সাদিক অ্যাগ্রোর ইমরানের সঙ্গে ফাঁসছেন প্রাণিসম্পদের কর্তারা

সংগৃহীত ছবি

গরুকাণ্ড

সাদিক অ্যাগ্রোর ইমরানের সঙ্গে ফাঁসছেন প্রাণিসম্পদের কর্তারা

অনলাইন ডেস্ক

ডেইরি ফার্ম অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আলোচিত ইমরান হোসেন, যিনি সাদিক অ্যাগ্রো ফার্মের মালিক হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে ১৮টি নিষিদ্ধ ব্রাহমা জাতের গরু আমদানি, প্রজনন ও বিক্রিসহ বিভিন্ন অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেছে।  

কিন্তু কাগজপত্রে সাদিক অ্যাগ্রোর মালিক ইমরান হোসেন নয়। প্রকৃত মালিক তৌহিদুল আলম জেনিথ।

তিনি আবার ইমরান হোসেনের বন্ধু। আর সাদিক নামে (সাদিক খামার) আরও একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে যার মালিক মূলত ইমরান হোসেন। যার অর্থ দাঁড়ায়, দুই বন্ধু মিলেমিশে গরু ব্যবসার মাফিয়া সিন্ডিকেট গড়ে অবৈধ কার্যক্রম চালিয়েছেন।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এমন সত্য।

শুধু তাই নয়, অনুসন্ধানে ১৫টি ব্রাহমা গরুসহ ৪৪৮টি গবাদিপশু নিলাম ছাড়াই জবাই করে মাংস বিক্রির দায়িত্ব দেওয়া, জবাই না দিয়ে কোটি টাকায় বিক্রি কিংবা খামারে রেখে দেওয়া, সিমেন বিক্রি এবং সরকারি দায়িত্ব পালন না করে ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বিভিন্ন দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে সংস্থাটির অনুসন্ধান টিম।

অনুসন্ধান শেষে এখন চলছে মামলার প্রক্রিয়া। আর অনুসন্ধান প্রতিবেদন কমিশনের বিবেচনার জন্য রয়েছে, যেখানে টিমের সুপারিশে ইমরান হোসেন ও তৌহিদুল আলম এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের দুই পরিচালকসহ চার থেকে পাঁচজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মামলার আসামি হতে পারেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা (উপ-পরিচালক) মো. আকতারুল ইসলাম বলেন, কয়েকটি অভিযান ও নথিপত্র সংগ্রহ শেষে অনুসন্ধান টিমের কাজ চলমান রয়েছে। মামলা কিংবা অন্য কোনো আইনি প্রক্রিয়া হলে দুদক থেকে অফিসিয়ালভাবে জানানো হবে।

অন্যদিকে নাম প্রকাশ না করে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, সার্বিক পর্যবেক্ষণে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও কেন্দ্রীয় গো প্রজনন ও দুগ্ধ খামারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবহেলার প্রমাণ পাওয়া গেছে। সুলভমূল্যে মাংস বিক্রির উদ্দেশ্যে চলতি বছরের মার্চ মাসে কেন্দ্রীয় গো প্রজনন ও দুগ্ধ খামার থেকে আমদানি ও বেসরকারি পর্যায়ে উৎপাদন নিষিদ্ধ ব্রাহমা জাতের ১৫টি গরুসহ বিভিন্ন জাতের ৪৪৮টি গরু জবাই দেওয়ার পুরো প্রক্রিয়া অসঙ্গতি ও অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে।

অন্যদিকে সাদিকের ইমরান কিংবা তার বন্ধু তৌহিদুল দায়িত্ব পালন না করে ব্রাহমা গরু রেখে দিয়ে অন্য গরু জবাই দিয়েছেন।

তিনি বলেন, চক্রটি নিষিদ্ধ ব্রাহমা গরু খামারে লুকিয়ে রেখেছিল। দুদকের অভিযানে ইতোমধ্যে ৬টি গরু উদ্ধার করা হয়েছে। বাকিগুলোর সঠিক তথ্য নেই। তবে আমাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে যে, দুইটি গরু ২ কোটি টাকার ওপরে বিক্রি করা হয়েছে। বাকি ৭টি ‍লুকিয়ে রাখা হয়েছে নাকি জবাই করা হয়েছে সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।  
অন্যদিকে সাভার কেন্দ্রীয় গো প্রজনন কেন্দ্র থেকে কীভাবে সিমেন সংগ্রহ ও বাছুর করে বিক্রি করা হলো, সেটা অবাক কাণ্ড। দুদকের অভিযানে ৭টি বাছুরও জব্দ করা হয়েছে। এখানে অবশ্যই প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ রয়েছে।

