আমিরাত-ফেরত সেই বাংলাদেশিদের মুখে ‘নতুন জীবন পাওয়ার’ গল্প

সংযুক্ত আমিরাতে বিক্ষোভ

আমিরাত-ফেরত সেই বাংলাদেশিদের মুখে ‘নতুন জীবন পাওয়ার’ গল্প

অনলাইন ডেস্ক

সংযুক্ত আরব আমিরাতে গত জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমর্থনে মিছিল বের করেন একদল বাংলাদেশি প্রবাসী। দেশটির আইনের আওতায় এ ঘটনায় ৫৭ বাংলাদেশিকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয় আমিরাত সরকার। পরে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সফলতায় অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিলে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাদের ক্ষমা করে দিতে আমিরাত সরকারের কাছে আবেদন জানান। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩ সেপ্টেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতের ফেডারেল কোর্টে দোষী সাব্যস্ত ৫৭ বাংলাদেশিকে ক্ষমা করে দেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ।

 

৫৭ বাংলাদেশির মত্যে তিন প্রবাসী শ্রমিক মাহফুজ, ইয়াসিন ও সোহেল। তারা গত ৮ সেপ্টেম্বর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। এর বাইরেও বেশ কয়েকজন দেশে আসেন।   

জানা যায়, আমিরাতে ছেলে গাজী মাহফুজুর রহমানের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের খবর শুনে তার মা কামরুন নাহারের মাথা খারাপ হয়ে যায়।

মাহফুজ কখনো এমন কোনো অন্যায় বা অপরাধের সঙ্গে জড়ায়নি, যার জন্য তাকে জেলে যেতে হতে পারে। চট্টগ্রামের এই যুবক শারজায় কয়েকটি গাড়ির ওয়ার্কশপ চালাতেন।  

২০২৪ সালের ১৯ জুলাই শারজাহ ইন্ডাস্ট্রিয়াল-১০ এলাকায় বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে যোগ দেন মাহফুজ। তখন তিনি জানতেন না, ছোট্ট এই কাজটির জন্য তাকে ২৫ বছরের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।  

সেই মুহূর্তের বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন কামরুন নাহার। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ছেলের জেলে যাওয়ার কথা শোনার পর থেকে আমার জীবনে আর খাওয়া, ঘুম বা অন্য কোনো কিছু নেই। ’

তার স্বামী গাজী ইসহাক জানান, তার স্ত্রী বিভিন্ন মসজিদ ও মাজারে যাচ্ছেন এবং ছেলের মুক্তির জন্য দোয়া করছেন।  

গাজী ইসহাক বলেন, ‘ছেলের মুক্তির জন্য আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে সাহায্য চাওয়ার জায়গা ছিল না। ভেবেছিলাম এক-দুই বছর না, ২৫ বছর আমরা আমাদের ছেলেকে আর দেখতে পাব না। ’
 
মাহফুজ বলেন, ‘পরিস্থিতি খুব ভয়ানক ছিল। চোখের পলকে যেন সবকিছু ঘটে গেল। আমি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিলাম। সংযুক্ত আরব আমিরাতের নিয়ম খুবই কড়া। তারা সরাসরি আমাদের ২৫ বছর কারাদণ্ড দিয়েছিল। আদালতে হাজির করা একজনকেও তারা ছাড়েনি। ’

তিনি বলেন, ‘আমি কল্পনাও করতে পারিনি আমার জীবনটা এমন হবে। ৪০ দিনের বেশি সময় ধরে আমরা ৩১ জন একরুমে ছিলাম। আমরা সারাক্ষণ কাঁদতাম। ’

মাহফুজ অবশ্য আটকদের সংখ্যা এবং রায়ের তারিখ সম্পর্কে গণমাধ্যমে যা প্রকাশিত হয়েছে, সেসব সম্পর্কে ভিন্ন তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘গত ৬ আগস্ট আদালতে হাজির করা ‘দ্বিতীয় ব্যাচের ৫৭ জনের’ মধ্যে তিনি ছিলেন। এদের মধ্যে ৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং বাকিদের ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ’ 

গত ১৯ জুলাই গ্রেপ্তারের একদিন পর ২১ জুলাই প্রথম দফায় ৫৭ বাংলাদেশির সাজা ঘোষণা করা হয়।

মাহফুজ বলেন, ‘১০০ জনেরও বেশি বাংলাদেশিকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, যাদের সবাইকে পরে ক্ষমা করা হয়েছে। ’ তিনি দাবি করেন, রায় ঘোষণা না হওয়ায়, কিছু বাংলাদেশি এখনো সংযুক্ত আরব আমিরাতে কারাগারে রয়েছেন।  সংযুক্ত আরব আমিরাতে গ্রেপ্তার ও ক্ষমাপ্রাপ্ত বাংলাদেশিদের সংখ্যা যাচাই করতে আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পশ্চিম এশিয়া শাখায় যোগাযোগ করেছি।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পশ্চিম এশিয়া উইংয়ের মহাপরিচালক শফিকুর রহমান বলেন, ‘সংযুক্ত আরব আমিরাতে ক্ষমা পাওয়া অভিবাসী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১১৩/১১৪। ’

সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট ক্ষমা পেয়ে ফেরত আসা বাংলাদেশিদের মধ্যে আরেকজন হলেন মেহেরাজ উদ্দিন রাসেল। তিনি জানান, গত তিন বছর সংযুক্ত আরব আমিরাতে একটি হার্ডওয়্যারের দোকানে কাজ করতেন তিনি। তাকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।

বাংলাদেশে সরকারের নৃশংস দমনপীড়নে যখন বহু মানুষ নিহত হচ্ছে, তখন সংযুক্ত আরব আমিরাতে বসবাসরত অন্য অনেক বাংলাদেশির মতো রাসেলও প্রতিবাদ না করে থাকতে পারেনি। রাসেল বলেন, ঘটনাস্থল থেকে আমাদের পাঁচজনকে আটক করা হয়েছিল। ‘আমি কল্পনাও করতে পারিনি যে এ রকম কিছু ঘটতে পারে। আমাকে ১০ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আমার বাবা-মা অসুস্থ, তাদের দেখাশোনা করার মতো আমার কোনো ভাই বা বোন নেই। মনে হচ্ছিল যেন আকাশ ভেঙে পড়ল আমাদের ওপর। ’

তিনি জানান, তিনি এই মুহূর্তে গভীর আর্থিক সমস্যায় আছেন, কারণ তিনি অনেক চেষ্টা করে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। তার ভিসার মেয়াদ এখনো এক বছর বাকি আছে। কিন্তু সংযুক্ত আরব আমিরাত তাকে ফেরত পাঠানোর পর অন্য সবার মতো ‘নো এন্ট্রি’ স্ট্যাটাস দিয়েছে, এর অর্থ হচ্ছে তাকে আর সংযুক্ত আরব আমিরাতে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে না।

তিনি বলেন, ‘আমি আশা করি, সরকার এ বিষয়ে কিছু করবে। তারা ইতোমধ্যে আমাদের জন্য অনেক কিছু করেছে। ’

সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল আইন শহরে হওয়া বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন মো. হারুন। তিন সন্তানসহ পরিবারের পাঁচজন সদস্য তার আয়ের ওপর নির্ভরশীল। তিনি বলেন, ‘এটি আমাদের জন্য একটি বিশাল দুঃস্বপ্ন ছিল। আমরা আমাদের জীবন ফিরে পেয়েছি। ড. ইউনূসকে ধন্যবাদ, এ এক নতুন জীবন। আমরা তার জন্য দোয়া করি। আমাদের এমন একটি সরকার দরকার, যারা আমাদের এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে। আমার সন্তানরা তাদের বাবাকে ফিরে পেয়েছে এবং আমি আমার সন্তানদের ফিরে পেয়েছি। ’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাকে যদি সেখানে দশ বছর কারাগারে থাকতে হতো, আমি হয়তো সবাইকে হারাতাম। আর আমি হয়তো সেখানে আমার জীবনটাও হারাতাম। ’

সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্লাম্বিং, ওয়েল্ডিং ও বিভিন্ন বৈদ্যুতিক কাজ ও রক্ষণাবেক্ষণের ঠিকাদার হারুনের বিপুল আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। তিনি অনেকের কাছে টাকা পান, কিন্তু 'নো এন্ট্রি' স্ট্যাটাস ইস্যুর কারণে এই মুহূর্তে তার পক্ষে আর এসব টাকা ফেরত পাওয়ার কোনো উপায় নেই।  

তিনি বলেন, ‘আমি কৃতজ্ঞ যে আমি ফিরে আসতে পেরেছি। তবে সেখানে (সংযুক্ত আরব আমিরাত) আর ফিরতে পারব কি পারব না, সেটাই এখন বড় কথা। তবে আমরা যাতে দেশে কিছু করে টিকে থাকতে পারি বা সেখানে আমাদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে সরকার যদি সহায়তা করতে পারে, তবে খুব ভালো হবে। ’ 

এমনই আরেক বিদেশফেরত শাহজাহানের সংযুক্ত আরব আমিরাতে ঠিকাদারি ব্যবসা ছিল। তাকে আবুধাবি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি জানান, আবুধাবিতে তার অধীনে ৪৫০ জনেরও বেশি কর্মী কাজ করেন। সেখানে তার একটি ট্রাভেল এজেন্সিও ছিল।

তিনি বলেন, ‘আমার পাঁচটি লাইসেন্স ছিল। আমি আইটি, প্রযুক্তি এবং বৈদ্যুতিক কাজের চুক্তিতে জড়িত ছিলাম। সেখানে আমার কাছে ২৫ কোটি টাকার বেশি নগদ টাকা আছে, যা এখন তুলতে পারছি না। ’

শাহজাহান বলেন, তার প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৯৯ শতাংশ কর্মী বাংলাদেশি, যারা তার দুর্দশার কারণে এখন বেকার হয়ে পড়বে।
news24bd.tv/আইএএম