ক্যান্সার প্রতিরোধে প্রয়োজন সচেতনতা

ফাইল ছবি

ক্যান্সার প্রতিরোধে প্রয়োজন সচেতনতা

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ

একটা সময় ছিল, যখন ক্যান্সারের কোনও অ্যানসার ছিল না। কিন্তু আজ অধিকাংশ ক্যান্সারকে সারিয়ে তুলছেন বিশেষজ্ঞরা। আর এই মারণ রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারি আমি, আপনি আমরা সবাই। দরকার সচেতনতা।

অতিমাত্রায় তামাকজাত দ্রব্য সেবনের কারণে আক্রান্ত হচ্ছে ফুসফুস ক্যান্সারে। আবার অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণও ক্যান্সারের একটি অন্যতম কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দ্বারা প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে, ২০১৮ সালে ৯.৬ মিলিয়ন ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে ক্যান্সারে।  

কৃষিতে রাসায়নিক ও কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার আমাদের খাদ্যদ্রব্যকে করে তুলছে অনিরাপদ।

এর উপর রয়েছে ফলমূল ও মাছে ফরমালিনের ব্যবহার। বায়ুদূষণকেও ক্যান্সার বিস্তারের আরো একটি কারণ বলে মনে করা হয়। বাতাসে সিসার পরিমাণ বৃদ্ধি ক্যান্সারের ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। গবেষণা বলছে, ক্যান্সার আক্রান্ত প্রতি ২ লাখ মানুষের জন্য দুটি রেডিও থেরাপি সেন্টার যা প্রয়োজন। কিন্তু অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশে বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি রেডিও থেরাপি সেন্টার যা আছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। এর মধ্যে সরকারি ও বেসরকারিভাবে যত মেশিন আছে তার সবগুলোর মেশিন আবার সমভাবে সচল নয়।  

জানা গেছে, মোট ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর মধ্যে ৬০ শতাংশই পুরুষ। পুরুষেব মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ১৩ শতাংশ আক্রান্ত হচ্ছে ফুসফুস ক্যান্সারে, লিপ অ্যান্ড ওরাল ক্যান্সারে ১২ শতাংশ, অম্ল নালির ক্যান্সারে ৮ দশমিক ২ শতাংশ।  এ ছাড়া আছে পাকস্থলী, হসকিন লিম্ফোমা, মূত্রনালি, লিভার ও লিউকোমিয়া ক্যান্সার।

বর্তমানে পৃথিবীতে প্রতি বছর ৮২ লাখ মানুষ ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করে। এর মধ্যে ৪০ লাখ ঘটে অকালমৃত্যু, ৩০ থেকে ৬৯ বছরের মধ্যে। ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে কিছু কাজ সম্মিলিতভাবে সফল করতে পারি। আবার ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকেই পারি ক্যান্সারের বোঝা লাঘবে ভূমিকা রাখতে। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের ওপর ক্যান্সারের ক্ষতিকর প্রভাব লাঘবে সবারই সুযোগ আছে ব্যবস্থা নেয়ার।  

ক্যান্সার অনেক সময় নিঃশব্দে হানা দিতে পারে সুখের জগতে। স্বাস্থ্য সচেতন না হলে হয়তো ঘুণাক্ষরেও টের পাবেন না কীভাবে দুঃস্বপ্নময় জীবনের দিকে পা বাড়াতে যাচ্ছেন। ভাগ্যবান হলে অনেক সময় অন্যান্য কোনো সাধারণ রোগ পরীক্ষার সময় ঘটনাচ্ছলে রোগীরা টের পান যে, তাদের শরীরে নিঃশব্দে ঢুকে পড়েছে ঘাতক ক্যান্সার। এরপর শুরু হয় যুদ্ধ। শুধু বেঁচে থাকার যুদ্ধ। রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি, দেশ- বিদেশের অনকোলজিস্ট, ব্যাপক টাকা-পয়সা খরচ করে অবশেষে একদিন জেগে ওঠেন একজন ক্যান্সার সারভাইভার অকুতোভয় যোদ্ধা। এসবই প্রাথমিকভাবে শরীরে দানা বেঁধে থাকা ক্যান্সারের গল্প। কিন্তু এমন কিছু ক্যান্সার রয়েছে, যা কিনা আপনাকে ভেবে দেখার সময় দেবে। আর এসব হলো সেকেন্ডারি ক্যান্সার। আশা করি, একটু সচেতন হলেই এসব ক্যান্সারকেও আপনি পরাজিত করতে পারবেন।

