কোটা প্রসঙ্গে কিছু কথা

কোটা প্রসঙ্গে কিছু কথা

ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম তালুকদার

কোটা বিষয়টা এক ধরনের রাজনৈতিক মতবাদ। তার পরও বিষয়টি উচ্চ আদালত বিবেচনায় নেওয়ার কারণ কী? উচ্চ আদালতের এসংক্রান্ত পিটিশন বিবেচনায় নেওয়ার গ্রাউন্ড স্পষ্ট। কোটা ব্যবস্থার পুরোপুরি বিলুপ্তি সাংবিধানিক স্পৃহা ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার পরিপন্থী। ‘সমতা’ এবং ‘ন্যায্যতা’ শব্দ দুটো শুধু সাংবিধানিক স্পৃহা নয়, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাও।

আর এ দুটো বিষয় (সমতা ও ন্যায্যতা) বাস্তবসম্মত, যৌক্তিক এবং ইমপ্যাক্ট কনসার্ন এক্সপার্ট অ্যানালাইসিসের মাধমে নিপুণভাবে রাষ্ট্রীয় পলিসি বা নীতিতে সংযুক্ত ও প্রতিফলন করা আদর্শিক পাবলিক পলিসির লক্ষ্য বা কাজ। আর এ জন্যই রাষ্ট্র পরিচালনায়, বিশেষ করে পাবলিক পলিসি প্রণয়ন পর্যায়ে আমেরিকার মতো দেশও স্পয়েলস সিস্টেমের (Spoils System) আওতায় এক্সপার্টদের নিযুক্ত করে।

যাহোক, ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে কোটা নীতির সংস্কার না করে সরকারি পরিপত্রের মাধ্যমে কোটা ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা ছিল সাংবিধানিক স্পৃহা ও বাধ্যবাধকতার পরিপন্থী। ফলে উচ্চ আদালতে রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৪ সালে আদালত পূর্বের অবস্থা (অর্থাৎ কোটা ব্যবস্থা রহিতকরণ পূর্বাবস্থা) বা পূর্বের কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল করেছেন।

কারণ কোটা নীতির সংস্কার আদালতের কাজ নয়, আদালত তার কাজটিই করেছেন। আদালতের কাজ সরকারের কোটা নীতির অনুপস্থিতি যে সাংবিধানিক দায়বদ্ধতার বরখেলাপ সংশ্লিষ্ট রিটের প্রেক্ষিতে সেটা বলা। সেটা উচ্চ আদালত কিভাবে বলবেন সেটা তার এখতিয়ার, আপাতত আদালত পূর্ব নীতি পুনর্বহাল করেছেন।

সরকারের জন্য আরো কোনো দিকনির্দেশনা আছে কি না সেটা পূর্ণাঙ্গ রায়ে উল্লেখ রয়েছে। তবে সময়ের পরিক্রমায় বাস্তবতা ও ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর বিবেচনায় অধিকতর সমতা ও ন্যায্যতার স্বার্থে পলিসি সংস্কার বা কোটা নীতির সংস্কার সরকারের এখতিয়ার, এটি সাংবিধানিক আইন বা পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা পাবলিক পলিসি বিষয়ে যাঁদের জ্ঞান আছে তারা স্বীকার করবেন।

প্রাসঙ্গিকভাবেই ২০২৪ সালে উচ্চ আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া তরুণ প্রজন্ম ২০১৮ সালের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সরকারের কাছে কোটা ব্যবস্থায় অধিকতর সমতার ও ন্যায্যতার সমন্বয়ে সংস্কার দাবি করছে। তবে এই সংস্কারে তারা (অর্থাৎ আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীরা) কোটার যে হার নির্ধারণ দাবি করবে সেটা চূড়ান্ত হতে হবে এমন নয়; বরং এক্সপার্ট ওপিনিয়ন নিয়ে সময়, সমতা ও ন্যায্যতার সমন্বয়ে কোটা নীতির যৌক্তিক সংস্কার করা সরকারের অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তা ছাড়া এই সংবেদনশীল বিষয়টিকে ইস্যু করে অনেক পক্ষ ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চাইবে (যেটা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনৈতিক)। অধিকন্তু শিক্ষার্থীদের রাজপথে দীর্ঘ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে যানজটের মতো জনভোগান্তি অব্যাহত আছে।

আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে সরকারের অমীমাংসিত মুখোমুখি অবস্থান দীর্ঘস্থায়ী হওয়া রাষ্ট্রের জন্যও শুভ নয়। কারণ আজকের তারুণ্যই আগামী দিনের বাংলাদেশ। যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে উত্তর-আধুনিক এবং বিপর্যয়-উত্তর নতুন বিশ্বব্যবস্থায়—যেটা কি না হাই কম্পিটেন্সি এবং হিউম্যান ক্যাপিটালনির্ভর সৃজনশীল বিশ্বব্যবস্থা—তাতে এই তথ্য-প্রযুক্তিভিত্তিক তরুণ প্রজন্মেরও সরকারি চাকরির দিকে বেপরোয়া প্রবণতাকে এবং বিসিএস পরীক্ষায় গাইড ও মুখস্থনির্ভর মেধা যাচাইয়ের প্রশ্ন-প্রতিযোগিতাকে সমর্থন করি না। আমি বিশ্বাস করি আজকের সময়ে অধিকতর মেধাবী তরুণদের সরকারি চাকরি নির্ভরতার কলোনিয়াল ভাবনা বা আকাঙ্ক্ষা কমিয়ে উদ্যোক্তা মানসিকতা ও মননশীলতা গড়ে তোলা প্রয়োজন। শুধু নিজের জন্য না, অন্যের জন্য, অনেকের জন্য কাজ তৈরির সামর্থ্যেই সত্যিকারের মেধা ও ইমপ্যাক্ট কনসার্ন নেতৃত্বগুণ মননশীলতা।

 লেখক : অধ্যাপক, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (এআইইউবি)

 

 


 

এই রকম আরও টপিক