পিতা-পুত্রের তেলেসমাতি

পিতা-পুত্রের তেলেসমাতি

ইমরান হোসেন

একজন সাধারণ ড্রাইভার থেকে সৈয়দ আবেদ আলী কীভাবে কোটিপতি এবং নিজ এলাকায় কীভাবে রাজনৈতিক নেতায় রূপান্তরিত হলেন তা এখন টক অব দ্য কান্ট্রি।

চাকরির খোঁজে রাজধানীতে এসে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) পরিচালকের গাড়িচালক হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। পরবর্তী সময়ে দায়িত্ব পান পিএসসি চেয়ারম্যানের গাড়ি চালানোর। রূপকথার আলাদীনের জাদুর প্রদীপের মতো আবেদ আলী এই চাকরি পেয়ে শূন্য থেকে শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন।

নিজেকে রক্ষা করার জন্য পূর্ব পরিকল্পিতভাবে রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রকাশ করা এবং দুর্নীতির শিখরে থেকে ভালো মানুষ হিসেবে পরিচয় দেওয়ার জন্য ব্যবহার করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং লোক দেখানো জনসেবা।

সম্প্রতি দেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বেরিয়ে আসে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসেসসহ (বিসিএস) ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের তথ্য। বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (বিপিএসসি) ছয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর একটি সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। সেই অভিযুক্ত কর্মচারীদের একজন পিএসসি চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী জীবন।

আর এর নেপথ্যে রয়েছে পিএসসির অধীনে বিসিএসসহ বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস।

শতকোটি টাকার মালিক হওয়ার পর রাজনৈতিক ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার জন্য হতে চেয়েছিলেন মাদারীপুর জেলার ডাসার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান । সেই চাওয়া থেকে দীর্ঘদিন থেকে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনের জন্য প্রচার-প্রচারণাও চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

আবেদ আলীর ব্যক্তিগত ফেসবুকে প্রোফাইলে আপলোডকৃত বিভিন্ন ভিডিও ও পোস্টে দেখা যায়, এলাকাভিত্তিক জনসভায় নিজেকে একজন সংগ্রামী ও ত্যাগী মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করেন তিনি।

গত ১২ জুন আবদে আলী তার ফেসবুকের এক পোস্টে লেখেন, ‘আমার জীবনে কোনোদিন অসদুপায় অবলম্বন করিনি। গায়ে খেটে ভাগ্য পরিবর্তন করেছি। ’ আরেকটি  ভিডিওতে আবেদ আলী নিজেকে নিতান্তই সাধারণ মানুষ হিসেবে দাবি করেন। তিনি বলেন, আমার কোটি কোটি টাকা নাই, তবে জনগণের ভালোবাসা অর্জন করার ক্ষমতা ঠিকই রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ের আপলোড করা ভিডিতে দেখা যায়, ডাসার উপজেলায় বিভিন্ন সময়ে জনসাধারণের মধ্যে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করছেন।

নিজেকে ভালো মানুষ হিসেবে দাবি করা আবেদ আলী এখানেই থামেননি। টাকার পাহাড় করার পর পাল্টে ফেলেছেন নিজ বংশ উপাধিও। স্থানীয়সূত্রে জানা গেছে, আবেদ আলী জীবনের বিত্ত-বৈভবে ফুলে ফেঁপে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মীর পদবি পাল্টে নামের আগে সৈয়দ পদবী ব্যবহার করেন।