বায়ু দূষণ ক্যান্সারের উচ্চ ঝুঁকির সাথেও যুক্ত। ২০১৩ সালে, ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার (IARC) দ্বারা বাইরের বায়ু দূষণকে ক্যান্সারের কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। যদিও ধূমপান এবং স্থূলতার মতো অন্যান্য ঝুঁকির কারণগুলির তুলনায় সামগ্রিক ঝুঁকি কম, তবে এটির একটি সমন্বয়মূলক প্রভাব থাকতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বের প্রতি ৮ জন নারীর একজন স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীদের মধ্যে স্তন ক্যান্সার শীর্ষে। প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ২০ হাজার নারী ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। মৃত্যু হচ্ছে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ। স্তন ক্যান্সারের প্রধানতম কারণের মধ্যে ৩৫ বছরের ঊর্ধ্বে বয়স্ক নারী স্তন ক্যান্সারের পারিবারিক ইতিহাস, বেশি বয়সে প্রথম সন্তান ধারণ, বুকের দুধ না পান করানো, দীর্ঘদিন জন্ম নিয়ন্ত্রণ পিল গ্রহণ, কম বয়সে মাসিক হওয়া বা ৫০ বছরের অধিক বয়সে মাসিক বন্ধ হওয়া, খাদ্যে অতিরিক্ত চর্বি গ্রহণ, ধূমপান ও তামাকজাতীয় দ্রব্যে আসক্তি ও তেজস্ক্রিয় পদার্থের সংস্পর্শে আসা ইত্যাদি অন্যতম। স্তন ক্যান্সারের পর জরায়ু মুখের ক্যান্সারের অবস্থান। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ৬ লাখ নারী এ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে; মৃত্যুবরণ করছে অর্ধেকেরও বেশি। আমাদের দেশে প্রতিবছর মারা যাচ্ছে ১০ হাজারেরও বেশি নারী। অরক্ষিত যৌন সংগম জরায়ু মুখে ক্যান্সারের অন্যতম কারণ। ২০ বছরের কম ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে বয়স্ক নারীদের এ ক্যান্সারে আক্রান্তের ঝুঁকি কম। তবে ৩৫-৫৫ বছর বয়সিরা এ ব্যাধিতে আক্রান্তের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।

বিশ্বের অনেক দেশে ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে নারীদের মৃত্যু হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, নিউজিল্যান্ডসহ আটাশটি দেশে এ ধারা লক্ষ্য করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞগণের মতে নারীদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন, সিগারেট ও মদ্যপানে আসক্তি, দূষিত পরিবেশে কাজ করা প্রভৃতি ক্যান্সারের ঝুঁকির উপাদান হিসেবে নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে। অনেকে ধূমপান না করলেও পান এবং পানের সঙ্গে জর্দ্দা, সাদা পাতা এ ধরনের তামাক জাতীয় দ্রব্যাদি সেবন করে থাকেন। এসবও তাদের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার কারণ। একই কারণে মুখ গহ্বরেও ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে অনেকে।

স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ, নিয়মিত বাস্তবসম্মত শারীরিক ব্যায়ামে উৎসাহিত করতে হবে, ধূমপান ও নেশাজাতীয় দ্রব্যাদি পরিহারে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। নিয়মিত পরীক্ষা নিরীক্ষা ও সময়মতো চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তাহলেই ক্যান্সার প্রতিরোধে অনেকাংশে সাফল্য আসবে এবং ক্যান্সারে আক্রান্তদের সিংহভাগ মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে।

লেখক : অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ, উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ  মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।