, এর মধ্যে আমিনুল হোসেন (২৬) নামের একজন বাঙালিও রয়েছেন।
আহতরা হলো জ্যোতিশ্বর ত্রিপুরা (৩৭), সোহেল দেওয়ান (১৯), নলেজ চাকমা (৩৫), বিজয় চাকমা (৩৪), আনন্দ চাকমা (৫২), সুজন ত্রিপুরা (১৮), পহেল দেওয়ান (৩০) ও মানব ত্রিপুরা (১৬)। আহতদের মধ্যে কয়েকজন গুলিবিদ্ধ বলে জানান কর্তব্যরত চিকিৎসক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খবংপুড়িয়ার এক বাসিন্দা গণমাধ্যমকে জানান, পাহাড়ি ছাত্র ও যুবকরা জড়ো হতে থাকলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী সেখানে গেলে উত্তেজনা দেখা দেয়।
এদিকে বৃহস্পতিবার বিকেলে জেলার দীঘিনালা লারমা স্কয়ারে পাহাড়ি-বাঙালিদের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এক পর্যায়ে লারমা স্কয়ারের বাজারে আগুন লাগিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে ১০০টির মতো দোকান পুড়ে যায়। আহত হয় উভয় পক্ষের পাঁচজন। মো. মামুনের মৃত্যুর প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার বিকেলে দীঘিনালায় বাঙালি শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে। বিক্ষোভের এক পর্যায়ে সহিংসতা দেখা দেয়।
শুক্রবার সকালে জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান, দীঘিনালা সেনা জোনের অধিনায়ক লে. কর্নেল ওমর ফারুক ও পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েল দীঘিনালার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন। এ সময় তারা স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন। ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠনসহ দোষীদের আইনের আওতায় আনার আশ্বাস দেন তারা।
জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান জানান, পরিস্থিতি শান্ত রাখতে সেনাবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। শান্তি-সম্প্রীতি রক্ষায় সবাইকে সংযতভাবে চলার আহ্বান জানান তিনি।
পার্বত্য নাগরিক পরিষদের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল মজিদ খাগড়াছড়ি ও দীঘিনালার ঘটনার জন্য ইউপিডিএফকে দায়ী করেছেন। তিনি জানান, নিজেরাই সংকট তৈরি করে বাঙালিদের ওপর দায় চাপানো দলটির অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
অন্যদিকে ইউপিডিএফ এক বিবৃতিতে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে হামলা, খুন ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। একই সঙ্গে ছাত্র-জনতার ঘোষিত তিন পার্বত্য জেলায় (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান) ৭২ ঘণ্টা সড়ক ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। আজ শনিবার ভোর থেকে অবরোধ কর্মসূচি ডাকা হয়।
এদিকে খাগড়াছড়ির সহিংস ঘটনার প্রতিবাদে রাঙামাটিতে একটি বিক্ষোভ মিছিলের পর শহরজুড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এতে একজন নিহত এবং ৫৮ জন আহত হন। এ সময় বেশ কিছু অফিস ও দোকানপাট পুড়িয়ে দেওয়া হলে শুক্রবার দুপুরে জেলা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে জেলা প্রশাসন।
শুক্রবার সকালে রাঙামাটি শহরের জিমনেসিয়াম চত্বর থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে বৈষম্যবিরোধী পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের ব্যানারে কয়েক হাজার মানুষ। মিছিলটি শহরের প্রধান সড়ক ধরে বনরূপায় যায়। সেখানে মিছিলের পেছনের একটি অংশে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়েছে—এমন অভিযোগে শহরের প্রাণকেন্দ্র বনরূপার সড়কের পাশে বেশ কয়েকটি দোকানপাট ভাঙচুর, পাশের বিভিন্ন ভবনসহ বনরূপা জামে মসজিদে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। ভাঙচুর শেষে মিছিলটি আবার নিউ কোর্ট বিল্ডিংয়ের দিকে চলে যায়।
এর কিছুক্ষণ পর বনরূপার ব্যবসায়ীসহ বাঙালিরা সংঘবদ্ধ হয়ে লাঠিসোঁটা নিয়ে পাল্টা হামলা চালায়। এ সময় বাঙালিদের হামলায় পাহাড়িদের মালিকানাধীন বেশ কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোনোটি পুড়িয়েও দেওয়া হয়। এ সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ভবনের নিচে পার্ক করে রাখা ছয়-সাতটি গাড়িও পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পরে শহরের বিভিন্ন স্থানে পোড়ানো হয় বাঙালি-পাহাড়িদের বেশ কিছু গাড়ি। বিভিন্ন স্থানে পাল্টাপাল্টি হামলায় আহত হয় অর্ধশতাধিক মানুষ, যাদের মধ্যে আজ্ঞাতনামা একজন মারা যান। আহত অন্তত ৫৮ জন রাঙামাটি সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। ভর্তি হয়েছে ১৯ জন। চট্টগ্রামে রেফার করা হয়েছে তিনজনকে।
রাঙামাটি সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. শওকত আকবর বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে ৫৮ জন চিকিৎসা নিয়েছে। এর মধ্যে ১৯ জন ভর্তি হয়েছে, একজন মারা গেছেন, তিনজনকে চট্টগ্রাম পাঠানো হয়েছে। এখানে যারা ভর্তি আছে, তাদের অবস্থা মোটামুটি শঙ্কামুক্ত। ’
গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাতে মৃত্যু, অগ্নিসংযোগ ও হামলার প্রতিবাদে শুক্রবার সকালে বান্দরবান শহরে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে আদিবাসী/ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা। বান্দরবান সম্মিলিত আদিবাসী ছাত্রসমাজ ব্যানার, প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন নিয়ে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা রাজার মাঠ থেকে বের হয়ে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
এছাড়া খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলায় পাহাড়িদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ‘বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে বিক্ষোভকারীরা। শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে শতাধিক মানুষ এই অবরোধ ও বিক্ষোভে অংশ নেয়।
বিক্ষোভ ও অবরোধ করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) অধ্যয়নরত আদিবাসী শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফরম ইনডিজেনাস স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনও। হামলার প্রতিবাদ ও বিচারের দাবিতে শুক্রবার বিকেল ৪টার দিকে সাত দফা দাবিতে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে তারা।
news24bd.tv/আইএএম