আবেদ আলীর সম্পদের প্রাথমিক তথ্য মারফত জানা যায়, যে পরিমাণ টাকা তিনি বাগিয়ে নিয়েছেন, তাতে হয়ে গেছেন গ্রুপ অব কোম্পানির মালিক। গ্রামে তৈরি করেছেন ডুপ্লেক্স বাড়ি। পাশে নিজের নামে তৈরি করেছেন মসজিদ। রয়েছে ডেইরি ফার্ম ও বাগানবাড়ি। রাস্তার পাশে সরকারি জায়গা দখল করে তৈরি করেছেন মার্কেট। নিজ এলাকায় শতবিঘার ওপরে জমি কেনার পাশাপাশি কুয়াকাটায় তৈরি করেছেন থ্রি স্টার হোটেল সান মেরিনো। ঢাকার মিরপুর ও উত্তরায় রয়েছে দুটি বহুতল বাড়ি। তথ্য বলছে, ঢাকার বিভিন্ন স্থানে তার রয়েছে অন্তত সাতটি ফ্ল্যাট এবং তিনটি প্লট।

গ্রেপ্তারে পর গণমাধ্যমের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে আবেদ আলীর কাছে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল প্রশ্ন ফাঁসে কত টাকা ইনকাম করেছেন? জবাবে আবেদ আলী বলেন, ‘প্রশ্ন ফাঁসে যত টাকা কামাই করেছি, সব খরচ করেছি আল্লাহর রাস্তায়। ’

এদিকে, সৈয়দ আবেদ আলীর সঙ্গে একই গতিতে ছুটে চলেছিলেন তার প্রিয় পুত্র সৈয়দ সোহানুর রহমান। সিয়াম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বরাবরই থাকতেন সরব। বাবার এবং নিজের সামাজিক কর্মকাণ্ড ফেসবুকে পোস্ট দিতেন সবসময়। বাবাকে নিয়ে তার গর্বেরও শেষ ছিল না।

এক পোস্টে বাবা আবেদ আলীকে নিয়ে সিয়াম লিখেছিলেন, সন্তান হিসেবে গর্ব করার মতো অনেক কিছু দিয়েছেন এই মানুষটা। বিনিময়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ পাইনি কখনো। জন্মের পর থেকে কোনো কিছু চাইতে হয়নি। প্রয়োজন অনুভব করার আগেই পেয়ে গেছি।  তিনি ওই পোস্টে আরো উল্লেখ করেন  বাবার  রক্তে-ঘামে অর্জিত সাম্রাজ্য ভোগ করছি আমরা তিন ভাই-বোন। আমাদের কাছে তিনিই সব। আমার জীবনের সমস্ত গল্পের একমাত্র হিরো আমার বাবা।

বাবার উত্থানের গল্প বলতে গিয়ে তিনি বলেন, আমার বাবা একদম ছোট থেকে বড় হয়েছেন। আমার বাবার বয়স যখন ৮ বছর, তখন পেটের দায়ে তিনি ঢাকায় চলে গেছেন। ঢাকায় গিয়ে কুলিগিরি করে ৫০ টাকা রুজি দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। তিনি এখন একটি লিমিটেড কোম্পানির মালিক। তিনি কষ্ট করে বড় হয়েছেন।

রাজনীতিতে নাম লিখিয়ে ছাত্রলীগের তিনটি ইউনিটের পদ বাগিয়ে নিয়েছিলেন সোহানুর রহমান সিয়াম। তিনি একাধারে ডাসার উপজেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি, ভারত শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি এবং ঢাকা উত্তর মহানগর ছাত্রলীগের ত্রাণ ও দুর্যোগ সম্পাদক পদেও দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে তিনি বিদেশে পড়ালেখা করেছেন। এরপর দেশে এসে তিনি ভর্তি হন একটি ব্যয়বহুল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

সিয়াম ও তার পিতা আবেদ আলী একইসঙ্গে ডাসার উপজেলার সাধারণ মানুষকে সাহায্য করতে যেতেন। সেখানে ভিডিও ধারন করে তা প্রচার করেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সিয়াম চলাফেরা করেন দামি গাড়িতে। এছাড়া দেখা গেছে কোথাও গেলে দামি গাড়ি নিয়েই ঘুরতেন তিনি।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) অধীন বিসিএসের ক্যাডার এবং নন-ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়ার পর ত্রাণ ও দুর্যোগবিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়ামকে পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগ।

news24bd.tv/SHS