এদিকে সাভার কেন্দ্রীয় গো প্রজনন ও দুগ্ধ খামার সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালে জব্দ হওয়ার পর ১৭ ব্রাহমা গরুর দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়। লালনপালন অবস্থায় দুইটি গরু মারা যায়। ছিল ১৫টি গরু। ২০২৪ সালের মার্চ মাসে ওই ১৫টি গরুসহ মোট ৪৪৮টি গরু নিলাম ছাড়াই বুক ভ্যালু পদ্ধতিতে মাংস বিতরণের জন্য জবাইয়ের জন্য ডেইরি অ্যাসোসিয়েশনকে দেওয়া হয়েছে। গরুগুলো লালনপালন অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এর পেছনে মাসে প্রায় ৪ লাখ টাকা ব্যয় হতো। অর্থাৎ তিন বছরে আড়াই কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে গরুগুলোর পেছনে।

দুদক মনে করছে, একদিকে পদে পদে অনিয়ম ও দুর্নীতি, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে গরুগুলোর পেছনে আড়াই কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। যেহেতু নিষিদ্ধ ব্রাহমা গরুগুলোকে নিয়ে অবৈধ ব্যবসা করা হয়েছে, সেহেতু সরকারি ওই ব্যয়কে সরকারের ক্ষতিসাধন বা আত্মসাতের মতো অপরাধ হিসেবে গণ্য করা যায়।

এ বিষয়ে সাদিক অ্যাগ্রোর মালিক ইমরান হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

নিষিদ্ধ ১৫টি ব্রাহমা জাতের গরুসহ ৪৪৮টি গবাদিপশু কোনো ধরনের নিলাম ছাড়া সাদিক অ্যাগ্রোর মাধ্যমে জবাই করে ৬০০ টাকা কেজি দরে ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কেন্দ্রের মাধ্যমে বিক্রি, গোপনে ব্রাহমা গরু বিক্রি ও গরুর সিমেন বিক্রিসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে গত ২,৩ ও ৪ জুলাই সাদিক অ্যাগ্রোর মোহাম্মদপুর, সাভার, নরসিংদী ও খামারবাড়ি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে দুদকের সহকারী পরিচালক আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্ব একটি টিম অভিযান চালায়। অভিযানে অধিকাংশ অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়।

২০২১ সালে নিষিদ্ধ ব্রাহমা জাতের ১৮টি গরু আমদানি করেছিল এই সাদিক অ্যাগ্রো। কাস্টমস বিভাগ বিমানবন্দরে সেই গরু জব্দ করে। পরবর্তী সময়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশে গরুগুলো প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরকে দেওয়া হয়। কিন্তু সাদিক অ্যাগ্রোর মালিক ইমরান হোসেন ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে গরুগুলো কৌশলে সাদিক অ্যাগ্রোকে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।

সাদিকের মালিক ইমরান হোসেনের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে ব্রাহমা জাতের ওই গরুগুলো দেশে আনার অভিযোগ রয়েছে। শাহীওয়াল জাতের নাম দিয়ে ২০২১ সালে জাল কাগজপত্র তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৮টি ব্রাহমা জাতের গরু দেশে আনেন তিনি। ২০১৬ সালে সরকার ব্রাহমা জাতের গরু বাংলাদেশে আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়।

আমদানি নিষিদ্ধ উন্নত জাতের ওই গরুগুলো হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জব্দ করেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। একটি গরু তখনি মারা যায়। অন্য গরুগুলো পাঠানো হয় সাভারের গো প্রজনন কেন্দ্রে। সেখানে আরও দুটি মারা যায়। পরে গরু আমদানি নিয়ে ওই বছরের ২০২১ সালের হাইকোর্টেও শুনানি হয়েছিল, তখন আদালত কাস্টমস কর্মকর্তাদের গরুগুলো জব্দ করার সিদ্ধান্তের পক্ষেই রায় দেন। এরপর ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গরুগুলো সাভারের গো প্রজনন ও দুগ্ধ খামারেই লালনপালন হয়।

আলোচিত ছাগলকাণ্ডে এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমানের ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাত ১৫ লাখ টাকা মূল্যের ছাগলটি সাদিক অ্যাগ্রো থেকে কিনে এক লাখ টাকা অগ্রিম পরিশোধ করেছিলেন। পরে এ নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হলে ছাগলটি আর ওই খামার থেকে নেওয়া হয়নি। এ ঘটনার পর সাদিক অ্যাগ্রোকে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। পরে অবৈধভাগে খাল ও সিটি করপোরেশনের জায়গা দখল করে গড়ে তোলা সাদিক অ্যাগ্রোর খামার ভেঙে দেয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন।

news24bd.tv/DHL